মাদুর বুনন কথা – সম্রাট ঘোষ

“একদিন গভীর রাতে চাঁদ ওঠে, গোবর নিকানো আঙিনায় মাদুর পেতে সাজু রূপাইয়ের কোলে শুয়ে রয়, তাই একসময় বাঁশির বাজনা থেমে যায়। কারণ যাকে শোনানোর জন্য রূপাই এতদিন বাঁশি বাজিয়েছে, সেই মানুষটি এখন তারই ঘরে।” পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের আখ্যানকাব্য “নকশী কাঁথার মাঠ” রচনায় এইভাবেই মাদুরের প্রসঙ্গ উঠে আসে। তাছাড়া অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “বাংলার রোজকার কাজের জিনিসেও লেগে থাকে শিল্পের ছোঁয়া। মাদুর তার একটা চমৎকার উদাহরণ”।

মাদুর শিল্পের মূল পীঠস্থান

মেদিনীপুরের মাদুরের প্রসিদ্ধি সুপ্রাচীন। এখানকার মানুষের অন্যতম প্রধান জীবিকা মাদুরকাঠি চাষ ও বুনন। পূর্ব মেদিনীপুর ও পশ্চিম মেদিনীপুরের বিভিন্ন অঞ্চল জুড়ে প্রায় ১০,০০০ শিল্পী মাদুরশিল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই এলাকাগুলির মধ্যে ভগবানপুর, সবং, পটাশপুর অন্যতম। মাদুর শিল্পের মূল পীঠস্থান পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর হলেও, উত্তর ও দক্ষিন ২৪ পরগণার বেশ কিছু জায়গায়, কোচবিহারে, বীরভূমের শ্রীনিকেতনে এবং হাওড়া জেলার উদয়নারায়ণপুরে মাদুর কাঠির চাষ হয়ে থাকে।

মাদুরের উৎপত্তি ও মাদুরকাঠির বৈশিষ্ট্য

বাঙালির নিদ্রা থেকে অতিথিসেবা সবেতেই মাদুর এর ব্যবহার অপরিহার্য। নবাবী আমলে একে বলা হত ‘মসলন্দ’। মাদুর বাংলার একটি গার্হস্থ্য শিল্প। সম্ভবত মাদুর কথাটির উৎপত্তি সংস্কৃত শব্দ ‘মন্দুরা’ থেকে। মাদুরের মূল উপাদান এক ধরনের তৃণ- সাধারনত যা মাদুরকাঠি নামে পরিচিত। মাদুরকাঠি সাধারনত, সরু, গোলাকার, দৈর্ঘ্যে চার হাত বা একটু বড়, কোনো পাটি থাকে না বা শাখা প্রশাখাও হয় না। তৃণ শীর্ষে চার পাঁচটি ধারালো পাতা থাকে।

মাদুরকাঠি চাষের পদ্ধতি


চাষের জন্য দোয়াশ মাটি সর্বশ্রেষ্ঠ হলেও বালি ও এঁটেল মাটিতেও মাদুরকাঠি চাষ হয়ে থাকে। কাঠির রঙ হলুদ, চাঁপাফুলের রঙ বা সবুজ হয়ে থাকে। চাষের আদর্শ সময় চৈত্র-বৈশাখ মাস। ক্ষেত থেকে মাঘ মাসে তুলে আনা মূলগুলি ছায়ায় রাখা হয় কিংবা পুকুর ধারে জল ছিটিয়ে ঢাকা থাকে। চার থেকে পাঁচদিন পর তা থেকে অঙ্কুর বের হতে দেখা যায়। জল জমে না এমন জমিতে লাঙল দিয়ে ও মাটি গুঁড়ো করে জমি কে চাষের উপযুক্ত করে তোলা হয়। ছয় ইঞ্চি করে সার কেটে দুটি মূল পরস্পরের এক ইঞ্চি দূরত্বে বসিয়ে মাটি চাপা দেওয়া হয়। দিন দশেকের মধ্যে বৃষ্টি না হলে সেচ দিতে হয়। এক সপ্তাহের মধ্যেই গাছ থেকে মূল বেরিয়ে আসে। আশ্বিন-কার্তিক মাসে কাঠি গোড়া থেকে কেটে নেওয়ার পর কাঠির মাথা সমান করে সাজিয়ে মাথা থেকে পাতা কেটে নেওয়া হয়। প্রতিটি কাঠি ২-৩-৪ ভাগে ভাগ করে কেটে নিয়ে ২ দিন রোদে ফেলে বাঁধাই করে বেঁধে তোলা হয়।

মাদুরকাঠি বুনন

মাদুর কাঠির চাষ করেন পুরুষ আর মাদুর বোনেন মহিলারা। এইভাবেই দুটি মনন জুড়ে, প্রকাশ পায় একটি রঙিন শিল্প। যৌথ উদ্যোগে সংসারতরী বইতে থাকে আপন গতিতে। বাংলার মাদুর সাধারণত তিন ধরনের- একহারা, দোহারা আর মসলন্দ। তবে আমরা যে ধরনের মাদুর দেখি কার্যত তার বুনন দু’রকমের। যথা- একহারা ও দোহারা। একহারা দু’টি কাঠি সুতোর উপর নিচে পরানো হয় পর্যায়ক্রমে। আর দোহারার দু’টি কাঠি দু’টি দড়ির ওপর নিচে পরানো হয়। তবে ভৌগোলিক এলাকা ভেদে একহারা আর দোহারা মাদুর বুননের তারতম্য লক্ষ্য করা যায়।
শিল্পীর হাতে বোনা মাদুরের রং-বাহারি নকশা যেমন- পাখি, চাঁদ-তারা, কলকা, পান পাতা দেখলে মন ভরে যায়। মাদুরের নকশায় আবার হাজির হয় বাংলার পৌরাণিক গল্প। কখনও থাকে রাধা-কৃষ্ণের লীলা, কখনও বা রাম-রাবণের যুদ্ধ।

মাদুরকাঠি রঙের পদ্ধতি


মাদুরের নকশা অনুসারে যতটুকু অংশ রং করার দরকার হয়, সেই অংশটুকুর দুধারে ভাল করে বাঁধেন কারিগরেরা, তার পর সেদ্ধ করে নিতে হয় কম করে আট ঘণ্টা। রং পাকা করার সময় নুন আর তেল ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মূলত ভেষজ রং ব্যবহার হয়ে থাকে মাদুর শিল্পের ক্ষেত্রে।


বাংলার মাদুরের স্বীকৃতি


মেদিনীপুরের গর্ব তথা বাংলার গর্ব মাদুর আজ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। চিরাচরিত মাদুরের ব্যবহার ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে এখন শিল্পীরা তৈরি করছেন রঙিন কাঠি ও সুতোকে তাঁতযন্ত্রে বুনে নানা আকার আকৃতির ব্যবহারযোগ্য আকর্ষণীয় জিনিস। এই শিল্প বর্তমানে অর্জন করেছে “CRAFT MARK” যা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে বিশ্বস্ততা ও গুণমানের প্রতীক। পশ্চিমবঙ্গ খাদি ও গ্রামীণ শিল্প পর্ষদ- এর মাদুরকাঠি শিল্পীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প, মাদুর শিল্পীদের দক্ষতাকে সরাসরি বাজারে বিপণনের সুযোগ এনে দিয়েছে, গড়ে উঠছে মাদুর শিল্পীদের সমিতি সম্পদ কেন্দ্র। মাদুর শিল্পকে আগামী দিনে সুদৃঢ় অর্থনৈতিক বুনিয়াদের ওপর দাঁড় করানোই এই কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য।

প্রচ্ছদ ও অন্যান্য ছবি : সম্রাট ঘোষ