।।নাটক ‘মাধুকরী’: আত্মান্বেষণ  এবং আমিত্বের অন্যতর মায়া।। – Shalmali Roy

“My grandfather always said that living is like licking honey off a thorn.”
— Louis Adamic

জীবনের স্বরূপ  কেমন? ঠিক কোন দৃষ্টিতে আত্মঅন্বেষণ জীবনের রূপ উন্মোচন করে? মিলন, বিচ্ছেদ, যাওয়া, আসা, ক্ষণিকের থেকে যাওয়া থেকে পথ পরিক্রমার শেষে হারিয়ে যাওয়া- এর কোনটি দিয়ে সংজ্ঞাত করা যায় জীবনকে? কেবল আনন্দ আর বেদনার সাদাকালো হিসেবেই কি মেপে নেওয়া যায় তার সবটুকু? পান করা যায় আঁচলা ভরে? নাকি সবটুকুই আসলে আপেক্ষিক? জীবনের ছবি, প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে সম্পর্কের চালচিত্রে; আর সম্পর্কগুলো তো চিরকালই আপেক্ষিক, এক সম্পর্ক থেকে আরেক সম্পর্কে এগিয়ে যেতে যেতেই পূর্ণ হয়ে যায় জীবন বৃত্ত, তাই জীবন যেন অপেক্ষিকতার আলোয় দেখা মাধুকরী। ঠিক যেমন অপেক্ষিকতার কথা বলে বুদ্ধদেব গুহ’র কালজয়ী উপন্যাস “মাধুকরী”। উপন্যাসে লেখক লিখেছিলেন-
” যাওয়া মানেই তো আসা আর আসা মানেই যাওয়া, যেমনভাবে যে দেখে”

যাওয়া, আসা কিংবা চলা এই সবকিছুই “মাধুকরী”তে অপেক্ষিকতার দৃষ্টিতে দেখা। আর তাই ঠিক, ভুল সমস্তই এক অন্যতর দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রতিভাত হয়েছে তাতে। প্রকৃতি এবং মানবজীবন- এই দুইয়েরই প্রকাশই ঘটেচে এক গভীর এবং অন্যতর মূল্যবোধের নিরিখে। তাই জীবন এবং সম্পর্কগুলির যাবতীয় জটিলতাকে সাদা-কালোয় না দেখে “মাধুকরী” ধূসরকেই বেছে নেয়। আলোছায়া তাই এর পরতে পরতে। মধ্যপ্রদেশের অরণ্যের পটভূমি যেন মানব মনস্তত্বের সেই আলোছায়ারই প্রতীক হয়ে এসেছে। দু:খ বেদনার অনুভব তাই এখানে সন্ধ্যে নামার আগের আবছা আলোর মত, তাতে গভীরের হাতছানি থাকলেও, উগ্রতা নেই। আছে এক ধূসর বিষণ্ণতা, যেই বিষণ্ণতায় প্রতিটি চরিত্র পেয়েছে এক আপেক্ষিক রূপ। লেখক এই উপন্যাস উৎসর্গ করেছিলেন একবিংশ শতকের নারীপুরুষদের জন্য। একবিংশ শতকের নারীপুরুষমাত্রেই তার পূর্ববর্তী প্রজন্মের কাছে চিহ্নিত এক Confused Generation হিসেবে। কিন্তু একথা অনেকাংশেই প্রাচীনপন্থীরা বলেন না যে এই প্রজন্মই যে কোনো বিষয়কে মানবিকতার আলোয় দেখে, তারা প্রশ্ন করে যেকোনো অকারণের অযাচিত নিয়মকে। তাই সম্পর্ক এখানে কেবল বিয়ের শিকল পরানো কাগজকলমের এবং অনুরাগহীন অভ্যাসের নয়, বরং প্রকৃত আত্মিক ভালবাসায় উদ্ভাসিত।


এরকম নতুন যুগের নতুন মূল্যবোধের কাহিনী ব্যক্ত করা উপন্যাসই উঠে এল ড. সীতাংশু খাটুয়া নির্দেশিত গড়িয়া কৃষ্টি নাট্যদলের নতুন নাটক “মাধুকরী” তে। তাদের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে তারা দর্শককে উপহার দিল এই নতুন নাটক। উপন্যাস হিসেবে আয়তন এবং আঙ্গিকে “মাধুকরী ” অনেকাংশেই মহাকব্যিক গুণসম্পন্ন। তাই এর মধ্যে রয়েছে এক চিরকালীনতার সুর, এক যুগপরিক্রমা, এবং তাতেই মিলেমিশে গেছে মনস্তাত্ত্বিক এবং চেতনাপ্রবাহী রীতি। তাই এতরকম শৈলীগত বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন সাহিত্যকে মাত্র আড়াই ঘন্টার   নাটকে মঞ্চস্থ করবার মধ্যে যে সাহস, আত্মবিশ্বাস, শিল্পের প্রতি একনিষ্ঠতার প্রয়োজন হয়, তার প্রতিটির উপস্থিতিতে এই নাটক দর্শককে মুগ্ধ এবং মগ্ন করে রেখেছিল সম্পূর্ণ সময়টুকু জুড়ে। প্রথম দৃশ্য থেকে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত নাটকটি নান্দনিকতার এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা । প্রকৃতি, মানুষ এবং সম্পর্ক- উপন্যাসের এই তিনটি উপাদানকেই এই নাটক যথাযথভাবে  এবং যথাসম্ভব উপন্যাসের প্রতি একনিষ্ঠ থেকেই উপস্থাপন করেছে। পৃথু, রূষা, কুর্চি, ঠুঠা বাইগ্যা প্রমুখ চরিত্রগুলি এতদিন পর্যন্ত কেবল বইয়ের পাতার সাদা-কালো অক্ষরেই বন্দী ছিল। কিন্তু বইমেলার মরশুমে সেই সাদা কালো অক্ষরে বোনা চরিত্ররাই জীবন্ত হয়ে উপস্থিত হল দর্শকের সামনে ড. সীতাংশু খাটুয়া, রোকেয়া রায়, প্রসেনজিৎ বর্ধন, গন্ধর্বী খাটুয়া, সুমিত কুমার রায় এবং সহঅভিনেতাদের অসামান্য অভিনয়ের মাধ্যমে। পাঠকের কল্পনা এবং মঞ্চের উপস্থাপন মিলেমিশে এ নাটক নাট্যপ্রেমী দর্শককে এক অসামান্য নান্দনিক সন্ধ্যা উপহার দিয়েছে। আর সেই নান্দনিকতায় যোগ্য সঙ্গত করেছে এই নাটকের আবহসঙ্গীত। প্রত্যয় রাহা এবং অভিজ্ঞান খাটুয়ার সঙ্গীত পরিচালনায় এই নাটকের সঙ্গীত নির্মাণ হয়েছে। শ্রীতমা বসু এবং অর্পিতা চৌধুরির কণ্ঠে ব্যবহৃত সঙ্গীত নাটকের মুহূর্ত নির্মাণে বিশেষ সহায়তা করেছে; দৃশ্যন্তরে যাবার সেতু হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে উল্লেখ করা যায়  পৃথু এবং রূষার পুনর্মিলনের আবেগঘন মুহুর্তে নেপথ্যে প্রত্যয়ের কণ্ঠে অতুলপ্রসাদের গান ” আমি বাঁধিনু তোমার তীরে ” দৃশ্যটিকে অন্য মাত্রা দিয়েছে এবং ক্লাইম্যাক্সটি অসাধারণ শিল্পসম্মত হয়ে উঠেছে। শ্রীতমার সুদক্ষ কণ্ঠের রাগসঙ্গীতও ‘মাধুকরী’র মূল্যবান প্রাপ্তি।
মঞ্চসজ্জা এবং আলোর ব্যবহারও এই নাটকের পটভূমি এবং দৃশ্যনির্মাণে সহায়তা করেছে। মধ্যপ্রদেশের জঙ্গল, সিয়োনী পর্বত জীবন্ত হয়েছে মঞ্চসজ্জায় এবং এর ফলেই শিকারের দৃশ্য হয়ে উঠেছে মনোগ্রাহী। এরই সঙ্গে কিছু কিছু দৃশ্যে রোকেয়া রায় এবং ড.সীতাংশু খাটুয়ার কণ্ঠে নেপথ্যে বেজে চলা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাগুলি দর্শককে পৌঁছে দেয় এক অন্যতর অনুভূতির জগতে। তাই সবটুকু মিলে এ নাটক দর্শককে উপহার দিয়ে যায় এক অশ্রুসিক্ত গভীরতা, এবং এক নবতর আত্মঅন্বেষণ বা Soul searching এর পথে এগিয়ে দেয়। আনে আমিত্বের এক নতুন সংজ্ঞা। তাই নাটকের শেষে দর্শকের মনও যেন  বলে ওঠে,

” আমি তো থাকবই তোমাদের দু:খের অতিথি, আমি ছাড়া
দেবতার হাত থেকে কে খুলে পড়বে চিঠি,
কার রক্তের আদেশে মালা হয়ে উঠবে ফুল?
আমি দিয়ে যাব তোমাদের সঙ্গোপন গন্ধর্ব বিবাহ;
এই স্বেচ্ছামৃত্যু আমি নিজেই চেয়েছি।”