সমপ্রেমের সাম্য- নীলিমেশ রায়

প্রতিদিন  একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশ। কাকে ভালোবাসা  যায় এবং কতটা সেই সব হিসেব-নিকেশ উলটে পালটে দিয়ে নতুন করে স্বপ্ন বুনছে হারিয়ে যাওয়া মুখ লুকোনো অনেক গুলো প্রান্তিক গল্প।

এককালে আমি যখন ছাত্র ছিলাম, তখন যতটা সহজে কোনো পুরুষের নারীসুলভতা বা কোনো নারীর পুরুষালি স্বভাব কে অন্যরা ব্যঙ্গ করতে পারত – আজ নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই মানসিকতার বিপরীতটাও লক্ষ্য করা যায়।লজ্জা আর সংকোচ আগে যতটা মানুষ কে পিছন দিকে টেনে রাখতো আজ কিন্তু তা বদলেছে। এই কলকাতা শহরের বুকেও এখন মাথা উঁচু করে ওড়ে রামধনু রঙের পতাকা। লোকে নাক সিটকোতে সিটকোতে হলেও দেখে, যে একদল মানুষ পথে নেমেছে ভালোবাসার অধিকার পাবে বলে।

সমাজ তাদের কে এখনও নানা বাঁকা নামে ডাকলেও – তারাও এখন উঠে এসেছে আলোচনার পরিসরে, খবরের কাগজের পাতায়, গল্প-নাটক- সিনেমায় এবং পদযাত্রায়।

তবে একটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, সত্যিই  কি পাল্টাচ্ছে ভারত?

নাকি ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতা কে পুষে রাখছে ইম্পোর্টেড উদরাতার ক্যাপসুলে ?

যা কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে  বেরিয়ে আসছে গোরক্ষকের ভূমিকায় আর পিটিয়ে মারছে আরও কোনো একজন মানুষ কে,বা ভ্যালেন্টাইন ডে তে প্রেম করার অপরাধে তুলে নিয়ে যাচ্ছে জনৈক যুবক-যুবতী কে,ডাক্তারদের ধরে ধরে পেটাচ্ছে প্রকাশ্য রাস্তায়।এই যদি হয় একুশ শতকের মুক্তচিন্তার নমুনা তাহলে ভাবনাটা থেকেই যাচ্ছে যে সত্যি কোথায় দাঁড়িয়ে সমপ্রেমী-রূপান্তরকামী সমাজ?

হ্যাঁ, আদালত অনেক রায় প্রবর্তন করেছেন। ভারতে এখন পরকীয়া বৈধতা পেয়েছে, লিভটুগেদারও আইনের চোখে এখন স্বীকৃত। মানুষ পেয়েছে ব্যক্তিগত জীবনে নিজের মতো করে বাঁচার অধিকার – এমনকি কিছু দিন আগেও ৩৭৭ ধারা তে পরিবর্তন এসেছে।তবু আইনের থেকেও অনেক নিথর হলো সমাজ!সেই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে আজও গভীর অসুখ জমে আছে। তাই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভুটানে সমপ্রেম বৈধতা পেলেও পৃথিবীর সর্বোচ্চ গণতন্ত্রের চোখে আজও সমলিঙ্গের বিবাহ আইনত স্বীকৃত নয়।

যদিও ভারতের মাটিতে কিন্তু সমপ্রেম বা রূপান্তরকামীতা কোনো মঙ্গল গ্রহ থেকে নেবে আসা বস্তু নয়।বরং পৃথিবীর যে সকল দেশে আজ সমপ্রেম বা রূপান্তরকাম বৈধ সে সকল দেশের থেকে প্রাচীন ভারতে বহু যুগ আগে থেকেই সমপ্রেমও ছিল, রূপান্তরকামও ছিল। 

যদিও ভারতের পৌরাণিক সাহিত্যে সমপ্রেম ‘প্রায়’ অনুপস্থিত।দু-এক জায়গায় কিছু আভাস থাকলেও সরাসরি উল্লেখ কিছুটা কম।

যেমন ঋগবেদে বা শুক্ল যজুর্বেদের মতন প্রাচীন গ্রন্থে পশুর সাথে যৌন মিলনের বর্ণনা  রয়েছে কোনো রকম ঢাক ঢাক  গুড় গুড় না করেই।আবার বাৎসায়নের কামসূত্রে(২/৯) সমলিঙ্গের ওরাল সেক্সের উল্লেখ আছে।শুশ্রুতসংহিতাতেও ইম্পোটেন্ট পুরুষের যে শ্রেণীবিভাগ করা হয়েছে তার মধ্যে  দুটি প্রভেদ নিশ্চিত  ভাবেই সমপ্রেমের অন্তর্গত।

আসলে সমপ্রেমের ক্ষেত্রে  পৌরাণিক  ভারত বড্ড বেশি  প্রতীকের আড়াল নিয়েছে।যেমন  ধরা যাক কৃষ্ণার্জুনের সখ্যতা বা অলৌকিক  উপায়ে সেক্স চেঞ্জের ঘটনাটি।আবার রামায়ণে একটি ঘটনার উল্লেখ আছে যে,হনুমান লঙ্কায় চুপিসারে রাবণের অন্দর মহলে ঢুকে দেখেন রাবণের পত্নী ও উপপত্নীরা কেউ কেউ পরস্পর পরস্পরকে আলিঙ্গন করে শুয়ে আছেন –
            ‘কেহ নিদ্রাবশে রাবণবোধ করিয়া পুনঃ পুনঃ সপত্নীর মুখ আঘ্রাণ করিতেছে….ঐ সপত্নীও আবার উহাকে রাবণবোধে চুম্বন করিতেছে।’
যদিও এটি মূল রামায়ণে নেই, আছে কৃত্তিবাসী রামায়ণে।
আবার গঙ্গা আনয়ন বৃত্তান্তেও দুই নারীর  মিলনে ভগীরথের জন্মের উল্লেখও আছে।
এছাড়াও কার্তিক ও গনেশের জন্ম প্রক্রিয়াতেও সমপ্রেমের কিছু আভাস ইঙ্গিত রয়েছে।

তবে মহাভারতের  এক জায়গায় কিছু সুনিশ্চিত আভাস পাওয়া যায়।ঘটনটা কিছুটা এরকম, কুরুক্ষেত্রের আগের রাত।সহদেব গণনা করে বললেন,মহাকাল রাজরক্ত চায়।কাউকে বলি দিতে হবে।সেই অবস্থায় ঠিক হয় অর্জুন ও ঊলুপীর পুত্র  ইরাবন কে যুদ্ধ জয়ের জন্য আত্মবলিদান করতে হবে ।সে তখন একটি শর্তে রাজি হয়, যে মৃত্যুর আগে সে সম্ভোগ  সুখ পেতে চায়।তখন কৃষ্ণ নারী রূপ ধারণ করে ইরাবন কে বিয়ে করেন ও দৈহিক সঙ্গমে মিলিত হন।তারপর কথা মতো ইরাবন শহীদ হন।যদিও এই মৃত্যু তাকে তামিলনাড়ুর দেবতা বানিয়ে দেয়।তিনি হয়ে ওঠেন মধ্যলিঙ্গের মানুষদের উপাস্য  – তবে শুধু মধ্যলিঙ্গের মানুষরাই নয়,অল্পবয়স্ক যুবক বা অবিবাহিত পুরুষ রাও মেয়ে সেজে এই ইরাবনের আরাধনা করে থাকেন।

এরপরে আসা যাক সোমবেত ও সুমেধ নামে দুই বন্ধুর  গল্পে।যেখানে ভালোবাসার তাড়নায় লিঙ্গ পরিবর্তনের অপরাধে রাজরোষে তাদের মৃত্যু দন্ড  হয়।

একই রকম ভাবে সূর্য সারথি  আরুণি কেও দুবার লিঙ্গ পরিবর্তন করে নারী হতে হয়েছিল – প্রথম বার ইন্দ্র তাকে নারী রূপে ভোগ করেন।সে কথা জানলে সূর্য দেবের সম্ভোগের জন্যেও আরুণি কে নারী রূপ ধারণ করতে হয়।

এবার আসা যাক মহাভারতের শিখণ্ডী বা শিখণ্ডিনির প্রসঙ্গে,যেখানে আবার তৃতীয় লিঙ্গেরও উল্লেখ পাওয়া যায়।

আবার রূপান্তরকামের সরাসরি উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে গুজরাত ও তামিলনাড়ুতে প্রচলিত বহুচারী বা বহুগামী দেবীর।এই দেবীর অস্তিত্বের সাথেই রূপান্তরকাম ও অবদমিত সমপ্রেম  সরাসরি ভাবে যুক্ত।

অনেকেই বলবেন এতো অধিকাংশই রূপান্তরকাম, সমপ্রেম কোথায়?

তাদের উদ্দেশ্যে বলি রবি ঠাকুরের ডাকঘর কি অক্ষরে অক্ষরে  ভারতীয় পোস্টাল সিস্টেমের গল্প? ভুললে চলবে না এই সব পৌরাণিক গল্পেও রয়েছে ব্যাপক পরিমাণে রূপকের আড়াল।

মনের দরজা জানলা গুলো খুলে দেখলে এই সব পৌরাণিক গল্পের আড়াল সরিয়ে প্রকাশ পাবে যে সেই যুগেও এই প্রান্তিক  মানুষ রা ছিল।

তাই আজ যখন ভারত এতো ডিজিটাল হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তিকে বাহন করে হাতের মুঠোয় পেয়েছে গোটা দুনিয়াটাকে। এতো গ্লোবালাইজেশানের পরও আমাদের সমাজ কেন পিছিয়ে থাকবে। আইন দিয়েই কেবল মাত্র অধিকার আসে না। অধিকার আসে অভ্যাসের মধ্যে দিয়ে – সহযোগিতার মধ্যে দিয়ে – সুচেতনার মধ্যে দিয়ে। আমাদেরকেও তাই সেই সুচেতনাটা অভ্যাস করতে হবে যে এই সমপ্রেমী বা রূপান্তরকামী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা এই সব শ্রেণীকরণের ঊর্ধ্বে; তারাও মানুষ। এদের যেন আর আত্মপ্রকাশের দাবি তে বা ভালোবাসার অধিকারের দাবিতে পথে নাবতে না হয়। বরং আসুন সকলে হাতে হাত বেঁধে এবার পথে নাবি আর এমন এক ভালোবাসার দেশ গড়ে তুলি যেখানে সত্যিই হয়তো একদিন আমরা সবাই রাজা হয়ে উঠবো ।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : গুরুচন্ডা৯ 

ছবিঃ নীলিমেশ রায়, জয় নন্দী, খাজুরাহ মন্দির, উড়িষ্যা পটশিল্পী।

One Comment Add yours

  1. Ekotabrindo Kolkata says:

    Happy to see it, too good and the words are so perfect . Heart touching a kind of spell bound.

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.