প্রিয় অভিমান,
তোকে চিঠি লেখার কোনো প্রয়োজন পড়ে নি কোনো দিন – কারণ সে সম্পর্ক আমাদের ছিল না; আর যাও বা ছিল তাতে করেও এখন কেই বা আর চিঠি লেখে; তবু এই কথা গুলো চিঠিকেই মানায়। যেমন মৃণালের চিঠি মনে আছে? না না, আমি সে সব একদম লিখছি না। শুধু সাধ হল লিখি দু’এক কলম তাই আর কি!
সত্যিই আমরা যে ঠিক কত দিনের পরিচিত তা যে কোন ঘড়িটা ঠিক হিসেব করে রেখেছে কে বলতে পারে? কবে থেকেই তো রয়েছি অতো নম্বর অমুক বাবু সরণি তে। একই অটোর লাইনে দাঁড়িয়ে একই বাসের পিছনে দৌড়ে নটা-দশটার লেট মেট্রোয় প্রতিদিন কিছুটা গুঁতিয়ে আর নিজে কিছুটা গোঁতানি খাওয়া জীবন নিয়ে।
জানিস, অনেক কিছু ভাবতাম ওই ভিড় ওই ব্যস্ততার মধ্যেও – ভাবা প্র্যাকটিস করতাম। ওই সমস্ত কিছুর মধ্যে থেকে নিজেকে খুব আলাদা মনে হতো। ফেসবুক আছে, ওয়াটস্অ্যাপ আছে, গান-গল্প-আড্ডা, প্রেমে পড়া, প্রেম ভাঙা, ক্রাশ খাওয়া, চেক-ইন, চেক-আউট আছে, ক্যামেরার ফোকাস, এক্সপোসার, ফিল্টার এডিটিং আছে, কবিতা আছে, এমনকি রাস্তা ঘাটের মাপামাপিও আছে, এই সব নিয়ে আমরা তো ভালোই ছিলাম তাই না! সাদা চোখে এটাই তো জীবন বল ! এছাড়া আর কি বা আছে !
এখন লিখতে বসে ভাবছি, আগে কার দিনে সব সই পাতাতো না ! সে রকম একটা নাম যদি তোকে দিতুম, তো আজ চিঠি টা লিখতে সুবিধা হতো – তবে ক্ষতি নেই কাছাকাছি ছিলাম যখন দিই নি তো কি হয়েছে – আজ দূরে এসে দিলুম না হয়… অভিমান, কিরে পছন্দ তো ?… যাক পছন্দ না হলেও কিছু একটা বলে তো সম্বোধন করা চাই, তাই এই নামটাই একটু সয়ে নিতে হবে ভাই।

যখন আমাদের শহরে একসাথে হাওড়া ব্রীজের সেই আলো জ্বলা সন্ধ্যে গুলো আর শেষ রাতে রাস্তার এক এক করে নিভে আসা আলোর ভোর গুলোর থেকে অনেকটা দূরে এসে এই বেনারসের ঘাটে দাঁড়িয়েছিলুম, তখন বুঝলুম আমাদের ঠাস বিনুনী জীবনটার বাইরেও আরও একটা ভারতবর্ষ আছে রে, যেখানে সূর্য গঙ্গার তীরের মন্দিরে চূড়ার উপর দিয়ে উঠে মসজিদের মিনার ছুঁয়ে অস্তাচলে যায়। বেনারসে দেখলাম জানিস বিশ্বনাথ মন্দিরের পাশেই আছে একটা মসজিদ – একদিন তো শুনলাম অবধি, মসজিদের আজান আর মন্দিরের ঘন্টা একই সাথে বাজছে।
কবে সব ভাগ হয়ে গেছে বল ? আজও সবাই পারলে আরও ভাগ করে দেয়। কিন্তু জানিস, এই যে কাশীর অন্নপূর্ণা তিনি নাকি বলেছিলেন, তিনি সবার কাছে সমান – চাঁদ-সূর্য সবার কাছে যেমন তিনিও নাকি ঠিক তেমন। এটা ভাবলেই মনে হয় সত্যিই তো ওনার হাতে তো কোনো অস্ত্র নেই, আছে শুধু দিতে চাওয়ার অঙ্গীকার। আমরাই শুধু নিতে পারলুম না রে !
কাশীর ঘাটে আবার কি দেখলুম জানিস একটি মঙ্গলীয়ান ছেলে, মুখশ্রী দেখে মনে হলো চীনা জাপানী হবে, অপরিচিত ভাষায় এই বিদেশ বিভুঁয়ে ভিক্ষে করছে… মনে পরে গেল রবি ঠাকুরের ভারততীর্থ কবিতাটা। আর মনে মনে একটা বিশাল ছুটি মঞ্জুর করে দিলাম।

সময়-ঘন্টা-দিন-ক্ষণ দিয়ে মাপা বেড়াতে যাওয়ার ছুটিটা তো শেষ হয়েছে ঠিকই ! কিন্তু মনে মনে একটা বিশাল ছুটি নিয়ে ফিরেছি জানিস… যেখানে আমি, বহু জনতা মাঝখানে অপূর্ব একা।
তাই তোকেও আমি ছুটি দিয়ে এসেছি গঙ্গায় ভাসানো প্রদীপের সাথে… ভালো থাকিস… বন্ধু… সেই ভারতবর্ষটা খুঁজে পেলে হয়তো তখন সেই মেট্রোর বহু জনতার ভিড়ের অপূর্ব একাকীত্বের মধ্যেই আবার দেখা হয়ে যাবে কোনো একদিন… ততো দিনের জন্যে বাকিটা তোলা থাকলো, কেমন ?
ইতি
তোর ছুটি।