কৃষ্ণচূড়া – প্রীতম চৌধুরী

দুপুরে হঠাৎ কেমন গুমোট করে এসেছে। কলকাতা শহরটা যেন দুপুরবেলা পর্দা এঁটে ঘর অন্ধকার করে ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা বাসনওয়ালা ডাকতে ডাকতে চলে গেল, তবু আলসেমি ভেঙে উঠলো না সে। ওদের পুরোনো বাড়িটার খোলা বারান্দার রেলিং-এ পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে দেয়া। চাইলে ঘরে গিয়ে এসি চালিয়ে বসতেই পারত, কিন্তু আজ অনেকদিন পর বারান্দায় এসে বসেছে। বারান্দার ওপাশে রেলিং জুড়ে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ প্রায় এলিয়ে পড়েছে ওদের বারান্দায়। বৈশাখ শেষের দুপুরে যেন আগুন জ্বলে গেছে গাছটায়। মাঝে মাঝে আগুন খসে খসে পড়ছে মাটিতে। কংক্রিটের রাস্তায় যেন আগুনের ফুলকি পড়ে রয়েছে। বারান্দায় বসে পুরোনো পাখাটা চালিয়ে একমনে কবিতা পড়ছে সে।  

বলিনি কখনো?

আমি তো ভেবেছি বলা হয়ে গেছে কবে।

এভাবে নিথর এসে দাঁড়ানো তোমার সামনে

সেই এক বলা

কেননা নীরব এই শরীরের চেয়ে আরো বড়ো কোনো ভাষা নেই

কেননা শরীর তার দেহহীন উত্থানে জেগে যতদূর মুছে নিতে জানে

কেমন একটা করে উঠলো দেয়ার। এমনটা আগে হয়নি তো। দুপুরের নৈঃশব্দ্য, পাখার ঘড়ঘড় আওয়াজ, সব কোথাও হারিয়ে গেছে। নিথর হয়ে দাঁড়িয়েও তবে অনেক কথা বলা যায় ? তার শরীর তো কখনো দেহহীন উত্থানে জেগে ওঠেনি! কবিরা কি মনগড়া কথা লেখে সবসময় ?

ফোনটা বেজে উঠলো। অনিশ Whatsapp করেছে, “ কিরে আজ এলিনা ?” । মেসেজ টা seen না করেই রেখে দিল। ঋতু দু’বার ফোন করে ফেলেছে এর মধ্যেই। ইচ্ছে করেই ধরেনি। আজ একটু একা থাকতে চায়।   

হঠাৎ দেখল, ওদের বারান্দায় এলিয়ে পড়া কৃষ্ণচূড়া গাছটা একটু বেশি উজ্জ্বল লাগছে। আকাশটা কালো হয়ে আসছে। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়ায় ওর বইয়ের পাতাগুলো পর পর উল্টে যেতে থাকলো আর সেই সঙ্গে একটা বৃষ্টির গন্ধ এসে লাগলো ওর গায়ে। দেয়া চোখ বুজে সেই ঘ্রাণ নিল। অনেকদিন পর আকাশটা এমন কালো করে এসেছে । দেয়া যখন ছোট ছিল, তখন ওর মা দেয়া কাঁদলে “ছায়া ঘনাইছে বনে বনে, গগনে গগনে ডাকে দেয়া” গেয়ে ঘুম পাড়াত। মা নেই, আজ তিন বছর হয়ে গেছে। হঠাৎ আকাশে এমন মেঘ ঘনিয়ে এলে দেয়ার মায়ের কথা মনে পড়ে।

এমন সময় দরজায় কলিং বেল। এই ভরদুপুরে আবার কে এল? বাবার তো এখন ফিরে আসার সময় নয়। বাবার কলেজ শেষ করে লাইব্রেরি সেরে ফিরতে ফিরতে সেই সাড়ে সাতটা – আটটা। তবে কি শরীর খারাপ হল বাবার? এসব ভাবতে ভাবতে দরজা খুলে চমকে উঠলো দেয়া।

ঈশান। ইউনিভার্সিটি ফেরত এসেছে, কাধে ব্যাগ। ওকে ভেতরে নিয়ে গিয়ে এসি টা চালাল দেয়া। ঘেমে স্নান করে গেছে।  

-“ বাবা, কোন এঁদো গলিতে থাকিস রে, উবর ড্রাইভারটা চিনতেই পারল না, গুগল ম্যাপেও নেই নাকি রে তোদের কাশী মিত্র লেন !”

-“ নর্থ টা পায়ে হেঁটে চিনতে হয় রে, উবর এর এসিতে বসে নর্থ ক্যালকাটা চেনা যায়না ”।

-“It’s Kolkata, not Calcutta anymore, colonial hangover টা কাটিয়ে ওঠ এবার”।

-“ কাটিয়ে কি করব, যুক্তরাজ্য ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের গোলামি করব ? Labour কে Labor লিখলেও মানেটা পালটে যায়না ”।

-“ যুক্ত what ? ”।

– “ ও আর বুঝে কাজ নেই, কি খাবি বল, কিছু অর্ডার করি ?”

– “ এইজন্য তোদের কমপ্যারাটিভ ডিপার্টমেন্ট এর কারুর কথা বুঝিনা আমি, কি বলতে যে কি বলে ! তোর ওই অনিশ, ঋত্বিক ঘটক আর কুরোসওয়া না কে, এদের নাম ছাড়া মুখে কথাই নেই”।   

“ উফ, তোর অনিশ কে নিয়ে আর ইন্সিকিওরিটি কাটল না”।

-“ ইন্সিকিওরিটির কারণ আছে বলছিস ?”

-“ হ্যাঁ বলছি, শান্তি ?”

বলে বইয়ের পাতায় চোখ ফেরাল দেয়া। ঈশান আর দেয়া কলেজের সেকেন্ড ইয়ার থেকে একসাথে। এখন দুজনেই ইউনিভার্সিটির শেষ করার পথে। ঈশান স্ট্যাটিসটিকস্ আর দেয়া কমপ্যারাটিভ লিটারেচার।

-“ কী খালি কবিতার বই নিয়ে পড়ে আছিস, একটু আমার দিকে দেখ না”।

-“ কী দেখব ? দিন দিন মোটা হচ্ছিস ”।

-“ তাই বল, এখন আর পছন্দ হবে কেন, আমার তো আর ফতুয়া নেই, এক গাল দাড়ি ও নেই”।

-“ উফ, stop it ঈশান !”

আজ দেয়া-র একা থাকতে ইচ্ছা করছিল। অনেকদিন পর মনের মতো একটা দুপুর কাটাতে চাইছিল দেয়া। একা। নিজের সাথে নিজের বোঝাপড়ার সময় প্রয়োজন ছিল তার। একটু নিজেকে নিজের থেকে আলাদা করে নিয়ে দেখা। ঈশান এসেছে, কিন্তু ও খুব একটা খুশি হতে পারছেনা।  

– “ আজ ইউনিভার্সিটি গেলি না যে ! ”

– “ এমনিই ইচ্ছা করছিল না, তেমন ক্লাস ও ছিলনা আজ ।”

– “ ওহ, তাই ভাবলাম একটু দেখে আসি, নিশ্চই বাড়িতে এসি চালিয়ে ঘুমোচ্ছিলিস।“

– “ না রে, দুপুরে আমি ঘুমোই না ।“  

হঠাৎ জোরে হাওয়া বইতে আরম্ভ করল। দেয়ার ঘরের জানলা গুলো দরাম দরাম করে আওয়াজ করতে লাগল।

– “ এই রে, ঝড় উঠল মনে হয় !”

– “ Lovely, এই weather টাই তো চাইছিলাম !”

দেয়া উঠে জানলা গুলো বন্ধ করতে যাচ্ছিল, ঈশান হঠাৎ ওর হাতটা ধরে বলল,

-“ তোকে আজ ঘ্যামা দেখাচ্ছে”।

বুঝতে পারছেনা দেয়া ওর কি করা উচিৎ।

 “একটু আয় না আমার কাছে…”

নিজের উষ্ণ নিশ্বাস টের পাচ্ছে ঈশান। দেয়া ঠিক তৈরি ছিল না ব্যাপারটার জন্য। এমন না, যে এভাবে কাছে আসা ওদের কাছে নতুন কিছু। তবু আজ দেয়া অন্য মনে আছে। অন্য মুডে।  

হঠাৎ প্রচণ্ড জোরে বাজ পড়ার একটা আওয়াজে দুজনেই চমকে উঠল। সেই সঙ্গে হাওয়ায় পর্দাগুলো উড়তে লাগলো। তারপর উঠলো প্রচণ্ড ঝড়। কালবৈশাখী।

– “ হাতটা ছাড়, জানলা গুলো বন্ধ করে আসি ।“  

-“ আজ আমায়ে একটু ভালবাসতে দে, এরকম দিন আর আসবে না দেয়া”।

-“ কিন্তু ঈশান, আজকে, মানে এভাবে এখন…”

-“প্লিস আজ কোনো কথা শুনব না তোর, খালি আজ না কাল, কাল না পরশু”।

-“ঈশান, লক্ষ্মী সোনা আমার, আজকে আমার…”

-“ চুপ, আর কোনো কথা না”।  

বলে দেয়ার ওপর কার্যত ঝাঁপিয়ে পড়ল ঈশান। ওর চোখ, গাল, ঠোঁট বেয়ে কি যেন হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে, কিন্তু পাচ্ছে না।

ঝমঝম করে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে, যেন তাণ্ডব হচ্ছে। আর এদিকে দেয়ার একইসাথে দেয়ার চোখ, গাল, বুক বেয়ে অন্য আরেক বৃষ্টি নামছে আস্তে আস্তে। ভালো লাগছে না দেয়ার। কান্না পেয়ে গেল হঠাৎ ওর। কিন্তু প্রতিরোধের ক্ষমতা নেই আজ তার। ঈশান এতটাই নাছোড়বান্দা।

এই নাছোড়বান্দা ইচ্ছে দিয়েই ভালবাসা কোথায় পালিয়ে যায়। যা পেতে চাই, তা জোর করে পেতে হবে। আপনি এসে ধরা দেওয়ার অপেক্ষা করে কতজন ?

দম বন্ধ হয়ে আসছে দেয়ার। ও ঈশান কে আজ ও অতটাই ভালোবাসে, কিন্তু এভাবে যে কখনো চায়নি সে। এভাবে পেতে চায় ও না সে ঈশানকে। দুপুরের কবিতার লাইনগুলো কি ভীষণ সত্যি।

দীর্ঘ চরাচর,

তার চেয়ে আর কোনো দীর্ঘ যবনিকা নেই।

কেননা পড়ন্ত ফুল, চিতার রুপালি ছাই, ধাবমান শেষ ট্রাম

সকলেই চেয়েছে আশ্রয়।

আশ্রয় ? ঠিক কাকে বলে আশ্রয় ? যেখানে এসে সারা দিনের ক্লান্তি শেষে, বসে, পাখাটা চালিয়ে দু-দণ্ড শান্তি পাওয়া যায় ? নাকি মধ্যরাতে প্রচণ্ড ঝগড়ার পর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সবরকম প্রস্তুতি নিয়েও, দরজা থেকে ফিরে এসে অঝরে কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে বসে পড়া যায়?

সেকথা বলিনি ? তবে কিভাবে তাকাল এতদিন

জলের কিনারে নিচু জবা ?

শূন্যতাই জানো শুধু ? শূন্যের ভিতরে এত ঢেউ আছে

সেকথা জানো না ?

গা গুলিয়ে উঠলো দেয়ার। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ঈশানের উদ্ধত অধর উপেক্ষা করে ছুটে চলে গেল বারান্দায়। অবিন্যস্ত চুল, এলোথেলো পোশাক। বাইরে যেন প্রলয় চলছে। সন্ধ্যা নামছে, তার সাথে বৃষ্টি আরও বেড়ে চলেছে। বৃষ্টির ঝাপটায় ভিজে যাচ্ছে দেয়া। তার কান্নাভেজা গালের তাপ শুষে নিচ্ছে বৃষ্টির ঠাণ্ডা জল। না, কবিরা মনগড়া কথা লেখেন না। আমরাই কালো স্থবির জলের প্রতি নুইয়ে-পড়া জবার আকুলতা সাদা চোখে দেখতে পাই না।  

হঠাৎ, কী একটা পায়ে ঠেকতে দেখে ওদের বারান্দায় এলিয়ে পড়া কৃষ্ণচূড়া গাছের ডালটা ফুলসমেত বারান্দায় পড়ে আছে।   

কবিতা ঋণঃ শূন্যের ভিতরে ঢেউ, শঙ্খ ঘোষ।

3 Comments Add yours

  1. Jagori says:

    Khub valo laglo… aj prothom bar kothabriksha porlam.. udbodhon rochonar udbodhon chetonar

    Like

  2. Gargi Chowdhury says:

    অপূর্ব। খুব ভালো লাগলো।

    Like

  3. Archee Roy says:

    Excellent. .. willing to read more…

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.