কথা ও সুরের ঐকান্তিক মিলনে সৃষ্টি হয় অনুভূতির এক নিবিড় ভাস্কর্য, যার নামই সঙ্গীত । এই সঙ্গীত জন্মদান করে গভীর আনন্দের, গভীর এক বোধের । এই আনন্দ এমনই, যা চারিপাশকে মালিন্যমুক্ত ক’রে অপার্থিব এক বোধ সঞ্চার করতে সক্ষম হয় । আর তখনই যেন সৃষ্টি হয় এক ঐশ্বরিক পরিবহ ।
বাংলাদেশের হাজার বছরের সারস্বত সাধনার শ্রেষ্ঠ প্রতিভূ, রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট সঙ্গীতেও আমরা এমন উদাহরণ দেখতে পাই । প্রসঙ্গতঃ ভাবতেই হয়, রবীন্দ্রগানে এই যে অনন্যতা, যে অসামান্য নান্দনিকতা তা কি কেবল গানের বানী রচনায় ? Lyric এ ? নাকি বাণী ও সুরের মায়াময় যুগ্মতার রহস্যে রবীন্দ্রগান এমন আশ্চর্য বৈভব পেয়েছে ? তার মধ্যে সঞ্চার করেছে এক অপার্থিব, এক অলৌকিক,এক অনির্দেশ্য প্রেরণাকে – যে প্রেরণার মধ্যে কখনও কখনও পরিদৃশ্যমান হয়ে ওঠে নিত্য জগতের মধ্যের স্বর্গীয় বাতাবরণটি । প্রসঙ্গক্রমে স্মরণ করতে হয় কীর্তন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য –
“ চৈতন্য যখন পথে বাহির হইলেন তখন বাংলা গানের সুর পর্যন্ত ফিরিয়া গেল । তখন এক কন্ঠবিহারী বৈঠকী সুরগুলো কোথায় ভাসিয়া গেল । তখন সহস্র হৃদয়ের তরঙ্গ হিল্লোল সহস্র কন্ঠ উচ্ছ্বসিত করিয়া নূতন সুরে আকাশে ব্যাপ্ত হইতে লাগিল । তখন রাগ রাগিণী ঘর ছাড়িয়া পথে বাহির হইল, একজনকে ছাড়িয়া সহস্রজনকে বরণ করিল । বিশ্বকে পাগল করিবার জন্য কীর্তন বলিয়া এক নূতন কীর্তন উঠিল । যেমন ভাব তেমনই তাহার কন্ঠস্বর – অশ্রুজলে ভাসাইয়া সমস্তকে একাকার করিবার জন্য ক্রন্দনধ্বনি । বিজন কক্ষে বসিয়া বিনাইয়া বিনাইয়া একটিমাত্র বিরহিনীর বৈঠকী কান্না নয়, প্রেমে আকুল হইয়া দীন আকাশের তলে দাঁড়াইয়া সমস্ত বিশ্বজগতের ক্রন্দনধ্বনি”।
অর্থাৎ কীর্তন সঙ্গীতের যে অন্তর্দর্শন তা রবীন্দ্রনাথের মননে গভীর প্রতিক্রিয়া সঞ্চার করেছিল একথা স্পষ্ট । তাঁর সৃষ্ট বেশ কিছু গানে এর নিদর্শন আমরা দেখতে পাই । যেমন এই গানটি –
“ গায়ে আমার পুলক লাগে চোখে ঘনায় ঘোর
হৃদয়ে মোর কে বেঁধেছে রাঙা রাখীর ডোর ?
আজিকে এই আকাশতলে জলে স্থলে ফুলে ফলে
কেমন করে মনোহরণ ছড়ালে মন মোর ?
কেমন খেলা হল আমার আজি তোমার সনে ।
পেয়েছি কি খুঁজে বেড়াই ভেবে না পাই মনে ।
আনন্দ আজ কসের ছলে কাঁদিতে চায় নয়নজলে
বিরহ আজ মধুর হয়ে করেছে প্রাণ ভোর ।

ঈশ্বরানুভূতি সম্পৃক্ত এই গানটিতে প্রতিটি ছত্রেই ব্যক্ত হয়েছে এক নিবিড় উপলব্ধির, এক চেতনাপ্রাপ্তির কথা। এমনই এক বিস্ময় ছড়িয়ে আছে গানের প্রতিটি চরণে।প্রতিটি মুহূর্তেই স্মরণ করিয়ে দেয় এক অপার্থিব চেতনাকে যেটি সকল কর্মকান্ডের নিয়ন্তা।সেই চেতনাপ্রাপ্তির আলোকচ্ছটায় আনন্দ রূপান্তরিত হয় অশ্রুজলে, বিরহের মধুর রসে পরিপূর্ণ করে তোলে প্রাণ।
শুধুমাত্র কীর্তন সম্বন্ধযুক্ত নয়, রবীন্দ্রগানের বহুধাবিভক্ত শাখায় এমন অসংখ্য গানের নিদর্শন পেশ করা যায়, যেখানে প্রস্তাবিত বিষয়টির স্বপক্ষে যুক্তি প্রদর্শিত হতে পারে। যেমন – গীতাঞ্জলি কাব্যের একটি বহুল পরিচিত গানের উল্লেখ করি।
“মেঘ বলেছে যাব যাব, রাত বলেছে ‘যাই’
সাগর বলে ‘কূল মিলেছে – আমি তো আর নাই’
দুঃখ বলে ‘রইনু চুপে তাঁহার পায়ের চিহ্নরূপে’
আমি বলে ‘মিলাই আমি আর কিছু না চাই’।।
ভুবন বলে ‘তোমার তরে আছে বরণমালা’
গগন বলে ‘তোমার তরে লক্ষ প্রদীপ জ্বালা’।
প্রেম বলে যে ‘যুগে যুগে তোমার লাগি আছি জেগে’
মরণ বলে। ‘আমি তোমার জীবনতরী বাই’।।
জীবন মৃত্যুর অন্তহীন চিরন্তন এক ক্রমাবর্তনের ছবি ফুটে উঠেছে এ গানে। গানটির প্রতিটি পংক্তি পৃথক ভাবে পাঠ করলে প্রকৃতির এক একটি দৃশ্যের প্রেক্ষাপট রচিত হয় মানসলোকে, যেখানে বলা হয়েছে প্রকৃতির সর্বত্রই এক চলিষ্ণুতা বা গতিময়তা প্রবহমান, তাই মেঘ বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে, রাত পেরিয়ে দিন আসে, সাগর নিঃশেষিত হয় বেলাভূমিতে। জীবনও মিলিয়ে যায় মৃত্যুর মাঝে। জীবনের অখন্ড এক প্রবহমানতা প্রতিমুহূর্তে আবর্তিত হচ্ছে আমাদের ঘিরে। সেখানে মৃত্যুও যেন জীবনকেই বহন করে নিয়ে চলেছে। জন্ম থেকে জন্মান্তরে। প্রেম যেমন যুগে যুগে মানুষের অভিজ্ঞতায় ধরা দেবার জন্য জেগে আছে তেমনি মৃত্যুও জীবনপ্রবাহকে প্রতিমূহূর্তে গতিময়তা দিচ্ছে।
এ গানে প্রচলিত কোনও আধ্যাত্মিকতা বা স্বর্গীয়তার অনুভব নেই, আছে মানবজীবন সম্পর্কে এক নিবিড় সত্যোপলব্ধি, এক জীবনধর্মী দার্শনিকতা। জীবনমৃত্যুর আবর্তছন্দে জীবনের যে নিবিড় আস্বাদনময়তা, তাও মৃত্যুর পরিবহেই সম্পূর্ণতা পায়। আমাদের প্রতিদিনের তুচ্ছতা, মালিন্য, স্বার্থান্ধতার বাইরে, এ গান যে সত্যপোলব্ধির স্তরে আমাদের পৌঁছে দেয় সেখানে আলাদা করে দুঃখ বা আনন্দচেতনা নয় এক গভীর রাবীন্দ্রিক উপলব্ধি আমাদের উত্তীর্ণ করে দেয় এক ভিন্ন অনুভবের জগতে। তাকে স্বর্গীয়তা বা Divine বললে সবটুকু বলা হয় না।তাকে বলা যেতে পারে মানবিক সম্পূর্ণতার অভিজ্ঞান।
প্রকৃতি পর্যায়ের অন্তর্গত রবীন্দ্ররচনায় একটি পরিচিত গান –
“ ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান –
আমার আপনহারা প্রাণ, আমার বাঁধনছেঁড়া প্রাণ।।
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে,
তোমার ঝাউয়ের দোলে
মর্মরিয়া উঠে আমার দুঃখরাতের গান।।
পূর্ণিমাসন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়।
তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙ্গিন-স্বপন মাখা।।
তোমার চাঁদের আলোয়
মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান”।।
আপাতদৃষ্টিতে গানটিকে পর্যবেক্ষণ করলে প্রকৃতির একটি নিটোল ছায়াছবি দৃশ্যমানতা পায়। গানের প্রধান অবলম্বন বসন্ত ঋতু। এ গানে অশোক কিংশুকের পরের পংক্তিতেই অকস্মাৎ এসে পড়ে ঝাঊয়ের দোলে দুঃখরাতের গানে মর্মরি ওঠার শব্দ। অথচ বসন্ত প্রকৃতির সম্ভারে, রিক্ততাকে ভরিয়ে তোলার আয়োজনই মুখ্য। সেখানে কেন দুঃখরাতের গান? কেন অকারণের সুখের প্রসঙ্গই বা এসে পড়ে? তাই মনে হয়, প্রকৃতির পরিবহ এ গানের ঘেরাটোপ মাত্র। মূল সুরটি বাঁধা আছে বসন্তের উদাসীনতায়, এর ক্ষণস্থায়িত্বে। এর সাথে জড়িয়ে আছে মানবমনের আশা, নৈরাশ্য, প্রেম। এই অনুভূতির সঞ্চরনেই মানবমনের দোদুল্যমান চিন্তাপ্রবৃত্তি বসন্তের ক্ষণস্থায়ী প্রকৃতির মত পরিবর্তনশীল, তার জন্য সুখ বা দুঃখ অকারণেই জমাট বেঁধে ওঠে। আর তাই তা প্রস্ফুটিত জ্যোৎস্নায় নিমেষেই মিলিয়ে যেতে পারে।
এই ফাগুন রাতের নিবিড় প্রকৃতিময়তায় রূপের সমুদ্রে যে পুঞ্জীভূত অনুভব, তা কি আমাদের দৈনন্দিনের কোনো অভিজ্ঞতা? হয়তো তা নয়। এই রূপসাগরের সন্ধান মানুষ পায় নান্দনিকতার আশ্রয়ে। সৌন্দর্য চেতনাই মানুষকে তার জৈবিকতার বন্ধন থেকে মুক্তি দেয়, নিসর্গের নিবিড় উপলব্ধিতে। যেখানে সুখ বা দুঃখ, পাওয়া বা না পাওয়ার স্বস্তি বা বেদনা নয়, সেখানে এক নিবিড়তর প্রশান্তিতে আমাদের হৃদয় মন কানায় কানায় ভরে ওঠে। একেই প্রকৃত অর্থে বলা যেতে পারে ‘Divine’ বা অলৌকিক। পার্থিব হয়েও যা অলৌকিক। কীর্তনের সুর বা ছন্দ এ গানের সেই আনন্দঘন অপার্থিবতাকে সম্পূর্ণতা দেয়।
ইংরাজী ‘Divine’ কথাটির অর্থ বহুস্তরীয়, বহুমুখী। প্রথাগত অর্থে তাকে ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় বললে অবিচার করা হয়। আসলে যা কিছু অনন্ত, অন্তহীন, অপার্থিব, অনন্য অনির্বচনীয় এবং প্রকৃত অর্থে জীবন-সংলগ্ন দার্শনিকতা তাকেই Divine বলা যেতে পারে। সেদিক থেকে রবীন্দ্রগান তার অসামান্য বাণীর সৌন্দর্যে, আধুনিকতায়, ব্যাপ্তিতে এবং সুরসম্পদে এই অলৌকিকত্বের অপার্থিবতার দাবিদার।
