ফুটফুট করছে জ্যোৎস্না। সামান্য বাতাস। পুকুরের জলে শিহর দেয়। পূর্ণ চাঁদের মুখ কাটাকুটি হয়ে শত শত রূপোর কুচির মত ভাসে। আশেপাশে নিঝুম গাছপালা। আলো আসে আলো যায়। একটা দুধসাদা ঘোড়া ডানা মেলে এইমাত্র উড়ে গেল ওই বন থেকে। তার চলে-যাওয়া কিছু জোনাকি হয়ে ঘুরঘুর করে।
এই সীমানা পেরিয়ে এলে সরু পথ পেয়ে যাই। ধুলোপায়ে উঠে আসি ছড়ানো উঠোনে। নিকোনো মাটি সাদা ঝকঝকে। একদিকে বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বাঁকানো গেট। সেখানে ঝেঁপে আছে বোগেনভিলিয়া। দুপাশে চলে গেছে যে বেড়া ঘন পাতাবাহারে তার বাঁশের পাতলা দেহ ঢেকে রাখা।
একটা ছোটো বাড়ি। মাথায় টিনের চাল। টিনের দেওয়াল। মাটির উঁচু বারান্দা।
এই উঠোন, এই মেঝে,এই বারান্দা একগোছা পাট গোবরজলে চুবিয়ে নিকোনো হয়। পাটের শক্ত তন্তু সহস্র ঘূর্ণিপাকের মতন সরু সরু রেখা ফেলে রাখে মাটির ওপর। সেখানে কুমোরে পোকা দেমাকি পা ফেলে ফেলে হেঁটে যায়। এই রূপোলি রাত্তিরে সেই শুভ্র মাটির এখানে ওখানে গাছের ছায়া কাঁপে।
ওই যে ঘরের জানালা,তার পাশেই উঠেছে গন্ধরাজের গাছ। এপাশে একটা কামিনী। বারান্দার ঢালু পাড় কোথাও কোথাও সন্ধ্যামালতীর ঝোপে ঢাকা। সেখানে লাল,সাদা,হলদে ফুলেরা চুপ করে আছে।
বারান্দায় টিনের চাল তার ঢেউখেলানো ছায়া ফেলেছে। সেই ঢেউয়ের রেখার ওপারে আঁধার এপারে আলো। এই আলো-আঁধারিতে একজন মানুষ। তার দুটি পা ছড়িয়ে আছে নরম আলোর ভেতর। একটা হালকা রঙের শাড়ি বেড় দিয়ে রয়েছে পা-দুখানি। পেছনের অন্ধকার থেকে ভেসে আসছে সুর।
“পূর্ণ চাঁদের মায়ায় আজি ভাবনা আমার পথ ভোলে। “
বাতাসে কুসুমগন্ধ তীব্র হয়। বনের থেকে সেই মায়াজোনাকিরা আসে। সুরের ওই আঁধার ছুঁয়ে ছুঁয়ে ঘরে ঢুকে পড়ে। একটা লণ্ঠন একেবারে কমিয়ে খাটের তলায় রাখা। খাটে বসে আছে আরেকজন মানুষ। সে মুখ ফিরিয়ে আছে জানালার দিকে। সেদিকেই গন্ধরাজের গাছটা। তারপর একটু উঠোন,তারপর পাতাবাহারের বেড়া পেরিয়ে একটা আম গাছ, তারপরেই বন। পুকুর।
গানের সুর এইসবের ভেতর ঘুরে বেড়ায়।
“আলোছায়ার সুরে অনেক কালের সে কোন দূরে,ডাকে আ য় আ য় আয় বলে। “
গাছের ঘন পাতার অন্দরে অন্দরে পাখিদের ঘুমের গায়ে টোকা দিয়ে দিয়ে যায় সেই সুর। কিছু আলগা হয়ে আসা পাতা খসে গিয়ে ধীরে সুস্থে মাটিতে নেমে আসে। পুকুরের ওইধারে বুনোঝোপের আড়ে একটা গর্তের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে দুটো শেয়াল। তারা কাজ ভুলে চুপ করে থাকে খানিক।
এই বন আজ কিছু অদ্ভুত। নীল আলো জ্বেলে সেইসব জোনাকিদের কেউ কেউ জলের ওপর উড়ে যাচ্ছে।
বাতাসটা জোর হয়। পুব আকাশের এক কোণে একটু কালো মেঘ। হাওয়ায় গান আরও ব্যাকুল মনে হয়। ঘরের আঁধারে মানুষ চুপ করে সেই বসে আছে। বাইরের আঁধার থেকে গান উঠে আসছে তখনও।
“যেথায় চলে গেছে আমার হারা ফাগুনরাতি,সেথায় তারা ফিরে ফিরে খোঁজে আপন সাথি।”
গন্ধরাজের গাছ এই জ্যোৎস্নায় পেয়েছে বৃষ্টির ইঙ্গিত। তার চঞ্চলতা ক্রমেই বেড়ে উঠছে হাওয়ায়। ছোটো ছোটো লাল,হলদে ফুলের তলা দিয়ে সরীসৃপের মতন চলে যায় সেই হাওয়া। মাটির গন্ধ বাতাসে। বহুদূরে কোথাও খুব বৃষ্টি নেমেছে। সে খবর একটু একটু করে জানিয়ে দিচ্ছে এই জোছনা।
এমন বাতাসে কবেকার কথা যেন মনে আসে। তখন দ্বৈতকণ্ঠের সুর উঠে গাছে গাছে পাতায় পাতায় ছোটো ছোটো পাখিদের ছোট্ট ছোট্ট বুকে জাগিয়ে দিত আনন্দ-আবেশ। অসুখ খিড়কিদুয়োর দিয়ে এসে চুরি করে নিয়ে গেছে একটি কণ্ঠ। চিরকালের মত। অন্যটি ব্যাকুলতায় চলেফিরে বেড়ায়। তার ব্যথা এমন করে বনভূমির আনন্দ-স্মৃতির ভেতর কাঁপন দিয়ে যায়।
ব্যথার তরঙ্গ উঠে উঠে তটবন্ধ ভেঙে যায় আপাত-অনন্ত সুখের। চিরহরিৎ বৃক্ষলতাগুল্ম তার অনির্বচনীয় নরম দিয়ে একটু একটু করে কোল পেতে দেয়। ভাঙনের সমস্ত দিয়ে হু হু ঢুকে আসছিল যে জল,বেদনাবিধুর, তার সিক্ততায় ফনফনিয়ে মাথা তোলে শিশু উদ্ভিদ। কাঁচা সবুজের তুলতুলে আদরে ব্যথা আর অসহনীয় থেকে যেতে পারে না লজ্জায়। সে বড় হয় সেইসব নবীন গাছের সঙ্গে সঙ্গে।
সেই প্রণয়ীযুগল অবাক হয়ে দ্যাখে এক নব্য যুবাকে চিরসবুজের ভেতর। উদ্ভিদস্পর্শ পেলে যৌবন এসে পড়তে বড় দেরি হয় না। এই সেদিনও যে অবুঝ শিশু অহেতুক জেদে ব্যতিব্যস্ত করেছে ওদের,ভেঙে দিয়েছে যৌথসুখের তটরেখা,সে তার ‘ব্যথা’ ডাকনামটি যেন ভুলেই গেছে। কী গাঢ় দুই চোখ তার এখন,মুখে শান্ত একটু হাসি।
এই আশ্চর্য যুবক কত কী কাণ্ড করতে লাগল বনভূমিতে।
মনকেমনিয়া সুর যখন একলা কণ্ঠে ঘুরে ঘুরে বেড়ায় বীথিপথে,বুড়ো অশথ গাছের আড়ালে শুভ্র দুই ডানা মুড়ে বিশ্রাম নিতে নেমে আসে একটি ঘোড়া। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করবে না ভয়ে সে ওই মহাদ্রুমের কাছে আশ্রয় নেয়। চুপ করে থাকে। আর তার অপার্থিব ডানার বাতাস লেগে শতাব্দীপ্রাচীন এই বৃক্ষঋষি তাঁর বুকে জেগে উঠতে দ্যাখেন দুটি কচি সবুজ পাতা।
এই একটু আগে সে ফিরে গেছে রুপোলী আকাশে। তার অনুপস্থিতি কিছু জোনাকির মতন নীল আলো জ্বেলে বনভূমির ইতিউতি বেড়াচ্ছে। আর সেই যুবক,হাতের ওপর মাথা রেখে ঠেস দিয়ে বসে আছে একটি গাছে। চোখদুটি সুরের আবেশে বুজে রাখা। বড় বড় আঁখিপল্লব একটু কেঁপে কেঁপে ওঠে। তার ধূলিমলিন পায়ের কাছে মাথা দোলায় একটি ঘেঁটুফুলের চারা।
বর্ষাসম্ভব হাওয়া এখন চারপাশে। অশথ গাছ থেকে সে-হাওয়া কিছু পুরনো পাতা ফেলে দিল মাটিতে। পুকুরের ওপর দিয়ে চলে যাবার সময় ভেঙে গেল মাছেদের ঘুম। আর সেই যুবকের বুক থেকে সরিয়ে দিল শুভ্র উত্তরীয়র আড়াল।
যুবক উঠে দাঁড়ায়। সুর থেমে গেছে। গভীর এক নিস্তব্ধতায় হু হু করে ঢুকে আসছে বাদল বাতাস। সে বন থেকে বেরিয়ে আসে। পা রাখে প্রণয়ীদের উঠোনে।
বারান্দায় এখন দুটি মানুষ। আবছায়া। একজন মেলে দিয়েছে কাঁধ, আরেকজন রেখেছে মাথা। যুবক পূর্ণ চোখে সেই দৃশ্য দেখে।
বনের থেকে শুকনো পাতা উড়ে উড়ে যাচ্ছে ওদের দুজনের দিকে। ঘরের দরজা শব্দ করে খুলে গেল,বন্ধ হল দু’বার। যুবক নিজেকে আড়ালে রেখে আমগাছটির শাখা ধরে চেয়ে থাকল ওদের দিকে। অথচ ওর মিষ্টি দেহগন্ধ বহন করে নিয়ে গেল উতল হাওয়া। তার উপস্থিতি আরও নিবিড় করল সেই যুগলকে। কারও মুখে একটি কথা এল না। একজন হাতের বেড় দিয়ে আরও বুকের কাছে টেনে নিল অপরজনকে।
যুবক এইসময় বৃক্ষতলে দাঁড়িয়ে নিজের নামটি মন্ত্রের মতন উচ্চারণ করল তিনবার,
দুঃখ.. দুঃখ.. দুঃখ..