বেকারীত্ব থেকে মুক্তি ; যোগ্যতা আছে তো ? – ড. রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

প্রতিটি প্রাপ্তবয়স্কের একটি  নিজস্ব রোজগারের প্রয়োজন অবিসংবাদিত। কিন্তু রোজগার করতে গেলে কিছু  নূন্যতম যোগ্যতা – কারিগরি এবং/অথবা সাধারণ – ও স্বাভাবিক বুদ্ধি লাগে। সেটা অর্জন করতে খানিকটা লেখাপড়া শেখা বাধ্যতামূলক। ভাল লেখাপড়া জানাটা, ভাল জীবিকা অর্জনে যথেষ্ট সহায়ক হয়। অথচ, এখনকার পরিচিত চিত্র হচ্ছ যে, শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা তাদের পছন্দমতো কাজ পাচ্ছে না। জীবিকা মানেই কিন্তু চাকরী নয়। কিন্তু এই চাকরীটাই সবাই চাইছে। ব্যবসা বা স্বনিযুক্ত প্রকল্পও জীবিকা হিসেবে সমাদৄত, কিন্তু জনপ্রিয় নয়।চাকরী পাওয়া/না পাওয়াটা চাহিদা-যোগানের খেলার মতো। চাকরীর যোগানের তুলনায় চাহিদা অনেক, অনেক বেশী। তার সব থেকে বড় কারণ – অনেক কারণের মধ্যে – হচ্ছে, জনবহুল আমাদের দেশ। চাকরীর যোগান উত্তরোত্তর কমছে, যন্ত্রের প্রভাবে (automation)I নতুন নতুন যন্ত্র, অনেক কম সময়ে, অনেক কম লোকের সাহায্যে অনেক বেশী কাজ করে ফেলছে। অথচ লোক সংখ্যা বাড়ছে। ফলে প্রতিযোগিতা বাড়ছে। কম সংখ্যক শূন্য পদের জন্য অনেক বেশী আবেদনকারীর মধ্যে প্রতিযোগিতা হচ্ছ। সফল না হতে পারার সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। অর্থাৎ,সফল হতে গেলে, অনেক বেশী দক্ষ হতে হবে, অনেক বেশী শিক্ষিত হতে হবে। দক্ষ হবার, শিক্ষিত হবার প্রতিযোগিতা অনেক বেড়ে গেছে।

     এর ফলে এক ভ্রান্ত ধারণা ক্রমবর্ধমান। School, College, University থেকে পাশ করে বেরোবার পর সবাই নিজেকে শিক্ষিত বা দক্ষ মনে করছে এবং আশা করছে তার পছন্দ মতো একটা চাকরী পাবার সে যোগ্য। কিন্তু নিযোগকতার চাহিদার সঙ্গে যখনই প্রার্থীর নিজসব ধারণা মিলছে না, তখনই সমস্যা তৈরি হয়ে যাচ্ছ।

     নিয়োগকর্তার চাহিদার কতকণ্ডলো বৈশিষ্ট্য হল:

(১) দক্ষতা নূন্যতম মানের বেশী হতে হবে (যত বেশী, ততই ভাল);

(২) বেশী শ্রমিকের কাজ, যেন কম জনে করে ফেলতে পারে;

(৩) মজুরী (বা বেতন) ও ভাতা এবং অন্য সুবিধে বাজার চলতি হবে (কিন্তু বেশী হবে না)।

দক্ষতার ধ্যানধারণা নিয়ে বিস্তর ফাঁক থেকে যাচ্ছে দুই তরফের মধ্যে। প্রার্থীরা মনে করছে তারা ঠিক মতো দক্ষ বা যোগ্য। আর নিয়োগকর্তারা মনে করছেন প্রার্থীরা নিম্নমানের। অর্থাৎ, দুটি বৈশিষ্ট্যই একই সঙ্গে একই দিকে কাজ করছে:

(১) কাজের লোকের চাহিদা কমছে (বা বাড়ছে না) আর যোগান বাড়ছে; এবং

(২) দক্ষতার ধ্যানধারণা নিয়ে উভয় তরফের মধ্যে ব্যবধান বাড়ছে।

ফলশ্রুতি: শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। আর তার উৎস হচ্ছে যে, নিয়োগকর্তারা বা প্রতিষ্ঠানরা মনে করছেন শিক্ষিত যুব সমাজ যথেষ্ট দক্ষ নয়, তাই তাদের নিয়োগ করা যায় না।

কিছুকাল  – গত দুই দশকের মধ্যে –  আগে, NASSCOM (বাণিজ্যিক সংস্থাসমূহের গোষ্ঠী) এর অধিকর্তা Mr. Kiran Karnick, তাঁদের Report এ বলেছিলেন যে, ‘80% of Indian graduates are simply not employable’. অর্থাৎ, আমাদের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার মান, কাজের বাজারের চাহিদার তুলনায় বেশ খারাপ। উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা যদি শিল্প বা কাজের বাজারের দক্ষতার প্রয়োজনের দিকে না তাকায় (বা পরিপূরক যদি না হয়) তবে, বেকারীত্তব সমস্যা উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে। উচ্চশিক্ষা ক্রমশঃই অর্থহীন হয়ে পড়বে।      উচ্চ শিক্ষিতরা যদি নিয়োগকর্তার কাছে গ্রহণযোগ্যতা হারায়, তবে, সেটা উচ্চ শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা। যে কোন উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে প্রথমে সকল ছাত্র-ছাত্রীকে বোঝাতে হবে, এটাতে তার উপকার কি। যে জ্ঞান সে লাভ করবে, তা সে কোথায় কি ভাবে প্রয়োগ করবে। তার জীবিকা কিভাবে এই প্রশিক্ষণের দারা নির্ধারিত হচ্ছ। ফলে জীবিকা নির্ধারণ ও সেইমতো উচ্চশিক্ষার প্রশিক্ষণ, ছাত্রছাত্রীরাই নির্ধারণ করে নিতে পারবে। পঠনপাঠনের মান, তার ধারাপ্রনালীকে শিল্প বা নির্দিষ্ট কাজের সহযোগী হতে হবে। শিল্পের চাহিদা উত্তরোত্তর পালটাবে। উচ্চশিক্ষার পঠনপাঠনকেও তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পালটাতে হবে। নচেৎ, শিল্পের ক্ষতি হবে, দেশের অরথনৈতিক উন্নয়নে ব্যাঘাত ঘটবে, এবং সর্বোপরি শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা কর্মহীনতায় ভুগবে। অর্থাৎ, শুধু বেকারীত্ব নয়, তার থেকে অনেক বড় সমস্যার উৎস হচ্ছ উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষনের সঠিক দিক নির্ণয়নের অভাব।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.