সাহিত্যের মতাদর্শ – রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনা – অভিজিৎ পাল

প্রতিটা মানুষেরই কিছু না কিছু মতাদর্শ থাকে , যা সাধারণ হতে পারে আবার বিশেষও হতে পারে ।এই মতাদর্শ তৈরি হয় তার বেড়ে ওঠা , পারিপার্শ্বিক পরিবেশ , রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া ইত্যাদির ফলে। সুতরাং একটি লোক যখন তার লেখা লিখতে বসেন বা রচনা করেন , ভিতরে ভিতরে তার এই এতদিনের আহরণ করা মতাদর্শগুলো রয়ে যায় , যা তার রচনার ছত্রে ছত্রে প্রতিফলিত হতে থাকে।রবীন্দ্রনাথের “স্ত্রীর পত্র” গল্প অনুসারে এটা বোঝার চেষ্টা করবো যে মতাদর্শ কি আদৌ লেখকের ব্যক্তিগত মতাদর্শের উপর নির্ভর করে থাকে নাকি তা এক বৃহৎ পাঠকগোষ্ঠীর কাছেও তার মেলবন্ধন খুঁজে পেতে চায়?

   অনেক ক্ষেত্রেই আমরা এই ভুল করে থাকি যে লেখক বা কবি যে রচনাটি লেখেন তার সঙ্গে তাঁর জীবনের সরাসরি সম্বন্ধ স্থাপনের চেষ্টা করি। এটা অবশ্যই মনে রাখা উচিত যে যিনিই রচনা করুন না কেন , তাঁর রচনাটি পরিপূর্ণতা পাওয়ার পর তিনি যখন তা পড়েন – তখন তিনি আর লেখক হিসেবে পড়তে পারেন না, এক পাঠকের দৃষ্টিভঙ্গিতেই পড়েন।আলাদা কিছু ভাবাদর্শ ,মতাদর্শগত ‘বিধি’ যা তিনি ব্যক্তিজীবনে মেনে চলেন বা চলতে বাধ্য হন , রচনার ক্ষেত্রে তা নাও মেনে চলতে পারেন।সেই সামাজিক মতাদর্শগুলোর বিপরীতে গিয়েও তিনি রচনা করতে পারেন।তাহলে কি গল্পের লেখক আর গল্পের কথক আলাদা হয়ে যাচ্ছেন না?

  “স্ত্রীর পত্র” গল্পটি এর একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।এই গল্পটি উত্তমপুরুষে লেখা একটি গৃহবধূর বয়ান।যে তার শ্বশুরবাড়ি ত্যাগ করে গেছে তীর্থক্ষেত্রে।তাহলে আপাতত এটি পরিস্কার যে এই গল্পের কথক এক নারী, যে তার জীবনের জমে ওঠা সমস্ত বক্তব্য প্রেরণ করছে তার স্বামীর কাছে এক চিঠির মাধ্যমে।তাই সরাসরি গল্পের কথকের সাথে গল্পের মিল খুঁজতে যাওয়াটাই অযৌক্তিক! তাছাড়া লৈঙ্গিক ভাবেও তারা আলাদা।

  রবীন্দ্রনাথের নারীভাবনা বহুচর্চিত একটি বিষয়।নারীভাবনার অন্যতম একটি অভিপ্রায় , যা রবীন্দ্রনাথের গল্পে বার বার ফিরে এসছে, তা হল প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে নিজের বিদ্রোহ ঘোষণা, তৈরি করা সামাজিক কুসংস্কার ও আইনের বিরুদ্ধে নিজের বিদ্রোহী অবস্থান- যা বিভিন্ন ধরণের প্রতিবাদের ভাষা নিয়ে উদ্যত হয়ে ক্ষেত্রবিশেষে নিজমূর্তি ধারণ করেছে। স্ত্রীর পত্রের মৃণাল চিঠিতে শুরুতেই বলেছে –“ আজ পনেরো বছর হল আমাদের বিবাহ হয়েছে , আজ পর্যন্ত তোমাকে চিঠি লিখিনি…”। বরাবর রবীন্দ্রনাথ দাম্পত্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তার বিভিন্ন গল্প , উপন্যাস, নাটকে ।মৃণাল চিঠির প্রথমেই পনেরো বছর নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে কেন? কারণ এতো বছর যাপনটা কতটা নিষ্ফল আর অনর্থক –এই দীর্ঘ মেয়াদে তা মনে করিয়ে দিতে চেয়েছে- সেখানে ‘ মুখের কথা অনেক শুনেছ , আমিও শুনেছি – চিঠি লেখবার মতো ফাঁকটুকু পাওয়া যায়নি…”।

  অর্থাৎ এই দাম্পত্যের মাঝে কেবল কতগুলি ধারাবাহিক নিয়ম মেনে চলাই ছিল , গতানুগতিকতার বাইরে গিয়ে সেখানে একটা চিঠি লেখার “ফাঁক” পাওয়া যায়নি।তার মানে ফাঁকটুকু সে বরাবর চেয়ে এসছে ,কিন্তু নিয়মের বাইরে বলে তার প্রকাশ লজ্জিত।মৃণাল শিক্ষার জন্য আগ্রহী, সে বুদ্ধিমতী । কারণ সে বলছে “  মাঝে মাঝে লুকিয়ে কবিতা লিখতুম , সেখানে তোমাদের অন্দরমহলের পাঁচিল ওঠেনি। আমি যে কবি…” এখানে আমাদের “খাতা” গল্পের উমার কথা মনে পড়ে। বিবাহের পর সে তার প্রিয় খাতাকে ছাড়তে পারে না , লুকিয়ে লুকিয়ে লেখে এবং অবধারিতভাবে সে তার স্বামীর ক্রোধের শিকার হয়। সুতরাং তাহলে এটা কার নৈতিক অবস্থান বলব? লেখকের না কথকের ? মৃণালের মতাদর্শ আর রবীন্দ্রনাথের মতাদর্শ কি এক? লেখক আর কথক দুটি আলাদা সত্ত্বা, সেখানে মাঝে এক সেতুনির্মাণ চলে ক্রমাগত। নারীশিক্ষার প্রতি লেখক সদর্থক কণ্ঠস্বর তুলেছেন, কিন্তু তাঁর এক মৃণালের সাহায্য লাগে, আর যখনই লেখকের মৃণালের সাহায্য লাগে তখনই তার অন্য এক সত্ত্বা তৈরি করতে হয় যার লিঙ্গ ভিন্ন , মতাদর্শও কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। নাহলে চরিত্রের স্বাতন্ত্র প্রকাশ পাবে না।

  তাহলে এখানে পাঠক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে ? পাঠক দাঁড়িয়ে রয়েছে বিচার , বুদ্ধি, যুক্তি ও ঘটনার নিরীক্ষণে।আবার পাঠকের সাথে লেখকের মতাদর্শ , পাঠের মতাদর্শেরও এক পরীক্ষা চলে। কারণ লেখকের চিন্তা , তাঁর পাঠে প্রকাশ আর পাঠকের কাছে গিয়ে পৌঁছান তিনটে আলাদা হতেই পারে।রক্ষনশীল পাঠকসমাজ মৃণালের জেহাদ ঘোষণাকে কখনোই মেনে নেবে না। তারা  দোষ দেবে লেখককে। এটা অবশ্যই মনে রাখা উচিত যে এটা ‘স্ত্রীর পত্র’- মৃণালের পত্র না।অর্থাৎ লেখক কেবল একটি নারীর অবস্থান দেখাচ্ছেন না , এই মৃণালের বক্তব্যের মাধ্যমে আসলে সমস্ত ‘স্ত্রী’ জাতিরই প্রতিনিধিত্ব বোঝাতে চেয়েছেন।ঘটনা বিবরণ ধারাবাহিকতা নির্দিষ্ট হতে পারে , কিন্তু তাতে ফিরে ফিরে আসা মৃণালের মন্তব্য নারীর অবস্থান নিয়েই প্রশ্ন তোলে। তার কয়েকটা দৃষ্টান্ত দেখে নেওয়া যাক-

-“ মেয়েমানুষ কে দুঃখ পেতেই হবে এটা যদি তোমাদের ব্যবস্থা হয় তাহলে যতদূর সম্ভব তাকে অনাদরে ফেলে রাখাই ভালো । আদরে দুঃখের ব্যথাটা কেবল বেড়ে ওঠে।’

-“ রূপ জিনিসটাকে যদি কোনো সেকেলে পন্ডিত গঙ্গামৃত্তিকা দিয়ে গড়তেন , তাহলে ওর আদর থাকত।কিন্তু ওটা যে বিধাতা কেবল আপন আনন্দে গড়েছেন , তোমাদের ধর্মের সংসারে তাই তার কোনো দাম নেই।”

-“মৃণাল মেয়ে কিনা তাই ও বাঁচল , বেটা ছেলে হলে কি আর রক্ষা পেত । চুরিবিদ্যাতে যম পাকা , দামি জিনিসের পরেই তার লোভ। আমার মরণ নেই।”

-“মা আমার এই বুদ্ধিটার জন্যে ভীষণ উদ্বিগ্ন ছিলেন, মেয়েমানুষের পক্ষে এ এক বালাই।যাকে বাধা মেনে চলতে হবে সে যদি বুদ্ধিকে মেনে চলতে চায় , তাহলে ঠোকর খেয়ে খেয়ে তার কপাল ভাঙবেই।”

-“আঁতুড়ঘরে মরণ মাথার কাছে এসে দাঁড়ালো , মনে ভয়ই হল না। জীবন আমাদের কীই বা যে মরণকে ভয় করতে হবে।…বাঙালি মেয়ে তো কথায় কথায় মরতে চায়!”

-“ অনাবশ্যক আবর্জনা ঘরের আসেপাশে অনায়াসে স্থান পায়, কিন্তু অনাবশ্যক মেয়েমানুষ যে একে অনাবশ্যক তার উপর তাকে ভোলাও শক্ত । সেইজন্য আস্তাকুঁড়েও তার স্থান নেই।”

    এইরকম অসংখ্য দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে , তার মধ্যে কয়েকটা নির্দেশ করা গেল।বাক্যের যতটুকু দৃষ্টান্ত দেখা গেল, তাতে শুধু সে নিজের ক্ষোভ এর কথা উল্লেখ করেনি , বার বার তার সাথে জুড়ে নিয়েছে “মেয়েমানুষ” শব্দটিকে ।এই অন্যায় অবিচারের প্রতি তীব্র ধিক্কার জানিয়েই অভিযোগগুলো ব্যক্ত করেছে।নিজের করুণ পরিস্থিতির মধ্যে সমগ্র “মেয়েমানুষ” দের বার বার যুক্ত করে নিয়েছে সে “বিশ্বসংসারের” মধ্যে।যেন সে নিজেই সাহস নিয়ে এই দীর্ঘকালীন পুরুষতান্ত্রিক বেড়াজালের মধ্যে আবদ্ধ অসহায় নারীদের প্রতি কর্তব্য পালন করছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে এই সামাজিক মতাদর্শের কাঠামোগুলো ভাঙছে। তাহলে এই মতাদর্শ কার?

    রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিজীবনের দিকে যদি তাকানো যায় , তাহলে দেখব  তার কোনো মেয়ের বিয়েই সুখের হয়নি এবং তাদের দাম্পত্যও ভালো ছিল না।যেখানে রবীন্দ্রনাথ নিজে নারীভাবনায় এতো প্রগতীশীল সেখানে নিজের মেয়েদের তিনি অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়েছেন , বিয়ের জন্য পণও দিয়েছেন প্রথা মেনে। ঠাকুরবাড়ি ছিল প্রচণ্ড পরিমানেই রক্ষণশীল।সেখানেও দীর্ঘকাল ‘ অন্দরমহল’ নামক অন্দরের মধ্যেই গৃহবধূদের আবদ্ধ থাকতে হয়েছে।গঙ্গাস্নানের সময় পালকিসমেত ডুবিয়েই আবার তুলে আনা হয়েছে ইত্যাদি অনেক উদাহরণ রয়েছ।এই প্রথা ভাঙছেন আস্তে আস্তে জ্ঞানদানন্দিনী দেবী , কাদম্বরী দেবীরা। কিন্তু স্বাধীনতার পদক্ষেপগুলো অতটা সহজ ছিল না । জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ,সত্যেন্দ্রনাথদের যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছিল দেবেন্দ্রনাথের উপস্থিতিতে।

তাহলে কি রবীন্দ্রনাথ সামাজিক মতাদর্শকে বিদ্রোহ করে তা মৃণালের মধ্যে সঞ্চারিত করে দিলেন? নিজের জীবনে তো তিনি কন্যার বিবাহ ক্ষেত্রে পণ দিয়েছেন তাহলে ‘দেনাপাওনা’ গল্পের মধ্যে লেখকের এই পণপ্রথার বিরোধীতা কেন দেখতে পাই? সব সময় লেখক যে আঙ্গুল দিয়ে নির্দেশ করে দেবেন এমন নাও হতে পারে, সাধারণ ঘটনা বর্ণনার মাধ্যমেও তিনি নিজের মতামত জানাতে পারেন আবার উল্টোদিকের বর্ণনা দিয়েও তা করতে পারেন।মানে লেখক যে সবসময় গোয়েন্দা গল্প , গোয়েন্দা বা পুলিশের বয়ানে বা দিক থেকে রচনা করবেন এমন নাও হতে পারে –এক আসামীর দৃষ্টিভঙ্গি থেকেও তা রচিত হতে পারে। যাই হোক রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে’ –কিন্তু একেবারেই কি পাওয়া যায় না? তার জীবনের চিন্তাকে কি একেবারে বাদ দিয়ে চলে যাওয়া যায় , সাহিত্যের ক্ষেত্রে কি লেখকের প্রত্যক্ষ ছাপ থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে , তিনি শিল্পগত উপস্থাপনায় তা অন্য মাত্রা দিতে পারেন।

তিনি “চিত্রাঙ্গদা”কে বীরাঙ্গনা হিসেবেই তৈরি করছেন।সে বলেছে মদনদেবকে –

“তোমার রণজয়ের অভিযানে

তুমি আমায় নিয়ো

ফুলবাণের টীকা আমার ভালে

এঁকে দিও!

আমার শূন্যতা দাও যদি

সুধায় ভরি

দিব তোমার জয়ধ্বনি

ঘোষণ করি…”

লক্ষ্য করার বিষয় চিত্রাঙ্গদা মদনদেবের কাছে প্রার্থনা করআর সময় যেন শর্ত রাখছে , যে মদনদেব যখন রণজয় করতে যাবেন , তখন যেন তিনি তাকেও সাথে নেন। কারণ সে যুদ্ধে পারদর্শী।তার বদলে মদন্দেব যেন প্রেমের ফুলবাণের টীকা পরিয়ে দেন।এ ছাড়া আরও বলছেন যে এই শূন্যতা যদি মদনদেব পূর্ণ করে দেন তাহলে , তাহলে চিত্রাঙ্গদা চারদিকে মদনদেবের ‘জয়ধ্বনি’ ঘোষণ করে দেবে।তাঁর এই শর্তে কি একটি পরোক্ষ উক্তি থেকে যায় না যে , মদনদেব যদি এই শূন্যতা পূরণ করে না দেন তাহলে সে চারদিকে ‘কুৎসা’ রটিয়ে দেবে , ঠিক যেমন কেকয়ী করেছিলেন? কেকয়ী রাজমাতা আর সে মণিপুরনৃপদুহিতা! আর নাটকের শেষে রবীন্দ্রনাথ দুবার “বীরাঙ্গনা” শব্দটি ব্যবহার করেছেন।  “আজ পরিবে বীরাঙ্গনার হাতে দৃপ্ত ললাটে…

আজ পরাবে বীরাঙ্গনা তোমার দৃপ্ত ললাটে

সখা বীরের বরণমালা…”

তাহলে লেখকের চিন্তা অন্য কোনো লেখকের কাছে থেকেও আসতে পারে।রবীন্দ্রনাথ মাইকেলে কাব্যিক প্রতিফলনে মতাদর্শে কতটা প্রভাবিত হলে এই বিপুল পরিমাণ ঋণগ্রহন করেন।উনিশ শতকে যে নারীরা গৃহ ত্যাগ করে নিজের বক্তব্য জানিয়ে চলে গেল চিঠি লিখে, বিশ শতকে এসে মৃণালও তাই করলো।বিবাহের পর শত লাঞ্ছনা,অপমান,পরাধীনতা,প্রবঞ্চনা পেয়েও নারীরা শ্বশুরবাড়ি মুখ বুজে আঁকড়ে পরে থাকবে,এই ছিল ভবিতব্য।কারণ তাদের বাঁচার জীবনধারনের আর কোন রাস্তা খোলা ছিল না।সেই সময়ের নারী হয়েও মৃণাল নিজের শ্বশুরবাড়ি,এমনকি নিজের স্বামীর পরিসরটুকুকেও অস্বীকার করছে।কোন বাড়ির বউই বাড়ি থেকে বেরোনোর অনুমতি ভিক্ষা ছাড়া বেরোতে পারত না।মৃণাল সেখানে বলেছে –

“কিন্তু, আমি  আর তোমাদের সেই সাতাশ-নম্বর মাখন বরালের গলিতে আর ফিরবো না…সংসারের মাঝখানে মেয়েমানুষের পরিচয়টা যে কি তা আমি পেয়েছি। আর আমার দরকার নেই।”

সে তার শ্বশুরবাড়িকে, ওই গলিকে আর ভয় করে না,বিন্দুর মৃত্যুর মধ্যে জীবনের জয়পতাকার চিহ্ন সে দেখেছে।সে ব্যাঙ্গ করে বলেছে যে মৃত্যুর নাটকের তামাশাটা যে কেবল বাঙালি মেয়ের শাড়ির উপর দিয়েই কেন? বাঙালি বীরপুরুষের কোঁচার উপর দিয়ে হয় না কেন?সমাজের চিরস্থায়ী প্রথাকেই এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিএছে।সে এও বলেছে যে তার স্বামী যেন ভয় না করে কারণ –‘তোমরা ভাবছ মরতে যাচ্ছি? অমন পুরোনো ঠাট্টা…’ সে করবে না। জীবন মৃত্যুর এই লড়াইয়ে সে  শেষ পর্যন্ত লেগে থাকবে।একা।

মধুসূদনের পর আর কেউ সাহস করেননি , সমস্তকে প্রত্যাখ্যান করে ,একটি গৃহবধূকে বাড়ির বাইরে নিয়ে যাওয়ার।মৃণাল এই পনেরো বছরের জীবনকে ধিক্কার দিয়ে বলে-‘কোথায় রে তোমাদের রাজমিস্ত্রির গড়া দেয়াল, কোথায় রে তোমাদের ঘোরো আইন দিয়ে গড়া কাঁটার বেড়া …”। এক স্ত্রীর যে যে বাঁধা নিয়ম মেনে চলার দিনলিপি তৈরি করে দেয় সমাজ , তৈরি করে দেয় পরিবার –তাকে সমস্ত স্ত্রীজাতির প্রতিনিধি হয়ে দাঁড় করাচ্ছেন লেখক- “ তোমার এমন ভুবনে আমার এমন জীবন নিয়ে কেন ওই অতি তুচ্ছ ইটকাঠের আড়ালটার মধ্যেই আমাকে তিলে তিলে মরতেই হবে।”এখানে আমাদের “মানসী” কাব্যগ্রন্থের ‘বঁধু’ কবিতার কথাও মনে পড়বে।

‘শ্রীচরণকমলেষু’ লিখে সে এই চিঠির সূচনা করেছিল, তা শেষে গিয়ে হল ‘তোমাদের চরণতলাশ্রয়ছিন্ন’। মৃণাল অর্থাৎ পদ্মের ডাঁটের উপর পদ্মফুল অবস্থান করে কিন্তু সেই কমলস্বরূপ চরণে সে আর আশ্রিত নয়,পদ্মের মৃণালের মতো সরলরৈখিক তার জীবন। রবীন্দ্রনাথের এই গল্পে নারীর মুক্তির যে মনোভাব তা তাঁর দাদা সত্যেন্দ্রনাথের সাথেও মিলে যায়।সত্যেন্দ্রনাথের মতে-

“আমাদের অন্তঃপুরে যে কয়েদখানার মত নবাবী বন্দোবস্ত ছিল তা আমার আদবে ভাল লাগত না।”নারীশিক্ষার এই বীজ অনেক আগেই দানা বেধেছিল ঠাকুরপরিবারের সদস্যদের মনে।        

যদি সমগ্র ‘চণ্ডালিকা’ লক্ষ্য করা যায় তাহলেও দেখব অন্যতম প্রতিবাদ।রবীন্দ্রনাথ এবার সমাজের প্রান্তজ নারীর দিকে ফিরলেন।চণ্ডালের কন্যা প্রকৃতি নিজের অবস্থানের প্রতি প্রশ্ন করে তার মাকে বলে-

“কেন দেব ফুল আমি তারে

যে আমারে চিরজীবন রেখে দিল

এই ধিক্কারে’।

অর্থাৎ সমাজের নিম্নে অবস্থিত,বঞ্চিত এক নারী দেবতাকে পূজো দিতেই অস্বীকার করছে।কারণ দেবতার দ্বারা তো সমান অধিকার পায়নি,তাই মাকে বলে-‘একি ঘোর অন্যায়’।তার বক্তব্য দেবতার কাছে কেন ভক্ত সব সময় তার পূজো নিয়ে উপস্থিত হবে?দেবতাকেও নেমে আসতে হবে ভক্তের কাছে পূজো নিতে।শীর্ষ অংশ থেকে নীচে নেমে দেখতে হবে সেই ‘প্রকৃতিদের’ কি কস্ত,কি দুঃখ,কত সাধনা,স্বপ্ন নিয়ে তারা পূজো নিবেদন করে,কিন্তু বিচার কি পায়?নিজের সামান্যতম,ক্ষুদ্রতম ইচ্ছাপূরণ করতে গিয়ে সে সমাজের কাছ থেকে বঞ্চিত –“ওকে ছুঁয়ো না ছি!

ও যে চণ্ডালিনীর ঝি!—

নষ্ট হবে যে দই

সে কথা জানো না কি!”

আবার নিজের কাঙ্ক্ষিত পুরুষকে মায়ের মন্ত্রের দ্বারা মায়াবলে টেনে আনতে উদ্যত হয়,কারণ একবার তাকে আনন্দ নতুন জীবন দান করে আর দেখা দেয় নি কান,রবীন্দ্রসঙ্গীতের কথায় প্রকৃতির ব্যথা যেন বেজে ওঠে-

‘আমায় পরশ করে

প্রাণ সুধায় ভরে

তুমি যাও যে সরে’                                                 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আনন্দ সেই মন্ত্রের দ্বারা পরাজিত হয়ে যখন ধরা দিতে আসে তখন প্রকৃতি বলে-( গদ্যনাট্য চণ্ডালিকা)-‘প্রভু তুমি আমাকে উদ্ধার করতে এসেছ।আমি তোমাকে আমি নীচে নামিয়ে এনেছি,তুমি আমাকে উপরে টেনে তুলবে’।অর্থাৎ এক নারী তার অবস্থান কে প্রত্যাখান করছে,অস্পৃশ্যতার প্রতি গর্জে উঠছে এবং প্রভুকে শেষ পর্যন্ত নীচে নামিয়ে এনেছে।কারণ প্রভুর স্থান সব সময় শুদ্ধতায়, আর প্রভু যদি ভক্তকে না দেখে চলে জান তখন তাকে টেনেই নিয়ে আসতে হয়।প্রকৃতিও এবার সেই প্রশান্তির সাধনায় এক সাথে ব্রতী হবে।নিম্নবর্গের প্রতিনিধি হয়ে সে দেবতাকে নামিয়ে আনছে সেই পরিসরে, এটি এক চণ্ডালের কন্যার পক্ষে সত্যি দুঃসাহসিক কাজ বটে!

মৃণালের ক্ষেত্রে এক অভিনব পদক্ষেপ দেখালেন লেখক ,সে শ্রীক্ষেত্রে সে বেঁচে থাকবে মীরাবাঈএর মতো সাধনা করে।–‘আমিও বাঁচবো,আমি বাঁচলুম।’

   এই বাঁচার জন্য ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে “মানভঞ্জন” গল্পের গিরিবালা।কতদিন বদ্ধ মহলে দম আটকে তিল তিল করে মরবে সে।তার স্বামী গোপীনাথ যথেচ্ছাচার, এমনকি তাকে টাকার জন্য প্রহার পর্যন্ত করে।সে তার বাঁচার আশা খুঁজে পেয়েছিল, প্রাণের আস্বাদ গ্রহণ করেছিল থিয়েটারের নায়িকা হওয়ার মধ্যে।এবং সে পর্যন্ত সে নায়িকা হয়েই জয়লাভ করে।এছাড়া যে ক্ষেত্র ছিল গোপীনাথের রাজত্ব প্রদর্শনের,বিনোদনের, আমোদের-সেই ক্ষেত্রের মধ্যমণি হয়ে দাঁড়ায় গিরিবালা।সেই রাজকীয় আভিজাত্যের পতন ঘটায় গোপীনাথের।পুলিসে ধরে নিয়ে যায় গোপীনাথকে।

   পুলিসে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের “শাস্তি” গল্পের চন্দরা কেও।কিন্তু সেখানে সে ছিল নির্দোষ ।তার স্বামী ছিদাম,দাদাকে তার নিজের বউয়ের হত্যার অপরাধ থেকে বাঁচাতে চন্দরাকে দোষী করে।এবং এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে চন্দরা ফাঁসিকাঠকে বরণ করে নেওয়ার মধ্যে। শেষ সংলাপে-“মরণ!–”এর মধ্যে আসলে ভালোবাসা, বিশ্বাস,মানবিকতার মরণকেও বোঝাতে চায় চন্দরা।স্বল্প কথায় কত দৃপ্ত প্রতিবাদের চিত্র ফুটে ওঠে তার চরিত্রে।

“সাধারন মেয়ে” কবিতার মালতীর মধ্যে,বারবার সে নিজেকে বলে-“ আমি অন্তঃপুরের মেয়ে” কিন্তু নরেশ সেন যে তাকে অবজ্ঞা করে ভুলে যায়।সেই অবহেলাকে অন্তঃপুরের মেয়ে হিসেবে মেনে নিতে পারে না।তাই শরতবাবুর লেখায় নিজের উচ্চস্থান দাবী করে,আর নরেশের বিলেতে সাত বছর ফেল-

                     “রাখো না কেন নরেশকে সাত বছর লন্ডনে

                      বারে বারে ফেল করুক তার পরীক্ষায়

                     …ইতিমধ্যে মালতী পাস করুক এম.এ

                             কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে,

                   গণিতে হোক প্রথম তোমার কলমের এক আঁচড়ে।”

    একটি নারীও যে প্রকৃত প্রশিক্ষণের সুযোগ সুবিধা লাভ করতে কোনো নরেশ সেনের থেকে কম কিছুতে হত না,এবং নরেশদের মত পণ্ডিত,ভুলে যাওয়া পুরুষদের উচিত জবাব দেওয়ার একটি পন্থা যে শিক্ষা, সেটিই বারবার মালতীর ইচ্ছায় বোঝা যায়। যে মেয়েরা ফরাসি জার্মানি না জেনে কাঁদতে জানে,তারা শিক্ষার দ্বারাই যোগ্য উত্তর দেবে বিলেত যাওয়া প্রেমিকের বেশধারী পুরুষদের।কিন্তু মালতী আবার ফিরে আসে-

“হায় রে সাধারন মেয়ে

                                     হায় রে বিধাতার শক্তির অপব্যয়”।

   শেষে যে এই হতাশা,তাতে আসলে তার এই বর্তমান অবস্থাটাকেই চিহ্নিত করে।এতক্ষণ সে কেবল স্বপ্নই দেখে গেছে,মালতীরা স্বপ্ন দেখে, পরবর্তী যুগের মালতীরা স্বপ্ন দেখে,পরবর্তী যুগের মালতীরা হয়ত সেই স্বপ্নের পরিণতি দিতেই এগিয়ে আসবে।মৃণালরাও তাদের ‘মেজোবউয়ের খোলস ছিন্ন’ করে বেরিয়ে যাবে।

লেখকের মতাদর্শ বদলায়, ঠিক যেমন করে রবীন্দ্রনাথের বিধিনিষেধে পরিপূর্ণ ‘ব্রহ্মচর্যাশ্রম’ পরবর্তীকালে বিশ্বের সাথে মিলিত হয়ে বিশ্বভারতী হয়ে ওঠে কিংবা ধর্মকেন্দ্রিক চিন্তায় তাঁর প্রবন্ধের ধারাবাহিকতা যদি দেখি প্রথমে-  ‘ধর্ম’ ,তারপর ‘আমার ধর্ম’, তারপর ‘মানুষের ধর্ম’ তারপর ‘মানুষ’(MAN)-অর্থাৎ মানুষ প্রধান হয়ে উঠছে।তাহলে বলা যেতে পারে-  সেভাবে মতাদর্শ কখনো একদেশদর্শীভাবে পালন করা যায় না- লেখক, পাঠ , বা পাঠকের মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে পরিবর্তনশীল।

চিত্রঋণ : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, NTDV.com, makemytrip.com, The Hindu.

কৃতজ্ঞতা : বঙ্গভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা

One Comment Add yours

  1. সুমিত মিত্র says:

    লেখাটা চমৎকার হয়েছে। ভাবনাটা খুবই মৌলিক। উপস্থাপনা নৈপুণ্যের পরিচয় পেলাম

    Like

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.