প্রজাতন্ত্রের সংকট এবং দুটি ভারতীয় ছবি – অভীক সরকার

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আকাশে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছে চিল। আশেপাশের প্রায় সব গাছের সবুজ রঙ ঢেকে দিয়ে বসে আছে শকুনেরা। আকাশের কোথাও উজ্জ্বল রঙ নেই এতটুকু।

এইসব পাখিরা এখন নেমে আসতে শুরু করেছে গড়ের মাঠের দিকে। মাঠের ধারে ধারে কিছু বড় বড় গাছ। তাদের কোনও কোনওটার শাখা থেকে ঝুলে আছে মানুষের মৃতদেহ।

একটা ছোটখাটো ট্রাক চলেছে রাস্তা দিয়ে। সেখানে আলুর বস্তার মতন একটার ওপর আরেকটা তার ওপর আরেকটা এইভাবে চাপানো আছে লাশ। কারও হাত কারও পা বেরিয়ে আছে গাড়ির বাইরে,ডালা বন্ধ করা যায়নি। মাথার চুল এলোমেলো,বুক থেকে খসে গেছে আঁচল;লুটোচ্ছে মাটিতে,সামনের দিকে দুটো হাত বাড়িয়ে দিয়ে উন্মাদিনীর মতন সেই ট্রাকের পিছু পিছু ছুটছে এক রমণী।
মাথায় ফেজ টুপি,গায়ে কুর্তা,একটি বছর দশেকের ছেলে হাত জোড় করে কেঁদে কেঁদে কিছু বলছে আর তার দিকে হাতে তরোয়াল,কপালে সিঁদুরের টীকা,জ্বলন্ত চোখে এগিয়ে আসছে জনাদশেক লোক। ছেলেটির কান্না ওদের ক্রোধে যেন ঘৃতাহুতি দিল। একজন আচমকা ছুটে এসে তার হাতের তরোয়ালটি বসিয়ে দিল ওই কচি বুকে।

প্রাণভয়ে রাস্তা দিয়ে ছুটছে এক তরুণী,মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখে নিচ্ছে কিছু,এই অন্যমনস্কতায় রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা কাচের টুকরোয় কেটেকুটে যেতে লাগল তার নরম দুটি পায়ের পাতা। আলতার সঙ্গে মিশে গেল রক্তস্রোত। যন্ত্রণায় মেয়েটি পড়ে গেল হুমড়ি খেয়ে। এই সময় মাথায় ফেজ টুপি,গায়ে কুর্তা,পরনে লুঙ্গি,জনাদশেক লোক ছুটে এল সেখানে। চুলের মুঠি আর পায়ের গোছ ধরে তারা মেয়েটিকে হিঁচড়ে তুলে ফেলল মাথার ওপর। তারপর তাকে নিয়ে লোফালুফি খেলতে খেলতে ঢুকে পড়ল পাশের একটা অন্ধকার গলিতে।

বুকের কাছে এক হাতে আঁকড়ে ধরা পুতুল,অন্য হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়ে একটি অন্ধ শিশু কাতর কন্ঠে ডাকছে তার ‘নানা’কে। শিশুটির পেছনে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে একটি চালাঘর।  
      

Hey Ram ছবিতে কমল হাসান ও শাহরুখ খান


১৯৪৬ সালের কলকাতা শহর। ওপরের এই খণ্ড খণ্ড দৃশ্যগুলি ওই বছরেরই আগস্ট মাসের মাঝামাঝি সময়ের। ভারতে তখন দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল,জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ। বাংলায় চলছে মুসলিম লীগের শাসন,প্রধানমন্ত্রী(তখন মুখ্যমন্ত্রী বলা হত না) শেখ সোহরাবর্দি। ভারত সেসময় রুদ্ধশ্বাসে এগিয়ে যাচ্ছে স্বাধীনতার দিকে এবং ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যাবার দিকেও।

মুসলিম লীগ বহুদিন আগে থেকেই দাবি তুলে যাচ্ছে পৃথক মুসলমানপ্রধান রাষ্ট্র পাকিস্তান গঠনের পক্ষে। লীগ নেতা মুহম্মদ আলি জিন্না জাতীয় কংগ্রেসকে একটা হিন্দুদের রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়া আর কিছুই মনে করেন না। এদিকে ব্রিটিশ শাসক ভারত ছেড়ে চলে যাবার আগে তার শাসনক্ষমতা এমন একটি দলের হাতে অর্পণ করতে চায় যাদের মেনে নিতে দেশের একটা বিরাট অংশের মানুষের কোনও আপত্তি থাকবে না। ব্রিটিশ রাজের এই বক্তব্যের পেছনে একটা সূক্ষ্ম চালাকি ছিল। সেই সময় ভারতের আইন সভায় কংগ্রেসের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে চিহ্নিত হয় মুসলিম লীগ অর্থাৎ তাদের পক্ষের জনসমর্থন একেবারেই অগ্রাহ্য করার মতন নয়। কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা গেলে একটা তীব্র প্রতিক্রিয়া আসবে এবং বিপরীত চিত্রটিও আলাদা নয়। ব্রিটিশরা সেটা জানত। তাছাড়া লীগের পাকিস্তান-দাবিরও তখনও কোনও সুরাহা হয়নি। জিন্না এই সময়,অর্থাৎ ’৪৬ এর ১৬ই আগস্ট ডাক দিলেন প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বা ডাইরেক্ট অ্যাকশনের। তিনি অনেকটা আলগাভাবে বললেন,এই সংগ্রামে কোনও রক্তপাত হবে না। সেই দিন বিকেলে কলকাতার একটা জনসভায় লীগের একজন নেতা আবুল হাসিম জিন্নার কথার রেশ টেনে বললেন,এই সংগ্রাম আসলে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে। তাঁর বক্তব্যেও কোনও স্পষ্টতা নেই।
তার পর থেকেই কলকাতায় একের পর এক ঘটতে শুরু করল এই লেখার শুরুতে বর্ণিত ঘটনাগুলি। ব্রিটিশরা শর্ত দিয়েছিল দেশের একটা বিরাট সংখ্যক মানুষ যাদের সমর্থন করবে না তাদের হাতে ক্ষমতার হস্তান্তর তারা করবে না। এই ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ভয়াবহতার মাধ্যমে জিন্নার মতন প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধিমত্তার অধিকারী একজন নেতা মুসলমানরাই যে সেই বিরাট সংখ্যা এবং তাদের জন্য পাকিস্তান গঠিত হওয়া যে কতখানি প্রয়োজনের এই ব্যাপারটা প্রমাণ করতে গিয়ে ব্রিটিশদের কূট চালে ধরা পড়ে গেলেন এবং সেটা বুঝতেও পারলেন না। সেই ১৯০৫ সালে লর্ড কার্জন ভারতকে হিন্দু আর মুসলমানে ভাগ করে দিতে পারলে শাসন করতে সুবিধে হবে বলে যে উসকানি দিতে আরম্ভ করেছিলেন সেটা তখন ঠেকানো গেলেও এই ৪২ বছরের মধ্যেই যে সেটা শেষমেশ হাসিল হয়ে যেতে চলেছে সেটাও জিন্নার মাথায় ঢুকল না।

Hey Ram ছবির একটি দৃশ্যে কমল হাসান ও রানি মুখার্জি

                                    ২
১৯৪৬ সালের ডাইরেক্ট অ্যাকশন ঘোষিত হবার দু একদিন আগে কর্মক্ষেত্র থেকে কলকাতায় তাঁর বাড়িতে ফেরেন প্রত্নতত্ত্ববিদ সাকেত রাম। তিনি হলেন Hey Ram ছবিটির কাহিনীর মুখ্য চরিত্র। ছবিতে এই চরিত্রে দেখা যায় কমল হাসানকে। ছবিটির নির্মাতাও তিনিই।

বাড়িতে তাঁর বাঙালি স্ত্রী অপর্ণা(রানি মুখার্জি) একাই থাকেন। অপর্ণার মতন এরকম জীবন ও যৌবনরসে ফুটন্ত একটি মেয়েকে প্রায় উন্মাদের মতনই ভালোবাসেন সাকেত রাম। অপর্ণা ছবি আঁকে কত সুন্দর,জীবনানন্দের তুলনামূলক অপ্রচলিত কবিতাও যখন বলে যেতে পারে গড়গড় করে তখন বুঝতে অসুবিধে হয় না যে মেয়েটির পড়াশোনার রুচিটিও বেশ উঁচু তারে বাঁধা। রাম এবং অপর্ণার কিছু প্রণয়ের দৃশ্য সুরযোজনায় প্রায় স্বর্গীয় করে তোলেন মায়েস্ত্রো ইল্লাইয়ারাজা।

এই মনোহরণ প্রেম এবং ছবির শুরুর দিকে সাকেত রাম,আমজাদ(শাহরুখ খান) আর লালওয়ানি(সৌরভ শুক্লা) এই তিনজনের বন্ধুত্বের হুল্লোড় তৎকালীন ভারতে ঘনিয়ে ওঠা অস্থির রাজনীতি এবং সাম্প্রদায়িক বিষের ধোঁয়া থেকে কিছুক্ষণের জন্য আমাদের নিয়ে যায় একটা ফুল্ল প্রান্তরে।

ছবিটি শুরু হয় ১৯৯৯ সালের ৬ই ডিসেম্বর,অতিবৃদ্ধ সাকেত রামের মৃত্যুশয্যার দৃশ্য দিয়ে। দর্শককে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় সেই দিনটিতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসলীলার সাত বছর পূর্ণ হচ্ছে। আমরা আবছাভাবে খানিকটা আঁচ করতে পারি ছবিটির কাঙ্ক্ষিত যাত্রাপথ এবং লক্ষ্য।

শুধু এই সিঁদুরে মেঘের আভাসটুকু দেখিয়ে দিয়েই ছবিটি ঘুরে যায় ফ্ল্যাশব্যাকের দিকে। একধাক্কায় ৫৩ বছর পিছিয়ে গিয়ে আমাদের সামনে ফুটে ওঠে ’৪৬ এর সেই দোলাচল। অর্থাৎ আমাদের কাছে একটা অবকাশের দরজা প্রথমেই খুলে রেখে দেওয়া হয় যার চৌকাঠের এপারে এবং ওপারে আমরা অর্ধশতাব্দী আগের এবং পরের দুটি অস্থির সময়কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারি। বলা বাহুল্য,সিনেমায় এই পদ্ধতিটি নতুন নয়। এখন তো নয়ই,Hey Ram যখন মুক্তি পায়,সেই ২০০০ সালেও নতুন ছিল না। তবুও,পদ্ধতিটির আবেদন এবং চিরনবীনতার দাবি আমরা অস্বীকার করতে পারি না,বিশেষত,এই ধরনের ছবির ক্ষেত্রে,যে ছবিগুলি বারবার দেশের কোনও সংকটের সময়ে তন্ন তন্ন করে ফিরে দেখার মতন নথি হিসেবে গ্রাহ্য হতে পারে।

বন্ধুত্ব এবং প্রেমের কুসুমকীর্ণ অঙ্গন পার হয়ে আসতে আসতে সাকেত রাম হতবুদ্ধির মতন এসে দাঁড়ালেন ১৬ই আগস্টের সেই অভিশাপের মধ্যে। সেইসব রক্তাক্ত কুনাট্য ঘটে যেতে লাগল তাঁর চোখের সামনেই।

অসহায়ের মতন তাঁকে এর একটা অংশ হয়ে যেতে হল। ঘরে ফিরে তিনি দেখলেন একটা বীভৎস দৃশ্য। কয়েকটি মুসলমান যুবক পাজামার দড়ি বাঁধতে বাঁধতে তাঁর ঘর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে। বিছানায় রক্তাক্ত অবস্থায় ছটফট করছে অপর্ণা।

সাকেত রাম হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। তাঁর সেক্যুলার সত্তা,তাঁর প্রেম,তাঁর বন্ধুত্ব সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যায়। স্ত্রীর ভয়ংকর মৃত্যু তাঁকে নামিয়ে আনে ছিন্নভিন্ন পথেঘাটে।
গোটা কলকাতা তখন জ্বলছে। আর ৭২ ঘন্টার মধ্যে হিন্দু মুসলমানের সম্মিলিত মৃত্যু ছাপিয়ে যাবে ৪০০০-এরও বেশি। এক লক্ষেরও বেশি মানুষের মাথার ওপর থেকে সরে যাবে ছাদ।

সাকেত রাম তখন রক্তমাখা জামাকাপড়ে হাতে রিভলভার নিয়ে খুঁজে চলেছেন অপর্ণার হত্যাকারীদের। হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার ব্যাপারটা তখনও ভালো করে তাঁর অনুধাবনে আসেনি। স্ত্রীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে হবে,এটাই তখন তাঁর একমাত্র চিন্তা। হত্যাকারীদের একজনকে তিনি চিনে ফেলেছিলেন,তাঁদের পারিবারিক দর্জি আলতাফ না?

বেশিক্ষণ না,খানিক পরেই আলতাফকে খুঁজে পেয়ে রাম তাকে শেষ করে দেন।

                                       ৩
১৯৪৬ এর এই হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা শুরু হল কলকাতায়,তারপর আগুনের মতন দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে যেতে লাগল আরও পুবদিকে। চট্টগ্রাম,ময়মনসিংহ,বরিশাল। নোয়াখালিতে হিংসার এই আগুন আরও লেলিহান হয়। সেখান থেকে ছুটে যায় আরও ভয়াল রূপ নিয়ে বিহারের দিকে,তারপর হিংস্র দানবের মতন ছিঁড়েখুঁড়ে খেতে থাকে পঞ্জাবকে। শুধু পঞ্জাবেই মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়ে যায় ছ’লাখ।

এইসব হানাহানির খবর পেয়ে সব ছেড়েছুড়ে ঘটনাস্থলগুলিতে ছুটে ছুটে যেতে লাগলেন সাতাত্তর বছর বয়সের এক বৃদ্ধ। তাঁর নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। সাত সপ্তাহের সেই সফরে তিনি ১১৬ মাইল পথের বেশিরভাগটাই হাঁটলেন খালি পায়ে। বাংলার গ্রামে গ্রামে হিন্দুদের সান্ত্বনা দিতে দিতে চললেন,কেননা সেসব জায়গায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল হিন্দুরাই। বক্তৃতা করলেন প্রায় একশোটার মত। এরপর গেলেন বিহার,সেখানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছিল মুসলমানদের। সেখান থেকে দিল্লি। দিল্লিতে তখন পঞ্জাব থেকে শয়ে শয়ে উদ্বাস্তু হিন্দু ও শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ এসে ভিড় করছে। তীব্র প্রতিশোধের আগুনে জ্বলছে তারা। গান্ধী তাঁদের শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন,কেননা দিল্লিতে তখন প্রচুর মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষের বাস,যাদের মধ্যে অনেকেই ভারতবর্ষ ছেড়ে যেতে চায় না,পাকিস্তানের প্রতি যাদের কোনও আগ্রহ নেই।  তিনি হিন্দু শিখ মুসলমান সবার কাছে আবেদন করলেন যেন তারা অতীত ভুলে গিয়ে দ্রুত শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে।

ছবিতে সাকেত রাম আলতাফ এবং তার সহযোগী আরও দু’একজন মুসলিম মানুষকে হত্যা করার পর শ্রীরাম অভয়ংকর(অতুল কুলকার্নি) নামে এক হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতার সাক্ষাৎ পান। সাকেত রাম তখনও প্রকৃতিস্থ নন। সেটা টের পেয়ে এবং তিনি যে স্ত্রীর হত্যাকারী নয়,বরং কয়েকটি মুসলিমকেই হত্যা করেছেন এই দুটি বিষয়কে হাতিয়ার করে অভয়ংকর তাঁর মনের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয় উগ্র হিন্দুত্ববাদের বিষ। তার সাথে সাকেত রামকে প্রায় দীক্ষিত করে ফেলে একটি মন্ত্রে। সে তাঁকে বোঝায়,এই যে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা,এর জন্য কে দায়ী আপনি জানেন? নেহরু? না। জিন্না? না। সোহরাওয়ার্দি? না। এর জন্য দায়ী একমাত্র মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। এই ভয়ংকর দাঙ্গা সত্ত্বেও সেই বৃদ্ধ এখনও ভারতে হিন্দু মুসলমানের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের আবেদন থেকে সরে আসছেন না। আসুন,আমরা তাঁকে হত্যা করার পুণ্যমন্ত্রে দীক্ষিত হই। 

                                     ৪
দাঙ্গা কিছুটা প্রশমিত হলে সাকেত রাম ফিরে যান দক্ষিণ ভারতে,তাঁর বাড়ি। পরিবারের জোরাজুরিতে তাঁকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হতে হয় পুণর্বিবাহে। অপর্ণার স্মৃতিপুঞ্জের ওপর স্নিগ্ধ কোমল একটি ছায়া পড়ে নবোঢ়া মৈথিলীর(বসুন্ধরা দাস)। দাঙ্গা থেকে দূরে,উগ্র হিন্দুত্বের মন্ত্র থেকে দূরে সাকেত রাম কিছুদিন যাপন করেন একটি অনিচ্ছাকৃত দাম্পত্যে কীভাবে নিজেকে সংযুক্ত করবেন,সেই টানাপোড়েনে।

খুব বেশিদিন সেটা স্থায়ী হয় না। সস্ত্রীক তিনি আসেন মহারাষ্ট্রে এবং সেখানে দ্বিতীয়বার মিলিত হন অভয়ংকরের সঙ্গে। সে তাঁর সাথে আলাপ করিয়ে দেয় এক মারাঠা মহারাজার। সেই মহারাজাও রোজ আহ্নিকের মতন জপ করেন গান্ধীহত্যার মন্ত্র।

সাকেত রামকে অভয়ংকরসমেত তিনি নিয়ে আসেন একটি গুপ্ত কক্ষে। সেখানে সাজানো আছে নানারকমের অস্ত্র। একপাশের দেওয়ালে টাঙানো হিটলারের ছবিটিও নজর এড়ায় না। এই কক্ষে সাকেত রামের দীক্ষা(পড়ুন মগজধোলাই)সম্পূর্ণ হয়। সাকেত রাম ফ্যালফ্যাল করে দ্যাখেন মাথায় পাগড়ি বাঁধা,কপালে সিঁদুরের টীকা,অপর্ণাকে। মহারাজার প্রতিশোধের জ্বলন্ত বক্তৃতা স্থাপিত হয়ে যায় অপর্ণার ঠোঁটে। স্পেশাল এফেক্টসে আমরা দেখি হিন্দুধর্মের স্বস্তিকা চিহ্নটি একদিকে হেলে গিয়ে রূপান্তরিত হয় কুখ্যাত নাৎসীবাহিনীর সুপরিচিত চিহ্নটিতে। খানিক পরেই সেটি বদলে গিয়ে নিজের চেহারায় নিয়ে আসে একটা পদ্মফুলের আদল।

সাকেত রাম ক্রমশ প্রতিজ্ঞার দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন আর সেই সঙ্গে শিথিল করতে থাকেন পারিবারিক বন্ধন। কেননা,শ্রীরাম তাঁকে বুঝিয়েছে,যে মহান বিপ্লবের অংশ হতে চলেছে তুচ্ছ পারিবারিক বন্ধনে বিহ্বল হওয়া তাকে মানায় না। স্ত্রী সম্ভোগের সময়েও সাকেত রাম সেই রমণীর পরিবর্তে বিছানায় শুয়ে থাকতে দ্যাখেন একটি বিশাল আগ্নেয়াস্ত্রকে।

ছবিটির নাম থেকে চরিত্র,সবখানেই ‘রাম’ নামের ছড়াছড়ি। পরিচালক কমল হাসান আমাদের দেখিয়ে দেন একজন রাম অন্য একজন রামকে প্রলুব্ধ করছে এমন এক ব্যক্তিকে হত্যা করতে যাঁর উপাস্য দেবতার নামও রামচন্দ্র। সাকেত রাম যে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন,আমরা দেখতে পাই সেই একই মন্ত্রে দীক্ষিত আর একটি লোককে,এই লোকটির নামের মধ্যেও রামনামের ঝংকার,তার নাম নাথুরাম গডসে।

সাকেতরূপী কমল হাসানকে আমরা দেখি একটি ধুতি,অনাবৃত পেশিবহুল ঊর্ধ্বাঙ্গে হাতে অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মরুপ্রান্তরে। তাঁর দিকে হু হু করে ধেয়ে আসছে গেরুয়া মরুঝড়। সেই ঝড়ের মুখে তাঁকে দেখায় বিভ্রান্তের মতন। হাওয়ার দাপটে বেঁধে রাখা দীর্ঘ চুল খুলে লুটিয়ে পড়ে প্রশস্ত কাঁধে। তাঁকে রামায়ণের পৃষ্ঠা থেকে বেরিয়ে এসে যেন এই অস্থির রাজনীতির প্রাঙ্গনে পথ হারিয়ে ফেলা দেবতার মতন মনে হয়।

                                    ৫
মহাত্মা গান্ধী যখন দেশে ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা করছেন,সেই সময় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙঘের একটি শিবিরেও তিনি বক্তব্য রাখেন। এই সঙ্ঘের সঙ্ঘবদ্ধতা তাঁর ভালো লাগে কিন্তু এদের মধ্যেকার উগ্র হিন্দুত্ববাদে তিনি বিরক্ত হন। আর এস এস নেতা এম এস গোলওয়ালকার তাঁর কল্পনায় যে ভারতকে দেখেছিলেন সেটা অনেকটা এরকম,তাঁর মতে,এখানকার অ-হিন্দুদের হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষাকে মেনে নিতে হবে,হিন্দু ধর্ম শিক্ষা করতে হবে,তা না হলে তাদের এ দেশ থেকে চলে যাওয়াই তো ভালো। আর যদি থাকতেই হয়,তবে তাদের থাকতে হবে সম্পূর্ণভাবে হিন্দুজাতির অধীন হয়ে। কোনওকিছুর ওপর তাদের কোনও দাবি থাকবে না ,কোনও বিশেষ অধিকার থাকবে না,এমনকী নাগরিক অধিকারও না। গান্ধী এসব শুনে বলেছিলেন,এইসব করলে হিন্দুধর্মটারই ক্ষতি হবে। এই দলের বিরুদ্ধে যে সাম্প্রদায়িক ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগ আসছে,দেশের এই অস্থির সময়ে এই দলেরই উচিত সেটাকে মিথ্যে প্রমাণ করা।

এইসব ডামাডোলের মধ্যেই এসে গেল ভারতের স্বাধীনতা। সিরিল র‍্যাডক্লিফ নামে ভারত সম্পর্কে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এক সাহেবের হাতে তুলে দেওয়া হল ছুরি এবং মান্ধাতার আমলে তৈরি একটা ভারতের মানচিত্র দিয়ে বলা হল,নিন,কেটে দু’ভাগ করুন।

ছবিতে সাকেত রাম গিয়ে পৌঁছন দিল্লির চাঁদনী চকে। সেখানে প্রিয় বন্ধু আমজাদের(শাহরুখ খান) সঙ্গে বহুদিন পর তাঁর দেখা হয়। দাঙ্গার আগুন তাদের দুজনের আলিঙ্গনের মধ্যে দেওয়াল হয়ে দাঁড়াতে চায়। রাম একটু ইতস্তত করলেও হুল্লোড়বাজ আমজাদ সেসব উড়িয়ে দিয়ে বন্ধুকে কাছে টেনে নেয় অথচ রাম চেষ্টা করেও আগের মত স্বাভাবিক হতে পারেন না। ভেতরে ভেতরে একটা অপরাধবোধ ঘনিয়ে উঠতে থাকে।

কয়েকদিন পর এখানেও একটা দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায় এবং দুই বন্ধু পরস্পরকে দুটো ক্ষিপ্ত সম্প্রদায়ের হিংসা থেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে। এরকম একটি সংকটে রাম আমজাদকে কিছুটা খোঁচা দিয়েই বলেন,পাকিস্তানে চলে গেলেই তো আর এভাবে তোমাদের পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয় না। আমজাদ জবাব দেয়,কেন যাবো?এই ভারতকেই আমি নিজের দেশ বলে মেনেছি,গান্ধীজিকে জাতির পিতা হিসেবে মান্য করেছি,আমি এখানেই থাকবো। রাম প্রশ্ন করেন,কার অনুমতিতে থাকবে? আমজাদ অবাক হয়ে বলে,নিজের দেশে নিজে থাকবো,তার জন্য আবার অনুমতি নিতে হবে নাকি? রাম তাঁর ধোলাই হয়ে যাওয়া মস্তিষ্কের প্ররোচনায় বলে ফেলেন,তোমরা সাতশো বছর ধরে আমাদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছো বাইরের দেশ থেকে এসে,এবার বিদেয় হও। আমজাদও খোঁচা দেওয়ার সুযোগ ছাড়ে না,আমার বয়স তো সাতশো নয়,আমি তোমারই বয়সি,কী হয়ে গেছে তোমার,রাম?

ঘটনার ফেরে রাম বাধ্য হন প্রায় জনাবিশেক অসহায় মুসলমান শিশু ও রমণীকে উন্মত্ত হিন্দু জনতার হাত থেকে রক্ষা করতে। তারা ফেরেশতার মতন শ্রদ্ধা করতে শুরু করে সাকেত রামকে,যিনি কিনা উগ্র হিন্দুত্বের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে অ-হিন্দুদের প্রতি ঘৃণার ভাবটাকে পোক্ত করে ফেলতে চেয়েছিলেন।

রামের আবার একটা রূপান্তর ঘটে। তিনি উগ্র হিন্দুত্বের বর্ম খুলে রাখেন। প্রিয় বন্ধু আমজাদের মৃত্যু এই পথে তাঁকে আরও এগিয়ে নিয়ে যায়। মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করার জন্য যে অস্ত্রটি নিয়ে তিনি সারক্ষণ ঘুরে বেড়াতেন,ঠিক করেন সেটিকে গান্ধীর কাছেই সমর্পণ করে দিয়ে নিজের পাপ স্খালন করবেন।

১৯৪৮ সালের ৩০শে জানুয়ারি দিল্লির বিড়লা হাউসে মহাত্মা গান্ধী বক্তৃতা করবেন বলে খবর আসে। সাকেত রাম অস্ত্রটি নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন। গান্ধী অশক্ত শরীরে আস্তে আস্তে শান্ত ভঙ্গিতে বক্তব্য রাখেন। সাকেত রাম মুগ্ধ হন।

বক্তব্য শেষে মহাত্মা গান্ধী হেঁটে হেঁটে আসছেন,সেই সময় সাকেত রাম তাঁর কাছে গিয়ে নিজের পাপ স্খালনের কথা জানাতে চাইলেন। গান্ধী সবটা শুনলেন না,বলে উঠলেন,আমারও অনেক পাপ স্খালন করার আছে। হিংসা এখনও থেমে যায়নি,আমাকে সেখানে যেতে হবে,তাদের নিবৃত্ত করা প্রয়োজন।

এর খানিক পরেই ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল নাথুরাম গডসে। পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে তিনটি বুলেট বিঁধিয়ে দিল তাঁর বুকে।

                               ৬
মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু দিয়ে সমাপ্তির পথে এগিয়ে যায় Hey Ram ছবিটি আর এই মৃত্যু দিয়েই শুরু হয় এম এস সথ্যু পরিচালিত উর্দু ছবি Garam Hawa. এই ছবিটির আখ্যান উর্দু কথাসাহিত্যিক ইসমত চুঘতাই এর একটি ছোট গল্প থেকে গৃহীত। সত্যজিৎ রায় এই ছবিটি সম্পর্কে বলতে গিয়ে লিখেছেন,শুধুমাত্র বিষয় নির্বাচনেই Garam Hawa একটি মাইলস্টোন ছবি হিসেবে গ্রাহ্য হতে পারে(Our films Their films)।

Hey Ram যেমন দেশভাগের উত্তাল পরিস্থিতি,হিন্দু মুসলমান বিভেদের ভয়াবহতা,হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষায় উগ্র হিন্দুত্ববাদের উত্থান এবং মুসলিম তোষণের অভিযোগে মহাত্মা গান্ধীকে তাদের হত্যা এইসবের একটা প্রত্যক্ষ ছবি তুলে ধরে,Garam Hawa গান্ধীহত্যা এবং দেশভাগের প্রেক্ষিতে মুসলমান সমাজের একটা অংশের ক্রমশ কোণঠাসা হতে থাকা,বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হতে থাকার একটি অন্তরঙ্গ ছবি।

অধুনা উত্তরপ্রদেশের আগ্রা শহরে বসবাসকারী একটি মুসলমান পরিবারকে ঘিরে ছবিটির কাহিনী আবর্তিত হয়েছে।

হালিম মির্জা মুসলিম লীগের একজন প্রাদেশিক নেতা। দেশভাগের পর তিনি জনসভায় গরম গরম বক্তৃতা দেন আর বুঝিয়ে দিতে চান,মুসলিম লীগের সব বড় বড় নেতা ভারতের মুসলমানদের পথে বসিয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে গেল। এই যে ফতেপুর সিক্রী,এই যে সুন্দর তাজমহল,এই যে সেলিম চিশতির পবিত্র দরগা এসবের প্রতি কি তাদের কোনও ভালোবাসা নেই? ভারত কি আমাদেরও দেশ নয়? মুসলিম লীগের সেইসব নেতা আসলে করুণাময় আল্লার ওপরেই বিশ্বাস রাখতে জানে না। আপনারা দেখে নেবেন,এই আমি হালিম মির্জা,আর যে পাকিস্তানে পালিয়ে যেতে চায় যাক,এই হালিম মির্জা সবসময় ভারতের মুসলমানদের সঙ্গে এখানেই বাস করবে।

হালিম মির্জা এসব বক্তৃতা করছেন বটে,এদিকে তাঁর নিজের পরিবারটিরই বিভিন্ন সদস্য এক এক করে পাড়ি দিচ্ছে পাকিস্তানে। কর্মক্ষেত্র,বন্ধুমহল,ব্যবসায় সবখানেই এই অংশের মুসলমানদের জন্য আজকাল অপেক্ষা করে থাকে উপেক্ষা,বিরক্তি,অপমান। বাতাসে প্রায় সারাক্ষণ ভাসতে থাকে একটা কথা,পাকিস্তান চলে যাচ্ছো না কেন? তোমাদের জন্য একটা দেশ তো তৈরি করেই রেখেছেন তোমাদের নেতারা। তাহলে ভারতে থেকে আমাদের সুযোগসুবিধের ওপর ভাগ বসাবে কেন? চলে যাও।

হালিমের ভাই সেলিম মির্জা(বলরাজ সাহানী) একটা জুতোর ফ্যাক্টরির মালিক। তাঁর সেই ব্যবসায় লেগেছে ভাঁটার টান। কারখানার অনেক শ্রমিক চলে গেছে পাকিস্তানে। তাদের আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। সময়মতো মাল জোগান দেওয়া যাচ্ছে না বায়না অনুযায়ী। একটা বড় অঙ্কের অর্ডার ক্যানসেল হয়ে গেল,আটকানো গেল না। ব্যবসা ধরে রাখার জন্য তিনি গেলেন তাঁর পূর্ব পরিচিত কিছু লোকের কাছে,যাদের কাছ থেকে এর আগে বহুবার তিনি বিভিন্ন দরকারে লোন নিয়েছিলেন। এই মুহূর্তেও তাঁর কিছু টাকার প্রয়োজন। সেলিমকে একজনও আর লোন দিতে রাজি হল না,খুব বিনীতভাবে জানাল,তাঁর মত অনেক মুসলমানই দেশভাগের পর চলে গেছে পাকিস্তানে,তারাও অনেকে লোন নিয়েছিল যেগুলো আর ফেরত পাবার কোনও আশা নেই,তাই তারা আর এইসব বিপদের ঝুঁকি নিতে রাজি নয়।

হালিমের ছেলে কাজিমের সঙ্গে সেলিমের মেয়ে আমিনার বিয়ে একরকম ঠিক হয়ে আছে,এই দুটি যুবক-যুবতী পরস্পরের প্রতি গভীর প্রণয়াসক্ত,এরকম অবস্থায় হঠাৎ সপরিবার হালিম তাঁর সমস্ত উত্তেজক বক্তৃতা জলাঞ্জলি দিয়ে প্রায় লুকিয়েই পালিয়ে গেলেন পাকিস্তানে। কিছুদিন পর কাজিম বাবা মায়ের অগোচরে আমিনার কাছে ফিরে এলেও অনুপ্রবেশের অভিযোগে সে গ্রেপ্তার হয় এবং তাকে আবার ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয় পাকিস্তানে। আমিনা অন্ধকারে একবিন্দু আলো দেখতে পেয়েছিল,এখন সে আবার তলিয়ে গেল অন্ধকারে।

শামসাদ নামে এক যুবক অনেক আগে থেকেই আমিনার প্রতি আসক্ত,আমিনা অবশ্য বারবার ফিরিয়েই দিয়েছে তাকে। এবার এই আঁধারে আবার তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয় শামসাদ,আমিনা দুরু দুরু বুকে সেই হাতটি ধরে।

সপরিবার হালিম চলে যাওয়ায় সেলিম পড়ে যান বিপদে। এই বাড়িটির মালিকানা তাঁর নামে নেই,চলে যাওয়ার সময় হালিম কিছু লিখে দিয়েও যাননি। সরকার থেকে সেলিমের ওপর নির্দেশ আসে বাড়িটা ছেড়ে দেওয়ার।

নতুন বাড়ি খুঁজতে গিয়েও সেলিমকে অপমানিত হতে হয় তাঁর ধর্মপরিচয়ের জন্য। এদিকে বজ্রপাতের মতন একটি খবর আসে,শামসাদকেও চলে যেতে হচ্ছে পাকিস্তানে,আমিনার হাত থেকে নিজের হাতটি সে ছাড়িয়ে নেয়।

আমিনা আত্মহত্যা করে।

সেলিমের স্ত্রী জামিলা(শওকত কাঈফি) বারবার বিলাপ করে বলেন,আগেই পাকিস্তানে চলে যেতে পারলে এই দিন হয়ত দেখতে হত না। সেলিম তবুও বিশ্বাস রাখেন আল্লার ওপর। ভারতবর্ষ তাঁর নিজের দেশ,নিজের দেশে এত অপমান কেন সইতে হবে তাঁকে? আল্লা একদিন ঠিকই করুণা করবেন।

                                     ৭
এই সমস্ত ঘটনা কি নতুন রূপে পুণরাবৃত্ত হতে পারে এই ২০২০-২১ সালের ভারতবর্ষে? বর্তমান শাসকের তর্জনী এমন কিছু ফরমান জারি করতে চাইছে যার ফলাফল হিসেবে সেটার বাতাবরণ তৈরি হবার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর এস এস নেতা গোলওয়ালকর যে ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন তাকেই যেন বাস্তব রূপ দিতে চাইছেন শাসক। তাঁর সেই চাওয়া আমরা প্রতিফলিত হতে দেখছি বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে ছাত্রদের টেনে হিঁচড়ে এনে এলোপাথাড়ি লাঠির বিক্রমে,এদেশে জন্মে বছরের পর বছর বসবাস করার পর আচমকা একদিন নিজের নাগরিকত্ব বাতাসে মিলিয়ে যেতে দেখে মানুষের অসহায় কান্নায়,উগ্র হিন্দুত্ববাদী উসকানিতে….।

ওই সমস্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনাকে রুখে দেওয়ার জন্য এই মুহূর্তে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে যাচ্ছে গোটা ভারতবর্ষ। সারা দেশ জুড়ে উত্তাল প্রতিবাদ। শাহিনবাগে সন্তান কোলে রাস্তায় বসে পড়ছেন মায়েরা। ছাত্ররা জোটবদ্ধ হয়ে আকাশে ছুঁড়ে দিচ্ছে বজ্রমুষ্ঠি। প্রতিরোধের মুখে শয়ে শয়ে মানুষের হাতে হাতে ক্রমশ আকাশের দিকে উঠে যাচ্ছে মহাত্মা গান্ধীর হাস্যোজ্জ্বল প্রতিকৃতি। 

Hey Ram ছবিটির শেষে সাকেত রামের নাতি তাঁর দাদুর ঘরের সমস্ত জানালা দরজা খুলে দিতে থাকে। সেই দেওয়ালের পুরোটা জুড়ে,দরজা জানালার ওপর দিয়েও এগিয়ে গেছে মহাত্মা গান্ধীর প্রতিকৃতির বিভিন্ন রেখা। সেই ছবির যেখানে সেখানে ফুটে উঠতে থাকে বাইরের প্রকৃতি,স্নিগ্ধ হাওয়ায় মাথা দোলায় সবুজ গাছের শ্রেনী। আর Garam Hawa-র শেষে স্ত্রী পুত্রকে নিয়ে পাকিস্তান চলে যাবেন বলে স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হওয়া সেলিম মির্জার টাঙ্গা আটকে যায় এক বিশাল জনস্রোতে। একটি প্রতিবাদ মিছিল। বৈষম্যের বিরুদ্ধে,উপেক্ষার বিরুদ্ধে,বিভেদ করতে চাওয়ার বিরুদ্ধে। সেলিমের পুত্র সিকান্দার (ফারুক শেখ) লাফ দিয়ে নেমে মিশে যায় সেই মিছিলে। সেলিমও নেমে পড়েন,ঘরের চাবি স্ত্রীর হাতে দিয়ে টাঙ্গাকে নির্দেশ দেন বাড়ি ফিরে যেতে। স্ত্রী আপত্তি করেন না। সেলিম এগিয়ে যান মিছিলের দিকে। ভারতবর্ষ তাঁর বড় আদরের,বড় ভালোবাসার দেশ। তিনি কেন পালিয়ে যাবেন পাকিস্তানে?

মিছিলে শ্লোগান ওঠে,ইনকিলাব জিন্দাবাদ। পুত্র সিকান্দারের সঙ্গে,শত শত মানুষের সঙ্গে কণ্ঠ মেলান সেলিম।

এই মিছিল,এই শ্লোগান,মানুষের এই প্রতিবাদী স্রোত কেমন অনিবার্যভাবে মিশে গেল আজকের এই ভারতবর্ষের প্রতিবাদ যাত্রায়।

Garam Hawa ছবিটির সূচনায় কবি কাঈফি আজমি আবৃত্তি করেছিলেন,

“গীতা কি কোই সুনতা না কোরান কি সুনতা
হ্যায়রান সা ঈমান ওয়াহাঁ ভি থা ইয়াহাঁ ভি।“

আর আজকের প্রতিবাদী ভারতের কন্ঠে গেয়ে উঠছেন ফৈয়াজ আহমেদ ফৈয়াজ,

“লাজিম হ্যায় কে হাম ভি দেখেঙ্গে
উয়ো দিন কে জিস কা ওয়াদা হ্যায়
জো লউহ-এ-আজল মে লিখা হ্যায়
হাম দেখেঙ্গে”
      


তথ্যসূত্র :

অর্ধেক জীবন – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
গাঁধী উত্তর ভারতবর্ষ – রামচন্দ্র গুহ

বিশেষ কৃতজ্ঞতা :

সাগ্নিক চক্রবর্তী