‘করোনা’ কথা – শুভ্রদীপ

বর্তমানকালের এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে আমরা প্রত্যেকেই গৃহবন্দী। আমাদের আপনজনেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এক এক প্রান্তে। সকলের জন্যই হচ্ছে সমানভাবে দুশ্চিন্তা। নিজের মৃত্যুভয় না থাকলেও, চারিপাশে অসময়ে প্রয়াত মানুষগুলোর কথা ভেবে আঁতকে উঠছি বারবার। চোখের সামনে দুটো দৃশ্য সমানভাবে ভেসে উঠছে, একটির মধ্যে দেখতে পাচ্ছি অসংখ্য মৃতদেহ, চারিদিকে স্তূপাকৃত হয়ে রয়েছে আর আরেকটা দৃশ্য আমার প্রাণের শহরের সেজে ওঠার, সেই নতুন দিনের সূচনার, যেদিন মানুষ ফিরে পাবে তাদের প্রানের শহরকে, উৎসবের আমেজে রাস্তায় নামবে মানুষের ঢল।


তবে এই সবকিছুর মূলে একটাই নাম ‘করোনা’। ‘করোনা’ সংক্রান্ত প্রত্যেকটি তথ্যই মানুষের এতদিনে জানা হয়ে গিয়েছে। তাই সেই নিয়ে কিছু বিশেষ বলার নেই। কিন্তু যা বলার তা হলো এই ‘করোনা’ কি সত্যিই আমাদের কিছু শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছে…? আমাদের কি সত্যিই এর থেকে কিছু শেখা উচিৎ..? নাকি কেবল মাত্র রাসায়নিক যুদ্ধ বা ভাইরাসের প্রভাব ভেবে চালিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট।


একজন অধ্যাপক হিসেবে আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় যে করোনা এবারের মতন আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে গেল। দিনে দিনে মানবতা হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীকে পড়িয়ে গেল মানবতার পাঠ। কেমন যেন দিনে-দিনে, কালে-কালে এই জগৎ সংসার শুধুমাত্র স্বার্থের পাঠ পঠন করতে লেগেছিল। মানুষ ভুলতে বসেছিল মানবতা, অস্তে চলেছিল মনুষ্যত্ব। আজ দেখুন, যখন মানুষ জানে যে মৃত্যু দোরগোড়ায়, তখন কিন্তু সেই মনুষ্যত্ব আর মানবতাই হয়ে উঠেছে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।


আজকে সত্যিই কোথায় গেল আমাদের সারাদিনের ছোটাছুটি, কোথায় গেল সারাদিনের ব্যস্ততা..? আমরা এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি যে প্রিয় মানুষগুলোকে একবার ফোন করে খবর নেওয়ার মতন সময়টুকুও বার করতে পারিনা, হয়তো আমিও পারিনা। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ওপর ওপর যেটুকু যোগাযোগ, তাতেই দিন কাটিয়ে দিচ্ছিলাম বেশ। কিন্তু আজ তো যে মানুষগুলোকে বছরে একবারও ফোন করতাম না, তাদেরকেও ফোন করে কুশল ও সাবধানে থাকার সতর্কতা জানাচ্ছি বটে। তাহলে এটুকু কি প্রমাণিত হয়না যে ব্যস্ততা শুধুমাত্রই আপেক্ষিক একটি প্রেক্ষাপট।


রাস্তায় গাড়ি নেই, নেই বায়ুদূষণ, নেই কোনোরকম যানজট। চারিদিকটাই যেন লাবণ্যময় প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র হয়ে উঠেছে। বসন্ত বউরি, কোকিল, চড়াই আরো নানান পাখির কলতান কান ঝালিয়ে দিচ্ছে। তবে কি এই কলতান অন্যসময় বন্ধ থাকে..? একেবারেই নয়, সত্যি বলতে আমাদের সময় থাকেনা শোনার বা হয়তো চারিদিকের যান্ত্রিক কলরবে সে শব্দগুলো ঢাকা পরে যায়।


আজ না আছে কোনো শপিং মল না কোনো সিনেমাহল, নেই কোনো রেস্তোরাঁ। তাই বলে কি কাটছেনা দিন..? হাতে সময় পেলেই, কাজ থাক আর না থাক খানিকটা শপিং মলে বেরিয়ে আসা আমাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমিও মাঝে মধ্যে করেছি সেকাজ। অথচ এদিকে সারি সারি সাজিয়ে রাখা গল্পেরবইগুলো ধুলের আস্তরণে ঢাকা পরে গেছে। কিন্তু আজ..? আজ তো সেই বই-ই আপনার অসময়ের সঙ্গী হয়েছে, তাই না..!
আজকে কোথায় মহান ধর্মগুরুরা..? কোথায় আজ সেই মন্দির-মসজিদ ভাঙা গড়ার লড়াই..? আজ নেই কোনো রাজনৈতিক দাবা চাল, নেই নির্যাতিত নারীদের আর্তনাদ। বাপ-মায়ের উচ্ছন্নে যাওয়া ছেলেমেয়েদের কোথায় সেই বাইক র‍্যালি, কোথায় গাড়ির রেস, কোথায় রাত বিরেরতের ডিস্কোর পার্টি..? সমস্ত বিলাসিতা আজ মৃত্যু ভয়ের কাছে হার মেনেছে। মানুষ হার মেনেছে প্রকৃতির কাছে। আজ যা আছে তা হলো ভয় ও আতঙ্ক, এই বুঝি সবটা শেষ হয়ে যাবে চোখের নিমেষে..! বিশ্বব্যাপী শুধু মরণের হাহাকার, চারিদিকে শুধু মৃত্যুর আর্তনাদ। আজ যা আছে তা হলো বেঁচে থাকার প্রার্থনা।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভাবনা শুধু একটাই, জীবনকে উপলব্ধি করা। ২৪ ঘন্টা, ৩৬৫ দিন শহরের আমেজ গায়ে মেখে ঘুরে বেড়ানোর নাম যে জীবন নয়, সেই সত্যকে উপলব্ধি করা। আজ হয়তো ভাবার সময় নেই কে বড়লোক, কে গরিব..? কার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার আর কার ছেলে বিলাত ফেরত..? আজ ভাবনার যা আছে তা হলো ওই না খেয়ে থাকা দিন-আনা দিন-খাওয়া মানুষগুলো, দিনের পর দিন না খেয়ে আর্তনাদ করতে থাকা রাস্তার কুকুরগুলো, কিংবা করোনার থাবায় অকালে প্রয়াত মানুষগুলো..!


আজ আমরা সত্যিই যদি ভেবে দেখি তাহলে দেখবো বহু যুগ এমন ভাবে বাবা-মা বা পরিবারের মানুষদের সাথে আমরা সময় কাটাইনি। সত্যিই তো, সারাদিনের ব্যস্ততার পর বাড়ি ফিরে কতটুকুই বা সময় আমরা তাদের দিতে পারি..? কোনোমতে খেয়ে দেয়ে, হাতে ফোনটা নিয়ে শুয়ে পড়া..! এরই নাম জীবন।
যদিও এই না করাগুলো সবটাই ভীষণ সাধারণ, তাও সেই সাধারণকেই আমরা দিনে দিনে ভুলতে বসেছি। করোনা আরেকবার আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে একে অপরের প্রতি সংবেদনশীল হতে, মনে করিয়েছে দেশের প্রতি নিজেদের নৈতিক কর্তব্যের কথা। করোনা শিখয়েছে যে মানুষ কিভাবে এই বৈষয়িক ও বিলাসবহুল জীবনকে ত্যাগ করে, ছোট ছোট চাওয়া-পাওয়াগুলোকে প্রাধান্য দিয়েও জীবন কাটাতে পারে। করোনা স্মরণ করিয়েছে দশ হাত মিলে কাজ করার কথা। আমরা প্রত্যেকেই এই কথাগুলো কোনো না কোনোভাবে ছাত্র জীবনে বা তার পরেও নানা কবি-লেখকদের লেখনীতে পড়েছি, কিন্তু উপলব্ধি করেছি কজন..? উপলব্ধি করিয়েছে ‘করোনা’। ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে, এই করোনাই আজ আবার ভাবতে বাধ্য করেছে যে যতবার আমরা এই প্রকৃতির ওপর অত্যাচারের মাত্রা লঙ্ঘন করবো, ঠিক ততবারই আমাদের উচিত জবাব আমরা ফিরে পাবো। আজ আমরা আবার বুঝতে বাধ্য হয়েছি ‘এক টুকরা কাপড়া, রোটি আউর মাকান’ এর গুরুত্ব। তাহলে কি সত্যিই আমরা বলতে পারি যে এই করোনা আমাদের দিয়ে গেল আগামীদিনে চলার পথের সচেতনতার বার্তা, সাবধানতার বার্তা, সত্যের বার্তা, জীবনকে খুব কাছ থেকে উপলব্ধি করার বার্তা, ভালোবাসার বার্তা কিংবা মানুষ ও প্রকৃতির একে অপরের পরিপূরক হওয়ার বার্তা।


কিন্তু এই ‘করোনা’ সংকট মিটে গেলেও কি আমাদের মধ্যেকার দূরত্বটুকু মিটবে..? আমরা কি অনায়েসেই আবার আগের মতন জীবন যাপন করতে পারবো..? চায়ের দোকানের নির্ভেজাল আড্ডাগুলো কি আবার বসবে..? বহুদিন পরে দেখা করেও কি এক বন্ধু অপরকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবে..? দূরে থাকা ভালোবাসার মানুষগুলো কি দীর্ঘদিন দেখা না হওয়ার পরেও খুব সহজেই একে অপরের হাতটা ধরে কপালে একটা চুমু খেতে পারবে..? হয়তো বা পারবে আবার হয়তো বা এই ‘করোনা সন্দেহ’ মনের মধ্যেই ছাপ ফেলে যাবে বেশ কিছুদিনের জন্য। সবকিছু সাধারণ হয়ে গেলেও হয়তো অজান্তেই যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা মিটতে সময় লেগে যাবে আরও অনেকদিন।
তবে এর পরেও আমরা যদি কিছুই না শিখি, তাহলেও একথা নিশ্চিত যে আগামীদিন আরো ভয়াবহ হতে চলেছে আমাদের জন্য, পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। মানুষ তলিয়ে যেতে চলেছে এক অতল গভীরে। আজও সময় আছে, একটিবার পারলে ভাবুন।


ভালো থাকুন, সুস্থ থাকুন, ঘরে থাকুন, সকলের সাথে না থেকেও পাশে থাকুন, এই পরিস্থিতি আমরা কাটিয়ে উঠবোই।

প্রচ্ছদ : Deccan Herald