রূপোলী পর্দায় সময়ের কথা – মাল্যবান আস

রবীন্দ্রনাথ তার সঙ্গীতের উৎপত্তি ও উপযোগিতা’য় বলেছেন –
“সঙ্গীতে এতখানি প্রাণ থাকা চাই যাহাতে সে সমাজের সহিত বাড়িতে থাকে, সমাজের বিবর্তনের সহিত পরিবর্তিত হইতে থাকে, সমাজের উপর নিজের প্রভাব বিস্তৃত করিতে পারে ও তাহার উপরে সমাজের প্রভাব প্রযুক্ত হয়।” চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও একথা সমানভাবে প্রযোজ্য। সিনেমা সময়ের কথা বলে। তার আগের ও পরের কথাও বলে। সমাজে ঘটে যাওয়া প্রতিমুহূর্তের গ্লানি-দুঃখ- বিষাদ-বিরোধ-স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের ছাপ সবসময় চলচ্চিত্র ধারণ করে এসেছে। সুদূর অতীত থেকে ঘটমান বর্তমানের সমস্ত সাদা-কালো-রঙিন মাইলফলক সযত্নে গুছিয়ে রাখে সিনেমা। অপর্ণা সেন পরিচালিত “ঘরে বাইরে আজ’’ ছবিটি, একথা আরও একবার নতুন করে আমাদের মনে করিয়ে দিল।
রবীন্দ্রনাথের “ঘরে বাইরে” উপন্যাস থেকে এই ছবি অনুপ্রানিত। হ্যাঁ, এই অনুপ্রানিত শব্দটাই ছবির একদম শুরুতে পরিচালক খুব সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন এবং সম্পূর্ণ ছবিটি দেখার পর দর্শক হিসেবে উপন্যাস থেকে নেওয়া অনুপ্রেরণার এক সার্থক জাস্টিফিকেশন খুঁজে পাওয়া যায়। বিশ্ব-চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী সত্যজিৎ রায় ১৯৮৪ সালে রবীন্দ্রনাথের “ঘরে বাইরে” উপন্যাস অবলম্বনে একই নামের একটি ছবি, ন্যাশনাল ফিল্ম ডিভোলোপমেন্ট কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া-র প্রযোজনায় তৈরি করেন। সত্যজিতের ‘ঘরে বাইরে’ সম্পূর্ণরূপে উপন্যাস নির্ভর, অপর্ণা সেনের ‘ঘরে বাইরে আজ’ প্রায় একদমই উপন্যাসের উপর নির্ভর করেনি বললেই চলে। অপর্ণা সেন তাঁর ছবির ক্ষেত্রে উপন্যাসের কিছুটা নির্যাস নিয়েছেন, কিন্তু ছবির গল্প, গঠন ও বিন্যাস পুরোপুরি আলাদা। হয়তো এখানেই অনুপ্রেরণা এবং অবলম্বন স্বতন্ত্রভাবে পৃথক হয়ে যায়।


‘ঘরে বাইরে আজ’ অপর্ণা সেনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ছবি। এই ছবি, পারিবারিক রাজনৈতিক পরিসর থেকে, বৃহত্তররূপে বর্তমান স্বদেশে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক দূষণের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে। নিখিলেশ, বিমলা বা বৃন্দা ও সন্দীপ – এই ছবির প্রধান তিন চরিত্র। নিখিলেশের চরিত্রে অভিনয় করেছেন এই সময়ের নাট্য ও চলচ্চিত্র জগতের খুবই শক্তিশালী অভিনেতা অনির্বাণ ভট্টাচার্য। বিমলা বা বৃন্দার চরিত্রে অভিনয় করেছেন তুহিনা দাস ও সন্দীপের চরিত্রে অভিনয় করেছেন বাংলা চলচ্চিত্রের আরেক শক্তিশালী অভিনেতা যীশু সেনগুপ্ত।

চিত্র: IndulgeExpress

বৃন্দার জন্ম একটি দলিত পরিবারে, তখন তার নাম ছিল বিমলা, পরবর্তীতে নিখিলেশের পরিবারে বৃন্দা বড়ো হয়ে ওঠে ও বয়সের বেশ কিছুটা তফাৎ থাকা সত্ত্বেও নিখিলেশ এবং বৃন্দার বিয়ে হয়। নিখিলেশ ও বৃন্দার দাম্পত্য জীবনের এক সুস্পষ্ট চিত্র এই ছবিতে আমরা খুঁজে পাই। দলিত পরিবার থেকে উঠে এসে উচ্চ-মধ্যবিত্ত একটি পরিবারে বড়ো হওয়া এবং সেই পরিবারের একমাত্র ছেলের সঙ্গে সংসার করার মধ্যে দিয়ে, পরিচালক বিমলাকে দিল্লিনিবাসী বামপন্থী সংস্কারক ও আলোকপ্রাপ্ত সাংবাদিক-সম্পাদক নিখিলেশ চৌধুরীর স্ত্রী বৃন্দা করে তুলেছেন। পরিচালক এই ছবিতে, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানসিকতার বিরুদ্ধে এক ধরণের প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সন্দীপ নিখিলেশের ছোটবেলা ও মূলত কিশোর বয়সের বন্ধু। একদা উগ্র বামপন্থী ও বর্তমানে চরম দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী এক বুদ্ধিজীবী। তার চরিত্রের বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যায় কিন্তু চরিত্রের গঠন একদমই জোরালো নয়। সন্দীপের রাজনৈতিক মননের কোন পরিষ্কার আঁচ পাওয়া গেল না ছবিতে এবং যে জন্য সন্দীপের অতীত জীবনের রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কেও দর্শক খুব একটা কিছু জানতে পারে না দর্শক। গল্পটা মূলত বর্তমান সময়ের উপর দাঁড়িয়ে। নিখিলেশ এবং সন্দীপের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান যতটা স্পষ্টভাবে ছবিতে তুলে ধরেছেন পরিচালক, ততটা স্পষ্টভাবে সন্দীপের অতীত জীবনের রাজনৈতিক অবস্থান তুলে ধরেন নি। নিখিলেশ এবং সন্দীপের স্মৃতি থেকে উঠে আসা কয়েকটা টুকরো-টুকরো বিছিন্ন ঘটনা ছাড়া সন্দীপ চরিত্রের অতীত বিন্যাসে আর কিছুই আমরা খুঁজে পাই না। উগ্র বামপন্থী থেকে একজন মানুষের চরম দক্ষিণপন্থী হয়ে যাওয়ার কারণ খুবই অস্পষ্ট র‍য়ে গেলো। ছবিতে নিখিলেশ ও বৃন্দার দাম্পত্য সম্পর্ক ছাড়াও আরেক ধরণের সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। সন্দীপ এবং বৃন্দার সম্পর্ক। এই দুটি সম্পর্কেই ভালো লাগা, খারাপ লাগা, চাওয়া-পাওয়ার বিষয় আছে। কিন্তু নিখিলেশ এবং বৃন্দার সম্পর্ক যতটা সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে, বৃন্দা এবং সন্দীপের সম্পর্ক ততটা সার্থকতা পায়নি। বৃন্দা এবং সন্দীপের সম্পর্ক গড়ে ওঠা, পূর্ণতা পাওয়া এবং সেভাবে দেখতে গেলে শেষ পর্যায়ে ভেঙে যাওয়া – পুরোটাই খুব বেশি রকমের অ্যাব্রাপ্ট।

চিত্র: The Times of India

এছাড়াও কেবলমাত্র যৌনতা দিয়ে দুটো সম্পর্কের এক ধরণের আলগা জাস্টিফিকেশন্‌ একই স্তরে করতে চেয়েছেন পরিচালক। যে জাস্টিফিকেশন্‌ আদতে খুবই সাজানো বা আর্টিফিশিয়াল লেগেছে। সম্পর্কের গঠন, বিন্যাস এবং ডিটেলিংয়ের দিক থেকে আরও অনেক বেশি মুন্সিয়ানা অভিপ্রেত ছিল পরিচালকের কাছ থেকে। ছবির সংলাপের মধ্যে দিয়েও পরিচালক অনেকবার চেষ্টা করেছেন বৃন্দা এবং সন্দীপের সম্পর্কের জাস্টিফিকেশন্‌ খুঁজে দিতে কিন্তু এক্ষেত্রেও তিনি খুব একটা সফল হন নি। প্রধান চরিত্রের অভিনেতাদের বাইরে অঞ্জন দত্ত, শ্রীনন্দা শঙ্কর ও ঋতব্রত মুখার্জির অভিনয় দর্শকের বিশেষভাবে নজর কাড়ে। অমূল্য-র চরিত্রে ঋতব্রত খুবই পরিশীলিত অভিনয় করেছেন। এই অমূল্য চরিত্রের সম্পূর্ণ বিন্যাসের মাধ্যমে অপর্ণা সেন তার ছবিতে বর্তমান যুব সমাজের এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন তুলে ধরেছেন।

এই ছবির সংগীত পরিচালক নীল দত্ত। সমগ্রিকভাবে এই ছবির সংগীত খুবই যথাযথ মনে হয়েছে। কিন্তু কয়েকটা জায়গায় সংগীত, সিনেমার দৃশ্য-রূপকে ভীষণভাবে ডমিনেট্‌ করছে। দৃশ্যকাব্য এবং সংগীতের সামঞ্জস্য বেশ কিছু জায়গায় খেই হারিয়েছে। ছবির চিত্রগ্রাহক সৌমিক হালদার। বেশ কয়েকটা সিকুয়েন্সে অপ্রয়োজনীয় ক্যামেরা মুভমেন্ট ছাড়া, সামগ্রিক চিত্রগ্রহণ বেশ পরিশীলিত। রবিরঞ্জন মৈত্রের সম্পাদনা ছবিটির বিন্যাস গতি-কে সফলভাবে বজায় রেখেছে। প্রত্যেকটি চরিত্রের মেক-আপ এক কথায় অসাধারণ। বিশেষত বৃন্দার মেক-আপ চরিত্র বিকাশের ক্ষেত্রে খুবই যথাযথ।


কিছুটা বাণিজ্যিক মোড়কে ঢাকা হলেও অপর্ণা সেন-এর ‘ঘরে বাইরে আজ’ একটি প্রতিবাদী ছবি। রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের মধ্যেও এক সাবলীল মানবিক স্পর্শ খুঁজে পাওয়া যায় । নিঃসন্দেহে এই ছবিতে প্রতিফলিত হয়েছে পরিচালকের নিজস্ব রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু সেই দৃষ্টিভঙ্গি কখনোই দর্শককে একরৈখিক রাজনৈতিক চিন্তায় মগ্ন করে না। ভারতবর্ষের সমকালকে খুবই আধুনিক রূপে সঞ্চিত করেছেন পরিচালক অপর্ণা সেন। “ঘরে বাইরে আজ’’- আসলে চলচ্চিত্রের রূপোলী পটে, বর্তমান সময়ের এক নিপুণ জলছবি।

প্রচ্ছদ: IMDB.com