মনে নেই সেটা আমার কত বছর বয়স, আমার মা বাবা একটা বিশেষ রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাসী। ওদের ই কিছু এক টা জমায়েতে আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন। ততদিনে নাম শুনছি কি সব অদ্ভুত মানুষদের..কি যেন নাম সব ম্যাক্সিম গোর্কি, নিকোলাই অস্ত্রভস্কি। আমার ওসব ভালো লাগেনাl বুঝি ই না কিছু। কি সব কঠিন বিষয় নিয়ে আলোচনা। তবে আমার আকর্ষণের জায়গা ছিলো একটা, মিটিং শুরুর আগে বা পরে অনেক সময় গননাট্য বা লেখক শিল্পী সংঘের ছেলে মেয়েদের সমবেত গান, নাটক, কবিতা পাঠ। কখনো কখনো তাতে যোগ দিতেন ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার। কি সুন্দর সব তাদের গান কি সহজ ভাবে তারা। কখনো গাইছেন ওরা জীবনের গান গাইতে দেয়না শিল্পী সংগ্রামী পলরবসন। কখনো আবার ভারতবর্ষ সূর্যের এক নাম। সেরকমই একটা সন্ধ্যা, ওরা মঞ্চস্থ করছিলেন কিছু একটা নাটক। নাটকের শেষ দৃশ্যে একটা ছেলে, যে প্রোটাগোনিস্ট তাকে মারার একটা দৃশ্য মানে ভালো ভাবে বলতে গেলে একটা মানুষকে শেষ করে দেওয়ার দৃশ্য চলছে। পরিকল্পিত মার্ডার আর কি। পিছন থেকে একদল ছেলেমেয়ের গলায় ভেসে আসতে থাকলো একটা গান ‘একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে রাজার দোহাই দিয়ে’।
আমি তখন জানতামনা এই গান টা কে লিখেছেন। প্রত্যেকবার শুনতাম ‘We shall over come some day’। এটা নতুন। এটাও যেন তেমনি একটা গানl খুব ভালো লাগছে কিন্তু বুঝতে পারছিনা কি গান এটা? শুধু ওই লাইন টা মনে খুব ব্যাথা দিয়েছিল ‘মানবপুত্র তীব্র ব্যথায় কহেন হে ঈশ্বর’ এই লাইন টা উচ্চারিত হওয়ার সাথে ওরা মারছিলো, মরে যাচ্ছিলো ছেলেটা এই গানের সাথেই। প্রহারের মাত্রার সাথে যেন সমানুপাতে বাড়ছিল সমবেত গান এর জোর। আর আমি ভাবছিলাম কি অদ্ভুত এই গান। কেমন গান এটা? এ গান কি মৃত্যুর কথা বলে? কোন দিন শুনিনি তো। দিন গেল, গান টা চাপা পড়ে গেল অনেকের ভিড়ে।
বেশ কয়েক বছর পর একবার মধুসূদন মঞ্চ, আমি তখন আরেকটু বড়ো ক্লাস সেভেন এইট কিছু একটা । বাবা একদিন একটা লোকের গান শুনতে নিয়ে গেলেন। বাবার দাবি ছিল উনি দারুন গাইছেন, চল। আমরা তিন জন। বাবা মা আমি, শুনছি। অনেক গুলো গান গাওয়ার পর হলের সবাই একটা গানের অনুরোধ করলেন। ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন। আর গাইতে শুরু করলেন, ‘একদিন যারা মেরেছিল তাঁরে গিয়ে’। পীযুষ কান্তি গাইছেন আর আমার কিশোর বেলায় সেই গান টা ফিরে আসছে শৈশবের চৌকাঠ পেরিয়ে। হাল্কা ঘিয়ে একটা পাঞ্জাবি, হাল্কা সাদা কালো চুল, আর এক অদ্ভুত দৃপ্ত ভঙ্গি। আমার সমস্ত কিছু তোলপাড় করে লোক টা গেয়েই গেলেন। জানিনা কেন আমার মনে হয়েছিল এই লোকটাকে কেমন যিশুর মতন মানে আমাদের জিসাস খ্রাইস্ট এর মতন দেখতে না? বার বার অনুরোধ আর বার বার উনি ওই গান ঘুরে ফিরে গাইছেন, গাইছেন। পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহের সমস্ত দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে গলা মিলাচ্ছেন তাঁর সাথে আর চোখ বুজে তিনি যেন সমাধিস্থ হয়ে দেখতে পাচ্ছেন গানের শরীর..সেই দিন সেই প্রেক্ষা গৃহে মনে হয়েছিল এই গান আর কোন মৃত্যুর গান নয়। মানুষের গান। আলোর গান। সেই The Man From Earth ছবিটার নায়ক কে মনে পড়েl যে দাবী করেছিলো তাঁর বয়স মানব সভ্যতার বয়সের সমান। সত্যিই তেমন মানুষ আছে কি না জানিনা তবু বার বার মনে হয় এই ভাবে কিছু কিছু গান আমাদের আলো দেখিয়ে যায় কিছু মানুষের হাত ধরে। শ্রান্ত, নিপিড়িত, বঞ্চিত মানুষের জীবনে হয়তো কোথাও একটু হলেও আশার সঞ্চার করে এই গান। যাতে মিশে যায় ল্যাটিন আমেরিকা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন যাতে মিশে যায় কারার ওই লৌহ কপাট থেকে, প্রান্তরের গান আমার। যাতে মিশে যায় গঙ্গা পদ্মার সাথে old man riverl আলোর গান। মানুষের গান।
সময় গেছে পীযুষকান্তি চলে গেছেন, বাবাও চলে গেছেন দু বছর হতে চললোl কিন্তু আজও সেই ছোট বেলার যীশুর সাথে দেখা হয় মাঝে মাঝে , গান শুনান তিনি আজওl আমি বাবাকে ও ডেকে আনি। গান শুনি শুনতে থাকি, দেখতে থাকি, ভাসতে থাকি আর মাঝে মাঝেই বলি প্লিজ ওই জায়গাটা আর একবার করবেন?
‘মানবপুত্র তীব্র ব্যথায় কহেন হে ঈশ্বর’।