পৃথিবী অনেক কিছু দেখেছে। দেখেছে বিপ্লব, দেখেছে নবজাগরণ, দেখেছে দু-দুটি বিশ্বযুদ্ধ। মহামারীও দেখেছে। কিন্তু উত্তর-আধুনিক কালের এই অতিমারী, পৃথিবী আগে দেখেনি। এই মুহূর্তে, যেখানে আমরা সবাই বিশ্বনাগরিক, যেখানে অর্থনীতি বলতে বিশ্ব-অর্থনীতিকেই বোঝায়, যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি স্তম্ভ এই বিশ্বায়নের, সেখানে এই মূল স্তম্ভে আঘাত এমন পৃথিবীব্যাপী মাত্রায় এর আগে হয়তো আসেনি।
আজকে ধরা যাক, কলকাতার উপকণ্ঠের রেললাইনের পাশের এক বাড়িতে বাস করা পরিবারের যে বিষয় নিয়ে আতঙ্ক, লন্ডনের মেইফেরারের এক বাসিন্দাও একই রোগের থেকে নিজের পরিবারকে বাঁচানোর জন্য উদ্বিগ্ন।
পার্থক্য শুধু সরঞ্জাম ও বাহুল্যে।
Coronavirus Disease – 19 বা COVID-19 রোগটি আর যাই করুক না কেন, আমাদের অনেক কিছু দেখিয়ে দিল। দেখালো, চাইলে আমরা মানুষ, জাতি ধর্ম ভেদাভেদ নির্বিশেষে এক হতে পারি। যদিও বা তা ভালোবাসার তাগিদে নয়, প্রাণভয়ে তাগিদে। দ্বিতীয়ত দেখালো, আমাদের অর্থনৈতিক অসাম্য। সমাজের এক শ্রেণির কাছে কিন্তু এই Lockdown বা Quarantine টা একটা Privilege। যাদের কাছে নয়, তাদের কাছে রোজগার নেই, আনাজপাতি নেই, এমনকি এই রোগের প্রতি সতর্কতা অবলম্বন করার ন্যূন্যতম সরঞ্জাম ও নেই। তৃতীয়ত, দেখালো, সবার ওপরে মানুষ সত্য। এই সময়ে আমাদের যাঁরা বাঁচিয়ে তুলতে পারেন, অর্থাৎ স্বাস্থ্যকর্মীরা, তাঁরা কিন্তু মানুষ। কোনো অতিমানবিক শক্তি নয়। অর্থাৎ, কোনো অতিমানবিক শক্তির কোনো অস্তিত্ব নেই। যা আছে, তা হল প্রাকৃতিক নিয়ম, যা সমগ্র মহাবিশ্বে অনাহত ভাবে চলছে। অর্থাৎ কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই। থাকলেও তিনি সৃষ্টির নিয়মে খুব একটা নাক গলান না। এবং এই সৃষ্টি নিজের তালে ভাঙতে ভাঙতে ও গড়তে গড়তে এগিয়ে চলে।
এই করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচার এক মাত্র উপায় বিচ্ছিন্নতা।বহু আগে পশ্চিমের একজন দার্শনিক বলেছিলেন,মানুষ যত আধুনিক হবে সে তত বিচ্ছিন্ন হবে।আজ আমাদের আধুনিক উন্নাসিকতার পরিনামেই কি তবে বর্তমানে গোটা পৃথিবী এই ভাবে বিচ্ছিন্ন?আচ্ছা! যেদিন করোনার ত্রাস প্রশমিত হবে,সেদিন যখন মানুষ বাইরে বেরোবে,বাসে বসে থাকা পাশের মানুষটাকে আমরা বিশ্বাস করতে পারবো তো?বা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে কোনো বাবা বা মা তার আদরের সন্তান কে সহজ মনে কোলে তুলে নিতে পারবে তো?এই লকডাউন শেষে প্রথম যেদিন কোনো দুজন প্রেমী রেস্তোঁরার আলো ছায়ায় দেখা করবে,তাদের কাছে হাতের উপর হাত রাখা কি সত্যি খুব কঠিন হয়ে পড়বে?আবার পাড়ার মোড়ের চায়ের দোকানের বন্ধুদের আড্ডা গুলো জমে উঠবে তো?সত্যিই জানা নেই এই দূরত্ব; দূরে সরে থাকা আমাদের করোনার হাত থেকে বাঁচিয়ে কোনো মানসিক সংক্রমণের দিকে ঠেলে দেবে কিনা।
তাই, আমাদের এইবার একটু অন্য ভাবে ভাবতে হবে এবং যারা এখনো ভাবতে পারছেনা, তাদের ভাবানোর দায়িত্বটাও আমাদেরই নিতে হবে। এই যে একটা অন্ধকার সময়ের ভেতর দিয়ে আমরা চলেছি, এর পর যখন আলো দেখবো, তখন কি একই রকম থাকবে আমাদের জীবন যাপন? প্রকতির প্রতি আমরা কি একই রকম অবহেলা বা ধ্বংসের মনোভাব নিয়ে বাঁচবো? পাওলো কোয়েলহো লিখেছেন, “পৃথিবী আমাদের বহু আগে থেকে ছিল আর আমরা যদি পৃথিবীর সঠিক মর্যাদা দিতে না পারি তাহলে পৃথিবী আমাদের মানে মানুষ কে লাথি মেরে তাড়াবে”, তাই প্রকৃতির প্রতি, মানুষের প্রতি, খাদ্য দ্রব্যের প্রতি, সম্পর্কের প্রতি, কাজের প্রতি, সভ্যতার প্রতি, আগামীর দিকে তাকিয়ে কি মনোভাব নিয়ে আমরা আবার শুরু করবো? আমরা কি আজকের অসহায়তা আর অন্ধকার থেকে কিছু শিখবো?
এই সমস্ত কথা এবং বক্তব্য নিয়ে লিখে পাঠান, আমাদের ম্যাগাজিনে কথাবৃক্ষ-এ। আমরা নতুন আগামী গড়ার স্বপ্ন নিয়ে সেই সমস্ত লেখা প্রকাশ করার জন্য মুখিয়ে থাকবো।
আমাদের মেল করুন kothabriksha@gmail.com এ।