রবীন্দ্রসঙ্গীতে শ্রাবণযাপন:একটি খণ্ডচিত্র – কৌস্তভ গোস্বামী

রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের যে বিষয়গত বর্ণময়তা ও melodic structure-এর বৈচিত্র সেটা সম্ভবত অন্য পর্যায়ের গানে কম-ই দেখতে পাওয়া যায়।বর্ষার গান নিয়ে লিখতে বসে এত বিবিধ দিকের উত্থাপন হয় যে কোন উপাদানকে বাদ দিয়ে কোনটাতে আলোকপাত করব,সেটাই একটা দুরূহ কাজ হয়ে দাঁড়ায়।গীতবিতানে বর্ষা পর্যায়ের সূচনা হয় দেশরাগাশ্রিত তিনতালে নিবদ্ধ ‘এসো শ্যামল সুন্দর’ গানটি দিয়ে এবং তার ঠিক পরেই স্থান পেয়েছে তালফেরতা ‘ওই আসে ওই অতি ভৈরব হরষে’।

রবীন্দ্রনাথের বর্ষার গানের segment-এ কিছু recurrent imagery ফিরে ফিরে আসে-কদম,যুথি,মালতী,কেতকী,বকুল,কেয়া প্রভৃতি ফুলের উল্লেখ অনেক গানে পাই।দ্বিতীয় গানটিতে ‘নবযৌবনা’,’নিখিলচিত্তহরষা’ বা নব-অনুরাগিনী-র মত বিশেষণে personify করে বর্ষাকে এক বিরহিনী নায়িকা রূপে প্রকাশ করছেন।এই বিরহিনী-ই আবার ‘উতলধারা বাদল ঝরে’ তে সারাবেলা একাকী গৃহে শ্রাবণযাপন করছে বা আমার দিন ফুরালো-তে ‘তিমির আড়ালে’ দাঁড়িয়ে থাকা ‘দূরের মানুষে’র পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে।অর্থাৎ যে বিরহিনীকে রবীন্দ্রনাথ প্রথম গানে (এসো শ্যামল সুন্দর)পরিচয় করালেন সে সম্পূর্ণ বর্ষার গানের আখ্যান জুড়েই উপস্থিত,কখনো প্রত্যক্ষভাবে কখনো পরোক্ষভাবে। ‘প্রিয়ার ছায়া’,’পরাণসখা’,’পরবাসী’ বা ‘বিরহকাতর শর্বরী’ রূপে।

এই প্রসঙ্গে দুটি গানের কথা মনে পড়ছে। বাগেশ্রী-মল্লারের মেলবন্ধনে সম্ভবত এটিই একমাত্র রবীন্দ্রনাথের গান-‘সঘন গহন রাত্রি /ঝরিছে শ্রাবণধারা’। এখানে বাগেশ্রীর কোমল গান্ধারের পাশাপাশি শুদ্ধ গান্ধার ও মল্লারের দুটো নিষাদ ব্যবহৃত হয়েছে।স্থায়ী অংশে সেই ‘বিরহিনী’-ই আবার ফিরে আসে এবং তার অশ্রু হরণ করে তারা নামছে কোমল ধৈবতে।এমন unpredictable melodic landing পৃথিবীর কোন সুরস্রষ্টা করতে পেরেছেন কারো জানা নেই।

কোমল ধৈবতের কথা উঠল যখন আরেকটি গানের প্রসঙ্গ চলে আসে inevitably:’কোথা যে উধাও’। মুক্তছন্দের এই গানে মূল রাগ হল মিয়াঁ কী মলহার।এর অপূর্ব রূপ যখন মা পা নি সা রে স্পর্শ করে কোমল নিষাদে অবতীর্ণ হচ্ছে ঠিক তখনই রবীন্দ্রনাথ অতর্কিতে কোমল ধৈবতের আগমণ ঘটিয়ে এক অসামান্য মৌলিক রূপ দিলেন মল্লারকে। সে হয়ে উঠল রবিমল্লার।

বর্ষার গানগুলি অধিকাংশই তমসাচ্ছন্ন তিমির বা মেঘাচ্ছন্ন দিনের প্রেক্ষাপটে রচিত।দুটি গানে আমরা পূর্ণিমা রাত্রির উল্লেখ পাই:’ও আষাঢ়ের পূর্ণিমা আমার’ এবং ‘আজ শ্রাবণের পূর্ণিমাতে’।প্রথমটি রবীন্দ্রনাথ সৃষ্ট ছয় মাত্রার ষষ্টি তালে,দ্বিতীয়টি দাদরায়,পিলু-খাম্বাজ রাগে নিবদ্ধ। প্রথম গানে পূর্ণিমাই একটা চরিত্র হয়ে দেখা দিচ্ছে যে কবির ‘হৃদয়-আঙিনায়’ লুকোচুরি খেলছে।এই দোলাচল বোঝাতে রবীন্দ্রনাথ পধ,মপ,মপ;এই সুরবিন্যাস ব্যবহার করেছেন।অপরদিকে দ্বিতীয় গানে ‘কি এনেছিস বল’-এর আকুলতা প্রকাশ পেয়েছে সগগ,গমগ-এই structure-এর মধ্যে দিয়ে।এখানেও প্রকৃতির বিভিন্ন উপাদানকে human qualities-এর সাহায্যে personify করা হয়েছে:’বাদলহাওয়ার দীর্ঘশ্বাসে’,’যুথীবনের বেদন’ ইত্যাদি।বর্ষার শান্তস্নিগ্ধ রূপের পাশাপাশি রুদ্ররূপটিও রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গানে প্রকাশ পেয়েছে:’আঁধার অম্বরে প্রচণ্ড ডম্বরু’,’নীলঅঞ্জনঘনপুঞ্জছায়ায়’,
‘হৃদয়ে মন্দ্রিল ডমরু’-এই গানগুলোতে ত্রস্ত শর্বরী,কম্পিত কদম্ববন,দুন্দুভি,ভেরী-এই imagery গুলির মাধ্যমে রবীন্দ্রনাথ এক গম্ভীর,কালো রূপকে দেখিয়েছেন।সুরের কাঠামোর বিশ্লষণ করলেও দেখা যায় এই গানগুলির অন্তরাতে তারসপ্তকের কোমল গান্ধার,মধ্যম পর্যন্ত শব্দগুলি যাচ্ছে আবার সঞ্চারী অংশে ষঢ়জ থেকে পঞ্চমের মধ্যেই শব্দসমূহ সীমাবদ্ধ থাকছে।আমার অত্যন্ত প্রিয় একটি বর্ষার রবীন্দ্রসঙ্গীত-এর সম্বন্ধে দু-চার কথা বলে এই শ্রাবণযাপনের উপসংহারে আসব।


১৩১৭-র আষাঢ়ে রচিত গৌড়মল্লার রাগাশ্রিত, ঝম্পক তালে নিবদ্ধ ‘আমারে যদি জাগালে আজি নাথ’…প্রথমত এই যে ‘নাথ’ কথাটি ব্যবহার করা হয়েছে গানে,এখানেই একটা thematic ambiguity তৈরি করছেন রবীন্দ্রনাথ। সাধারনত পূজা বা প্রেম পর্যায়ের গানে আমরা ‘নাথ’,’ ‘প্রভু’,প্রিয়’,’সখা’ এই শব্দগুলো পেয়ে থাকি।বর্ষার গানে ‘পরাণসখা’ এসেছে,কিন্তু ‘নাথ’ সম্ভবত এই একটি গানেই। ‘গীতাঞ্জলি’তে যে কয়েকটি বর্ষার গান অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তার মধ্যে এটি অন্যতম।স্থায়ী অংশে কোথাও বর্ষার উল্লেখ নেই। অন্তরাতে প্রথম পাওয়া যাচ্ছে,” নিবিড় বনশাখার পরে/আষাঢ়মেঘে বৃষ্টি ঝরে”…অর্থাৎ একটা unpredictability-র জায়গা থেকে যাচ্ছে, যে শ্রোতা এই গানটি আগে কখনো শোনেননি, তার জন্য।

এখানে কবি জাগতিক প্রেমের কথা বলছেন না আধ্যাত্মিক প্রেমের ছোঁয়া রেখে যাচ্ছেন সেটাও খানিকটা রহস্যময়,কারণ এরপর কোথাও কোন ব্যক্তির উল্লেখ নেই। সঞ্চারী অংশে শুধুমাত্র অবিশ্রান্ত বর্ষার সাথে ‘নিদ্রাহারা প্রাণ’-এর সহাবস্থান।এখানে সুরবিন্যাসেও কবি কোমল নিষাদ থেকে শুদ্ধ মধ্যম পর্যন্ত একটি ব্যতিক্রমী অবরোহণের মুহুর্ত তৈরি করছেন। শেষাংশে আবার সেই ‘নাথ’-এর অন্বেষণে অশ্রুসিক্ত কবিহৃদয় বেরিয়ে যাচ্ছে তমসাচ্ছন্ন বাদলের অভ্যন্তরে…and the search comes a full circle…. অপূর্ব এক মায়াময় বৃত্ত রচনা হচ্ছে। গানের শুরুতে ‘নাথ’ কথাটির দশ মাত্রার অবস্থানের মধ্যে দিয়ে যে intense এবং prolonged journey-র সূচনা হয়েছিল সেটা আকাশের ‘ব্যাকুলবলে’ দুহাত বাড়িয়ে সেই ‘নাথ’ কে খোঁজার মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে।