অভিসার – অরিত্র মজুমদার

আমি তখন খানিকটা উঁচু ক্লাসে পড়ি। এই ফাইভ সিক্স হবে। মা আর নিচের ফ্ল্যাটের জেঠীমা মাঝে সাজেই দুপুরবেলা কোথাও একটা যান। আমাদের দুই ভাইকে স্কুল থেকে এনে, খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে।রোজের কাজ। কিন্তু সেইদিনগুলোতে, মন নেই কাজে। আমার উঁচু ক্লাস, আমি বুঝি। কোনো যেন অভিসার যাত্রা। আছি, কিন্তু নেই।
বড় ছেলে, প্লাস মা নেওটা হওয়ার সুবাদে অচিরেই জানলাম সিনেমা যাওয়া হয়। আমার গাল ফুলে ঢোল, আমায় নাও না কেন? না বাবা! বড়দের সিনেমা তো, তুমি বড় হলে, নিজেই দেখবে। আমার খটকা লাগে, আমার কঠিন বই পড়া, সিরিয়াল না দেখা, সিরিয়াস মা, এ কার সিনেমা দেখতে যায়?
যাবতীয় কাজে তো, আমায় সবেতেই ইনভল্ব করেন! শাড়ী বাছা থেকে খুনতি কেনা। অনেক বায়নার পরেও, নো পারমিশন। রফা হল, আমি রিকশা ডেকে দেব একটা, জেঠি আর মা, জয়াতে যাবেন। আমি সারাদুপুর টিভি দেখবো, কিন্তু ভাই কে রিমোট দেবোনা। প্লাস, এসে গল্পটা বলতে হবে। আর কিছু কিনে আনতে হবে। ডিল ডান।
আমি ভোলা কাকুর রিকশা ডেকে দিতাম, পঞ্চাশ টাকা ভাড়া। আমি উঁচু ক্লাস। নেগোশিয়েট করতে পারি। জেঠি চিবুক ছুঁয়ে বলতো, কি লক্ষ্মী ছেলে দেখো! বড়োদের কত্ত হেল্প করে। তারপর?তারপর, দুটো নতুন তাঁতের ফোলা শাড়ী, রিকশায়ে ফুলে, বসে হাত নারতে নারতে হাওয়া! ময়ূরপঙ্খী হাজির, রাজকন্যাদের পায়ে কে?প্রবাদবাক্য, লক্ষ্মী হয়ে থেকো। এই যাবো, এই আসবো। চিঁড়ের পোলাও ঢাকা দেওয়া আছে। ভাই উঠলে, দুজনে খাবে। ফ্রিজে ক্যাডবেরি আছে, ভাইকে দিয়ে খাবে। গ্যাস জ্বালাবে না। জ্যোৎস্না মাসী এলে, কমপ্লান করে দেবে, খাবে। সারাটাক্ষন টিভি দেখো না বাবা, ঘুমিয়ো একটু। সবটুকু রাস্তার লোক শুনলে, আমি ছাড়া। অভিমানে ঘাড় নাড়ি।
সেদিন মায়েরও ছুটি, আমারও। ডোডো কে দরজা বন্ধ করে রেখে আমি এমটিভি দেখি। সন্ধেবেলা দুজনে ফেরেন, ঝলমলে মুখচোখ। ঢুকেই ঢাকনা খুলে খালি বাটি, এঁঠো গ্লাস, চেক! যাক!সব ঠিকঠাক! গ্যাস জ্বালানি তো? না। গুড বয়। ঝোলা থেকে বেরোয়, জয়ার ইন্টারভ্যালখ্যাত সল্টেড চিপস, একটা চীটস, সাদা লিমকা, জেঠি দেয় ক্যাডবেরি, পপকর্ন আর চোটর পটর।রাত্রে খেতে দিয়ে, মা গল্পটা বলতেন। সেন্সরড অবশ্যই। কিন্তু যতটা বলা যায়। বিশ্বাস করুন আমি এই ভাবে, আপনার সব সিনেমা আগে শুনেছি, পরে দেখেছি। শুভ মহরত, উনিশে এপ্রিল, বাড়িওয়ালি, দহন, অসুখ সোওওওওব। চোখের বালির সময় আমার ক্লাস নাইন। উপন্যাস অলরেডি পড়া ততদিনে। তখন একটাই প্রশ্ন করেছিলাম, মা গল্পটা একই রেখেছে? মা বলেছিলেন, এটা তুমি নিজে পরে দেখো।
ক্লাস ইলেভেন যখন, তখন দোসর এলো। আমার একমাত্র টিউশন কেটে সিনেমা দেখা ওটা। তোমার ঠোঁট আমার ঠোঁট ছুঁলো, এই শব্দবন্ধের সাথে আমি বেশ কটা কাল যাপন করেছি। ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায়। দানবীয় কবিতাটা ওই বয়সেও, অ্যাডাল্ট সিনের মোহ অতিক্রম করে রন্ধ্রে ঢুকলো।এরপর শুধু একবার মাত্র আমরা দুভাই আর মা জয়াতে প্রথম এবং শেষবার আপনার একটি সিনেমাই দেখি। খেলা ।
ডোডো দেখে বলেছিলো, মা দাদার পরীক্ষা তো হয়ে গেছে, আমরা দাৰ্জিলিং বেড়াতে যাবো না? একসাথে বেড়ানোটা আর হয়নি।এরপর আমি আপনার সব সিনেমা দেখেছি। সব। হীরের আংটি থেকে মেমোরিজ ইন মার্চ। সিন বাই সিন গুলে খেয়েছি। কখনো একাই। কখনো বন্ধু, দিদি। প্রতিবারই সেই ঘোর, যেটা মা আর জেঠি নিয়ে ফিরতেন।আমাদের মধ্যবিত্ত বাড়িতে, আপনি মা জেঠিমা কে মুক্তি দিয়েছিলেন। শুভ মহরত এ রাঙা পিসিমার কনটেক্সট তা মনে করুন – কি বা পারতাম আমি? একটু সেলাই ফোরাই, আর মাঝে সাঝে গুন্ গুন্ করে গান। আপনি না থাকলে জানতেই পারতাম না ….. সেটাও তো ওদেরই কথন।তখন অনলাইন টিকিট, মাল্টিপ্লেক্স ছিলোনা। ওলা উবেরতো ছেড়েই দিলাম। তাও ওঁরা বেরোতেন, আপনার গল্প শুনবেন বলে।এই তো মোহন অভিসার!আমার মা, আপনার নায়িকার শাড়ী ফলো করতেন, ম্যাগাজিনে গয়নার প্রমোশন এর এডভারটিসিমেন্ট নিয়ে স্যাকরা বাড়ি ছুটতেন! উইচ ইস কোয়াইট আনলাইকলি অফ হার! কেন ?আপনার গল্পের নায়িকা হবেন বলে ?

এটা বেশ তিতলির স্ক্রিপ্টটার মতো হল না? ধরুন আমার মায়ের নাম ঊর্মি হলো, আমি তিতলি। আপনি রোহিতের পাঠটা করবেন?বেশ এক গল্প হতো তবে ….
আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ …

যেদিন সকালে খবরটা পেয়েছি, আমি হ্যাল্ফ ডে করে বাড়ি চলে আসি। ডেস্ক কে বসতে পারিনি।
রোববার এ ফার্স্ট পার্সনে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের চলে যাওয়া নিয়ে একটা গান আপনি কোট করেছিলেন, সেটা সাথেই ছিল আপনাকেই ফেরত দিলাম…..

সে যে পাশে এসে বসেছিল তবু জাগি নি।
কী ঘুম তোরে পেয়েছিল হতভাগিনী।
এসেছিল নীরব রাতে বীণাখানি ছিল হাতে,
স্বপনমাঝে বাজিয়ে গেলগভীর রাগিণী।
জেগে দেখি দখিন-হাওয়া, পাগল করিয়া
গন্ধ তাহার ভেসে বেড়ায় আঁধার ভরিয়া।
কেন আমার রজনী যায়– কাছে পেয়ে কাছে না পায়
কেন গো তার মালার পরশ বুকে লাগি নি।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.