স্বাধীনতা – কাবেরী মুখার্জী

দিনটা বেশ মেঘলা আর কেমন একটা নরম রোদ খেলা করছে মাঝে মাঝে; আমার পড়ার টেবিলে রাখা বই খাতাগুলো কেও ছুঁয়ে যাচ্ছে আলতো করে। আমার যে আজ কিছুতেই উঠতে ইচ্ছে করছেনা বিছানা ছেড়ে। ঈশ… খুব রাগ হচ্ছে, আজ সকলের ছুটি তবু কেন আমাকে স্কুল যেতে হবে? কিন্তু যেতে হবেই যখন উঠে পড়াই ভালো… এইসব ভাবছি যখন তখন হঠাৎ শুনি বাইরে একটা অপরিচিত চেঁচামেচি। এই পাড়াটা সকালবেলা বেশ নিস্তব্ধই থাকে – একটা ঘুম ঘুম ঘোর – এ পাড়ার কেউ বোধহয় আমার মতো সাত সকালে স্কুলে যায়না! কিন্তু কাগজ কাকু? সেও কি আজ আসেনি? না কি আমি তার কাগজের ক্রিং ক্রিং বেল শুনতে পাইনি? কি জানি।
তবে কারা গোলমাল করছে আর কেন? দু একটা শব্দ যা উড়ে আসছে – কে? কি করে কেন? …. না, এবার উঠতেই হবে – কী ব্যাপার জানতে হবে – ফেলুদা না হই, অন্তত তোপসে তো হতে পারি। জানলা দিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম – শুধু একটা জটলা ছাড়া কিছুই তেমন দেখলাম না। তাই মায়ের নিষেধ সত্বেও নেমে গেলাম নীচে।
“কী হয়েছে গো গোপালদা?” “একি! মালতী মাসি, তুমিই বা কাঁদছো কেন?” আমার প্রশ্নের উত্তর তো কেউ দিলোই না, উল্টে রাগ রাগ চোখ করে বললো, “তোর জানার দরকার নেই, তুই এখান থেকে যা।” কিন্তু যাই কি করে? হঠাৎ মালতী মাসি আমার হাত দুটো জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো, “বিশ্বাস করো, আমার বল্টু চুরি করেনি। ওকে তো তুমি চেনো, বলো, তোমার সঙ্গে ও মাঠে খেলে।” ঠিক কথা। বল্টু আমার পাড়ার বন্ধু, খুব ভালো ছেলে। তবে এরা এসব কী বলছে আর কেন? অনেক কথোপকথন, উত্তেজিত জনতার কলরবের শেষে যা বুঝলাম, যে বল্টু নাকি আমাদের হাউসিং কমলেক্স এর গাছ থেকে কিছু ফুল আর অনেক পাতা ছিঁড়ে নিয়ে গেছে! আমাদের কেয়ারটেকার অমিত কাকু জোরের সঙ্গে বললো, “আমি নিজে দেখেছি, পাঁচটা সাদা জবা আর গোটা ছয়েক কমলা গাঁদা আমার ঘরের পাশের গাছ দুটোতে ছিল। বল্টু গেট দিয়ে বেরোনোর পরেই খেয়াল করলাম যে একটাও ফুল নেই আর ওর মা সব জানে।”
অমিতদা অনেক দিনের লোক। বাগান দেখাশোনা ও-ই করে, তাই ফুলের হিসেব রাখতেই পারে। ওকেই বা অবিশ্বাস করি কি করে? একটুক্ষন সবাই চুপ আর সকলের দৃষ্টি ওই ছোটখাটো আধ ময়লা শাড়ি পড়া মালতী মাসির দিকে। এবার তারই উত্তর দেবার পালা।
মালতী মাসি যা বললো, তা এইরকম, “ইস্কুলে বলেছে, পতাকায় যে রঙ আছে, সেই রঙের ফুল আনতে, কিন্তু বাজারে ফুলের কি দাম! আমরা গরীব মানুষ, কোথায় পাবো ফুল কেনার পয়সা? ঠিক আছে, কতো দাম হবে বলো, আমার মাইনে থেকে কেটে নিও। আর দিন পনেরো পরেই তো মাইনে দেবে।”
আমি আস্তে আস্তে ওপরে উঠে এলাম! কেন জানিনা, একটু কান্না পেলো – না, বল্টু বা মালতী মাসির জন্য নয়। কার জন্য বুঝতে পারিনি। বাবা কাল আমার জন্য সাদা আর কমলা জারবেরা কিনে এনেছে, সঙ্গে অনেক ঝাউ পাতা। মা আবার সব গুলো কে একটা ট্রাই কালার রিবন দিয়ে বেঁধেছে।
বাবাকে আমি বলতে শুনেছি মাকে, “জানো একটা ফুলের দাম ২০ টাকা।” আমি গুনে দেখিনি কটা ফুল আছে। আমার কাজ তো শুধু সেলোফেন র‌্যাপ এর মধ্যে রাখা ওই উজ্জ্বল দামী ফুলের তোড়াটা স্কুলে নিয়ে যাওয়া আর বাহবা পাওয়া, কিন্তু আমি তো কিছুই করিনি, মানে আমাকে কিছু করতে হয়নি, কখনোই হয়না, আর বেচারা বল্টু!
আচ্ছা, বল্টু কি স্বাধীনতার মানে জানে? জানে। হয়তো স্বাধীনতা দিবসের ওপর প্রবন্ধ লিখতে পারবেনা কিন্তু আমার থেকে ওর চিন্তাধারা অনেক বেশী স্বাধীন। আমরা দেশ কে কতটা ভালোবাসি? সকলের কথা জানিনা তবে বল্টু বোধহয় আমার থেকে বেশী ভালোবাসে। আমি ঠিক বুঝেও বুঝতে পারছিনা, বড়রা নিশ্চই বুঝবে, তাই না?
আমাকে তৈরি হতে হবে – আজ যে ১৫ই আগস্ট!