অন্ধকারে বসে আছি।দৃষ্টি পথের কোনা সীমাই আন্দাজ করা যাচ্ছে না।শুধু নাকে আসছে ধূপের একটা গন্ধ।মনে হচ্ছে জায়গাটা খোলা মেলা – মাঝে মাঝে একটা ঠান্ডা হাওয়া গায়ে এসে লাগছে।আর একটা গান –
আপনি কেটেছে আপনার মূল…
না জানে সাঁতার, নাহি পায় কূল…
ভাঙা ভাঙা একটা গলা!গানটা অচেনা।
মনে হয় এটা একটা মাঠ!ধূপের সাথে জড়িয়ে আসছে কেমন একটা বুনফুলের গন্ধও।ধীরে ধীরে চোখটা অন্ধকারে ধাতস্থ হয়ে গেল – দূরে বোঝা যাচ্ছে বাড়ির ছায়া,আমি বসে আছি একটা বড় বাড়ির সামনে।বুঝতে পারছি গানটা এই বাড়িটারই ভিতর থেকে বাইরের দিকে এগিয়ে আসছে।সামনে গাঢ় অন্ধকার, তবু বুঝলাম উলের জ্যাকেট জাতীয় কিছু পরা একজন সামনে ঝুঁকে পড়া মানুষের ছায়া।গানটা তখন আসছে আমার থেকে হাত দুই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ছায়াটার থেকেই –
সুহৃদের তরে চাই চারি ধারে…
আঁখি করিতেছে ছলোছল,
আপনার ভারে মরি যে আপনি
কাঁপিছে হৃদয় হীন বল…
তোমার কথা হেথা কেহ তো বলে না!
করে শুধু মিছে কোলাহল!
শেষে সুরটা আসতে আসতে মিলিয়ে গেল,সেই বুনফুলের গন্ধটার সাথেই।
একটা কন্ঠস্বর।চারিদিকে অন্ধকারের সব নীরবতা ভেদ করে কানের সদরে হঠাৎ ধাক্কা দিল -‘এসো আমার সঙ্গে -‘
এই আহ্বান সত্যিই অপ্রত্যাশিত।আমি তবু গেলাম – গানের সুর সেই ফুলের গন্ধটা আর এই অন্ধকার তখন আমার সারা গায়ে – আমি হাঁটছি যেন নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে ।
হঠাৎ দৃশ্যান্তর।
একটা ঘর।একটা সুন্দর নক্সা করা মোমদান – মোমবাতির আলোয় সারা ঘর লালচে হয়ে আছে।সামনে একটা টেবিল।তার উপরে খাতা পেন কত সব শিশি বই আরও কত কী!আমি বসলাম একটা বেতের মোড়ায়।আর আছে এক ফালি একটা চৌকি।ঘরটায় জানলা আছে একটাই।খুব গুমোট করে আছে।তবু হাওয়া দিচ্ছে মাঝে মাঝে;তাতেই মোমের আলোটা কাঁপছে।আর আছে একটা ইজি চেয়ার – সারা ঘরটা দেখতে দেখতে চোখটা হঠাৎই থমকে দাঁড়ালো ওই ইজি চেয়ারটার কাছে এসেই!গায়ের জামাটা আরও বেশি যেন ভিজে উঠলো – একী!সামনে কে বসে আছে?এ যে বাঙালির ‘ঠাকুর’!রবীন্দ্রনাথ!
বাইরের অন্ধকারের চোখ আলোয় সামলাতে সামলাতে – প্রথমে লক্ষ্যই করি নি, এখন দেখছি রবীন্দ্রনাথই বসে আছেন; যেন এক ঋষি।
কি বলা উচিত বা করা উচিৎ এমন কী; কি ভাবা উচিৎ – কিছুই বুঝতে পারছি না।তারপর হঠাৎ খুব ভয়ের মতো কি একটা হলো, চোখ দুটো চেপে ধরলাম – একটু ক্ষণ পর খুলে দেখি,হ্যাঁ!রবীন্দ্রনাথই তো – আধ শোয়া হয়ে আছেন ইজি চেয়ারটাতে।
ভয় কিছুটা সংযত হয়ে এসেছে – স্নায়ু কিছুটা শান্ত করে একরকমের অসহায়ের মতোই জিজ্ঞেস করলাম – ‘আপনি?’
অপর প্রান্তে তখন তপস্যার নীরবতা – আবার বললাম,’আপনি!মানে রবীন্দ্রনাথ?’
এবার মুখে ছেলেমানুষি হাসি ছড়িয়ে উত্তর এলো,’হ্যাঁ! তোমার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে ছিল।তুমি নাকি বলেছ,আমার গান শুনলে তোমার ঘুম পায়?’
– ‘না মানে,ভালোই তো?’
– ‘আচ্ছা আমার একটা গান শোনা বে?’
– ‘আমি!আমি তো গান গাইতেই পারি না।’
– ‘জাতীয় সঙ্গীতটাও জানো না?’
– ‘এমা না না।গাইবো?’
– ‘না থাক, ওটা ওমন যখন তখন না গাওয়াই ভালো।’
– ‘ও, আচ্ছা।’
– ‘আচ্ছা!আমি কে বল তো?’
এতক্ষণে অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছি তাই বেশ বুক ফুলিয়েই বললাম,’কেন!বিশ্বকবি!কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর!’
এবার ঠোঁটের কোনে একটা পরিহাসের হাসি টেনে বললেন,’বিশ্বকবি?কবিগুরু?’
– ‘হ্যাঁ তো!আপনার কত গান।কত কবিতা!’
– ‘ শুধু গান আর কবিতাই?’
– ‘আপনি আমাদের গর্ব!’
– ‘গর্ব?’
– ‘জানেন এবারে আমাদের স্কুলে আপনার একটা নাটক হয়েছে?’
– ‘ও আচ্ছা!কোনটা?’
– ‘ফাল্গুনী।’
– ‘ও বেশ বেশ!ওটা তো প্রায় হয়ই না।ওই তো সেই ঘুরে ফিরে এক নাটক গুলোই করে।তা এটা কেমন লাগলো?’
– ‘দারুণ!স্কুলের বড়ো দাদারা দারুণ নেচেছে গেয়েছে।ভীষণ কালারফুল!’
– ‘শুধুই সেই জন্য ভালো লাগলো!বাকিটা?’
– ‘বাকি!সেটা আবার কি?’
– ‘না বলছি যেটা বলতে চেয়েছিলুম!সেটা বোঝা গেছে?’
– ‘হ্যাঁ!’
শুনেই বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ – বললেন,’কি বুঝলে?’
– ‘ওই তো বসন্ত উৎসব ।’
– ‘ও আচ্ছা! শুধু ওইটুকুই বুঝেছো!’
– ‘আরও কিছু আছে নাকি?তবে আপনিই বুঝিয়ে দিন!’
– ‘না না, সেই সোনার তরী’র থেকে বুঝিয়েই আসছি,কেন যে সবাই ক্যালেন্ডার মিলিয়ে কবিতা পড়ে নাটক দেখে?’
বারবার বলতে লাগলেন,’কেন?কেন?’
কিন্তু কারণ কিছুই বুঝলাম না!তারপর কিছুক্ষণ জানলার বাইরে তাকিয়ে বসে থাকলেন,এখন কি বলা উচিৎ কিছুই বুঝতে পারছি না।কিছু ভেবে না পেয়েই,বলে ফেললাম,’আপনি ভারতের প্রথম নোবেল পাওয়া মানুষ – আমাদের সকলের গর্ব!’
– ‘তাই গর্ব!এমনি না?’আবার জানলার বাইরে চোখ চলে গেল রবীন্দ্রনাথের।
সেই নিস্তব্ধতার মধ্যেই তারপর হঠাৎ বললেন,’আমি কেন প্রথম কবিতা লিখেছিলুম জানো?’
– ‘কবি হবেন বলে তাই!’
– ‘নাঃ!নতুন বৌঠান কে দেখিয়ে দিতে চেয়েছিলুম আমি বিহারীলালের চেয়েও ভালো লিখতে পারি – ভগ্নহৃদয়ও তো তাকেই উপহার দিলুম;তুমি পড়েছো ওটা?’
– ‘না মানে – ওটা কি?’
– ‘ও, পড় নি।সত্যিই আমার কটা লেখাই বা লোকে পড়ে!’
– ‘না, না।এমন কেন ভাবছেন?আপনার কত গান; কত কবিতা!’
– ‘আমি তো আরও লিখেছিলুম!টিকলো কই?’
বুঝলাম ওপারে গভীর দীর্ঘশ্বাস পড়লো।
– ‘গল্প পড়েছি একটা আপনার – বলাই, স্কুলে পড়িয়েছে।’
– ‘ও।আর স্কুলে না পড়ালে?’বলেই হেসে উঠলেন।তারপর আবার বললেন,’জানো ওই গল্পটা আমারও বেশ লাগে।নিজেকে খুঁজে পাই।’
কথার পিঠে কথা এগোচ্ছে।কিন্তু হঠাৎ টের পেলাম হাওয়াটা বন্ধ হয়ে গরমটা যেন আরও বেড়ে গেল।তবু রবীন্দ্রনাথ নির্বিকার। বলে উঠলেন,’কত লোকে আমায় ব্যঙ্গ করে – জানো!’
আমি এর উত্তরে কি আর বলি – আমতা আমতা করেই বললাম,’না মানে,আপনার খুব সম্মানই তো করে।কত রাস্তার নাম আপনার নামেই তো দেওয়া হয়েছে।দু দুটো মেট্রো স্টেশনের নাম আপনার নামে।গীতাঞ্জলিটাও তো আপনারই বইয়ের নাম।এছাড়া সারা বছর কত অনুষ্ঠান হয়।ফেসবুক জুড়ে আপনার নামে কত্তো পেজ আছে জানেন?কত গানের স্কুলে শুধু আপনারই গান শেখানো হয়।আর আপনার শান্তিনিকেতন তো আছেই!’
– ‘আমার শান্তিনিকেতন?সে আর আমর নেই গো!কি ভেবেছিলাম;আর কি হলো!আর মেট্রো স্টেশন তো আমি হতে চাই নি?তবে কেন ওরা আমায় সবাই এমন করে পন্য বানিয়ে দিল।আমি আজ কেবল ব্যবসার অফুরন্ত পুঁজি!’
– ‘এমন করে কেন বলছেন?’
এরপর আমিই কথা ঘোরালাম,’আচ্ছা আপনি অনেক কিছু লিখেছেন না!মামাবাড়িতে দেখেছি আপনার নাম লেখা বই।’
– ‘হ্যাঁ! তা লিখেছি।নাটক,গল্প,উপন্যাস,প্রবন্ধ আর লিখেছি চিঠি – হাজার হাজার চিঠি।তোমরা এখন চিঠি লেখো না?’
আমার এবার হাসি পেয়ে গেল – বললাম,’না, না।এখন তো ফেসবুক আছে ওয়াটস্ অ্যাপ আছে আরও কত রকমের সোসাল মিডিয়া।দারুণ প্রগ্রেস।’
– ‘ও যন্ত্র সভ্যতার অগ্রগতি তাহলে অনেক দূর এগিয়েছে,তবে আমি প্রযুক্তির পক্ষেই ছিলুম বরাবর – কিন্তু কি জানো,মানুষ যা তৈরী করে তা যদি মানুষকেই দাসেই পরিণত করে, তবে সে প্রযুক্তি কিন্তু আত্মঘাতী হয়ে ওঠে,যাক এসব কথা।’
সত্যিই এতো ভারী কথা কিছুই মাথায় ঢুকছিল না।আমি আবারও প্রসঙ্গান্তরে গেলাম,’আচ্ছা!আপনার নোবেল তো চুরি গেছে,জানেন তো?’
– ‘জানি,আমি চুরি হয়ে গেছি!আমার আদর্শ চুরি হয়ে গেছে!ওই যে বললে গীতাঞ্জলি!লোকের কাছে ওটা আজ শুধুই মেট্রো স্টেশনের নাম!’
– ‘না, না।কত লোকে দেখতে আসতো।আমাদের কত বড় গর্ব।’
– ‘ও।ওটা শুধু সাজানোই থাকতো?’
বলেই আরও খানিকটা হতাশা জড়িয়ে আবার বললেন,’আচ্ছা, আমায় কি তোমরা কেবল সাজিয়েই রাখতো চাও?যেমন করে ঘরে ঘরে সাজিয়ে রেখেছো আমার বই!’
– ‘আমার বাড়িতে নেই -‘
– ‘তাও ভালো,সাজিয়ে রাখার থেকে না থাকা ঢের ভালো।’
কথা যত এগোচ্ছে রবীন্দ্রনাথ যেন ততই গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে।তাই একরকম ভরসা দিয়েই বললাম,’আপনি দুঃখ করবেন না।এখন আপনা কে নিয়ে অনেক ভালো কাজও হচ্ছে।কত ফিউশন।আমার তো দারুণ লাগে।নতুন নতুন সব কাজ।’
– ‘আমায় নিয়ে নতুন!আমার গুলো এক রাখলেই কি ভালো ছিলো না।এতো দেখি একদল আমাকে পুঁজি করে বসে আছে।আরেক দল উঠে পড়ে লেগেছে আমাকে ভাঙাচোরার কাজে।আচ্ছা,এই যে এখন যারা আমার গান গায় – ভীষণ সুন্দর!তাল ঠিক, সুর ঠিক।এক কথায় অপূর্ব!কিন্তু আমি যে সেই গানে নেই?’বলতে বলতে গলাটা যেন ধরে এলো।তারপর একটু থেমে বললেন,’যাক আমি তো মরেই গেছি!করুক যা খুশি।’
আমি বুঝলাম পরিস্থিতি আবার ভারি হয়ে আসছে।বললাম,’আচ্ছা, আপনি তো সেলিব্রেটি! আমায় একটা অটোগ্রাফ দেবেন -‘
কথাটা শুনেই চমকে উঠেই বললন, ‘অটোগ্রাফ!দেব -‘
এতক্ষণ কথা বলছি একটা কথা তো জিজ্ঞেসই করা হয় নি,হঠাৎ মনে পড়ায় করেই ফেললাম ‘আমি এখানে এলাম কি করে?’
– ‘আমি তোমায় ডেকেছিলুম।’
– ‘আমায় কেন?’
– ‘আমি দেখতে চেয়েছিলুম,তোমরা আমায় কতটা জানো।জানার মতো করে জানা।তোমাদের ওই কবিগুরু বিশ্বকবি গুলো বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কে রবীন্দ্রনাথের মতো করে কতটা জানো।যেখানে আমি বাঙালির ঠাকুর নই।আমিও একজন মানুষ।’
খেয়াল করলাম,জানলার বাইরে অন্ধকারের ঘনত্ব হালকা হয়ে আসছে – ভোর হচ্ছে – রবীন্দ্রনাথ বললেন,’আমায় এবার উপাসনায় বসতে হবে,দাঁড়াও তোমার অটোগ্রাফটা -‘
কথাটা আর শেষ হলো না।মা ডাকছে।ঘুমটা ভেঙে গেল।জোড়াসাঁকো যেতে হবে।স্নান করতে হবে।মনে পড়ে গেলো আজ তো পঁচিশে বৈশাখ!সদ্য ঘুম ভাঙা চোখে হঠাৎ মনে হলো যা কিছু দেখছিলাম সব স্বপ্ন!স্বপ্নেই রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন!
মনের মধ্যে শুধু একটা কথাই বারবার ঘুরতে লাগলো,’তোমাদের ওই কবিগুরু বিশ্বকবি গুলো বাদ দিয়ে রবীন্দ্রনাথ কে রবীন্দ্রনাথের মতো করে কতটা জানো।’
নাঃ! আর দেরি করা যাবে না – মা তাড়া দিচ্ছে, আমি স্নান করতে চলে গেলম।
বেশ হয়েছে লেখাটা
LikeLike
আহা বেশ
LikeLike
khub e sundar…….!!!!!! jnake bandhu bhable jini samasta dukkho-kasto ,jiboner sob otha-poray amader hat dhore par koriye dite paren… tnake amra sudhu pujor ason e bosiachiiiiii……
LikeLike
akta natun chinta….best valo jotne rakhaar moto bisay
LikeLike