ঘুম নেই: খিস্তি খেউড়ের আড়ালে রাত জাগা কান্না আর স্পর্ধার আগুন – প্রত্যয় রাহা

“Essentially, the revolution is first for workers and peasants, revolutionary theatre must preach revolution; it must not only expose the system but also call for the violent smashing of the state machine.” – Utpal Dutt

সাল ১৯৭০। বহরমপুর থেকে কলকাতা ট্রাকে করে পাট চালান করা হতো। রাস্তা ছিল একটাই। সারা দিন রাত ট্রাক চালিয়ে চালকের দল পাট পৌঁছে দেওয়ার কাজ করতো। যেমন ডাকহরকরা সারারাত দৌড়ে চিঠি পৌঁছতে যেত খানিটা তেমনই (এই প্রসঙ্গে সলিল বাবুর ‘রানার’ গানটির কথা বলতেই হয়, এই গান সেই সব মানুষের, যাদের সত্যি ‘ঘুম নেই’)। ঠিক সময়ে মাল না পৌঁছলে আবার জরিমানার গল্পও ছিল। তাই, যে কোনো প্রতিকূল পরিস্তিতি কে তুচ্ছ মনে করে এই ট্রাক চালকরা এক নিঃশ্বাসে ট্রাক চালিয়ে মাল পৌঁছনোর ব্যবস্থা করতো। এই কাজের সাথে জড়িয়ে থাকতো তাদের নিজেদের বেঁচে থাকা এবং পরিবারের দিন যাপন ও সব রকমের কাজ কর্ম। তাই রাতের অন্ধকারে ট্রাক চালানোর সমস্ত ঝুঁকি নিয়েই তাদের বাঁচতে হতো। হঠাৎ এক রাতে, স্থানীয় নদীর ওপর একটা সাঁকো পেরোনো কে ঘিরেই সমস্যার উৎপত্তি। সাঁকো তে হঠাৎ একটা ফাটল চোখে পড়ায় রাতে সেই সাঁকো পার করা বিপজ্জনক বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। সারারাত কী করবে, তাই এক দল ট্রাক চালক সাঁকোর কাছাকাছি একটা ধাবায় সেই রাতটা কাটায়।

এই ধাবার প্রেক্ষাপটেই পুরো নাটক টার অভিনয়।
আচমকা এক পাষাণ হৃদয় মালিকের আবির্ভাবে গল্পের মোড় ঘুরে যায়। সে বলে, যে করেই হোক তার ট্রাক সকালের মধ্যে কলকাতা পৌঁছে দিতে হবে। তাতে যদি চালকের প্রাণ যায়, তাতেও তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। এ ছাড়াও এক পুলিশ অফিসারও আছে গল্পের এক অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে। মালিকের প্ররোচনায় ও ঘুষ দেওয়ায় শেষ অবধি কী হবে সেটা দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে এই নাটকের পরের অভিনয়ের জন্য।  আমার লেখার শিরোনাম দেখেই নিশ্চই বুঝতে পারছেন যে এই নাটকে খিস্তি খেউড়ের একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। একটু আগে যে ধাবার কথা বললাম, ওইখানে বসেই প্রথমে চা আর পরে বাংলা মদের ঠেকে জমে ওঠে এই বন্ধুদের আড্ডা, গান, হাসি, কান্না, কথা আর দৈনন্দিন জীবনের লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা। কিছু কিছু সংলাপে তথাকথিত নাক উঁচু ভদ্রলোক সমাজের ভুরু কপালে উঠে যেতে পারে, তবে সঠিক মনন ও চিন্তন থাকা কোনো মানুষের বুঝতে পারা উচিত এই মানুষ গুলোর জীবনের সাথে যে লড়াই জড়িয়ে আছে, এবং যেই পরিস্থিতির মধ্যে এদের কাজ বা যাপন তার থেকে এই ভাষাই উঠে আসে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, বরঞ্চ যখন একটা দৃশ্যে এই খেউড় নিয়ে গান ধরে এই দল, তখন সত্যি মনে হয়, এই সৃষ্টিশীলতা তো অনেক শহুরে ভদ্দরলোক সমাজের মানুষের মধ্যেও থাকেনা। শ্রদ্ধেয় উৎপল দত্ত মহাশয়ের লেখা এই নাটকে প্রধান চরিত্র বলে কিছু নেই। তবু আখলাক বলে যে চরিত্র টি রয়েছে, তার সংলাপ ও ভূমিকা অন্যদের থেকে সামান্য বেশী। আর এই ট্রাক ড্রাইভার বন্ধুদের দলের পান্ডা হিসেবেও সকলেই তাকে মেনে নেয়।

নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ফরাসী নাট্যকার রোমা রোলাঁ তার লেখা ‘The People’s Theatre’ এ বলেছেন, “There is only one necessary condition for the emergence of a new theatre that the stage and auditorium should be open to the masses, should be able to contain a people and the actions of a people”. ‘ঘুম নেই’ দেখতে দেখতে অদ্ভুত ভাবে মনে পড়ে যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্রের নাট্যকার আর্থার মিলারের ‘Death of a Salesman’, আর সেই সমস্ত কাজ যেগুলো ডমিনেন্স ও হেজেমনি কে চ্যালেঞ্জ করে।

সৌরভ পালোধী নির্দেশিত এই নাটকে শ্রমজীবি মানুষের জীবন যাপন, সাধ আল্লাদ, কঠোর পরিশ্রমের মধ্যেও ছোট খাটো ব্যাপার নিয়ে মজা, এবং তীব্র স্পর্ধার আভাস পাওয়া যায়। গানের ভাষাও খুব তীব্র এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর।
প্রত্যেক বার চোখে জল এসে যায় যখন আখলাক (কৌশিক কর) তার দরাজ গলায় গেয়ে ওঠে, ‘শূন্যের পাশে ঘুরতে থাকে আর একখানি শূন্য’, আবার খুব উপভোগ্য হয়ে ওঠে যখন ঢপ কীর্তনের আদলে ওরা গেয়ে ওঠে ‘আমাদের বাল ছেঁড়া যায়, রাজায় রাজায় তাল পাকায়’… এই নাটকের আবহ ও সঙ্গীত করেছেন দেবদীপ মুখার্জি এবং গান যে এই নাটকের খুব তাৎপর্যপূর্ণ তা বলাই বাহুল্য।

যদিও ঘুম নেই নাটকটি ১৯৭০ এ লেখা, আজকের দিনে খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই অস্থির সময়ে, যখন বছরে এগারো হাজারের ওপর চাষী মারা যাচ্ছে, যখন পুঁজিবাদ সমস্ত ব্যবসানীতি ও সমাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করছে, যখন শ্রমজীবী মানুষের প্রান্তিক করে রাখা হচ্ছে, তখন এই আগুনের খুব প্রয়োজন। এই স্পর্ধা, এই স্ফুলিঙ্গ, মানুষের বুকে আগ্নেয়গিরি, আর চোখে রক্তকরবীর জন্ম দেবে। সলিল বাবুর কথা গুলো বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিল,  ‘ঢেউ উঠছে কারা টুটছে আলো ফুটছে প্রাণ জাগছে জাগছে জাগছে
গুরু গুরু গুরু গুরু ডম্বর পিনাকী বেজেছে বেজেছে বেজেছে, মরা বন্দরে আজ জোয়ার জাগানো ঢেউ তরণী ভাসানো ঢেউ উঠছে’। নাটকটি দেখতে দেখতে শূন্যের গান শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাচ্ছিল সমস্ত শিল্পীদের কথা যারা শুধু মাত্র প্রান্তিক মানুষ দের কথা বলে গেছেন, কাজে, ভাষায়, গণনাট্যে। মনে পড়ে যাচ্ছিল বিজন ভট্টাচার্য, শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, ঋত্বিক ঘটক, দেবব্রত বিশ্বাস, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, হারিন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ও আরো অনেকের কথা। মনে হচ্ছিল আমরা শুধু জন্মসূত্রে এই নাটক টি পেয়েছি, শুধুই জন্মসূত্রে আমরা এই মানুষ গুলোকে পেয়েছি, এঁদের কাজের মান রাখার দায়িত্ব আমাদের, এঁদের কাজ কে ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব আমাদের। এই প্রজন্মের একজন নাট্য পরিচালক এই কাজ টি এই ভাবে নিজের সব টুকু দিয়ে করেছে দেখে একটা শান্তি হলো, আবার একই সাথে জ্বলে উঠলো আগুন, একসাথে থাকার, একই সাথে আওয়াজ তোলার, তার সাথে দৃঢ় প্রত্যয়ে এলো সুস্থ সমাজ তৈরির অঙ্গীকার। এই অন্ধকার সময়ে সৌরভ পালোধী নির্দেশিত ‘ঘুম নেই’ খুব প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ, ভরসার আগুনের কথা বলে এই নাটক, বেঁচে থাকার কথা বলে এই নাটক, মানুষের অধিকার অটুট রাখার কথা বলে এই নাটক, আশার কথা বলে, যেমন কবীর সুমন তাঁর গানে বলেছেন, “আমি চাই সব্বাই যেন দিন বদলের পদ্য বলে…যদি বল চাইছি নেহাত চাইছি নেহাত স্বর্গ রাজ্য…আমি চাই একদিন হবে একদিন হবে এটাই গ্রাহ্য।”