বরাবরের ভীষণ প্রিয় গল্প, রবিনসন ক্রুসো।
অবাক হয়ে ভাবতাম কীভাবে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, এক সভ্য জগতের লোক একাকিত্ব কে সঙ্গী হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। মনে অবান্তর প্রশ্ন জাগতো, প্রথমে পরিস্থিতির শিকার হলেও, পরে কি ওই একাকিত্ব কেই কিছুটা স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন? একাকিত্ব কে কি সঙ্গী করা যায়? আমার দুই পুত্র কেই তাদের ছোটবেলায় শোনাতাম সেই গল্প আর আমার কল্পনার রঙ মিশে থাকতো ওই নির্জনতা কে সঙ্গী করার প্রসঙ্গে। ওরাও প্রশ্ন করতো। আমার কোনো নির্দিষ্ট উত্তর ছিল না।
আজকে মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস ওই কল্পনার রঙ মেশাতে পেরেছিলাম ওই গল্পে! আমার, আমাদের সবাইয়ের এখন নিস্তব্ধতাকে, নির্জনতাকে সঙ্গী করতে হচ্ছে। এখন তো অনুশাসনের বেড়াজালে। এর পরে কি সত্যি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যাবে? কিছুটা কি স্বেচ্ছায় চাইবো এই নিস্তব্ধতা? আমার পুত্র দের যেরকম সঠিক উত্তর দিতে পারিনি, এখন নিজেকেও নিজে উত্তর দিতে পারছিনা।
আমি মানুষের মুখ দেখে ছাড়া থাকতে পারিনা। অনেক মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, স্টাডি করার জন্য, কেমন সে মানুষ, কেমন তার চিন্তা ভাবনা, কেমন তার পরিবারের অন্যদের সাথে সম্পর্ক, এই রকম আরো অনেক কিছু। এখন তো কাউকে দেখতে পাচ্ছিনা, ভালো লাগছে কি? কোনো মানুষের দিকে হাত বাড়াতে পারছিনা, ভালো লাগছে কি? আবার যখন সব কিছু নিঝুম, নিশ্চুপ হয়ে আসে, মনে হয় ‘এরকম শান্তিই তো চেয়েছিলাম’! আর যখনই ভাবি যে ‘এই তো শান্তি’, তখন মৃত্যুর মিছিল হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করে। আমরা কি সবাই মৃত হয়ে গিয়েছি? এত লোকের অসহায়তা, এত লোকের আর্তনাদ, এত লোকের বুভুক্ষু, এত লোকের মৃত্যু-আশঙ্কা, পারবো কি এড়িয়ে গিয়ে ওই রবিনসন ক্রুসোর মতোন স্বেচ্ছা নির্জনতা কে সঙ্গী করে নিয়ে থাকতে?
বোধহয় না; শান্তির আলিঙ্গন বড় মোহময়, কিন্তু মানুষ যখন কাঁদছে, শীর্ণ হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে আমার দিকে, পারবো না সেই হাত কে সরিয়ে দিতে, আমাকে শক্ত করে ধরে সে তো বাঁচতে চাইছে, আমি হাত বাড়িয়ে দেবো না?
এতদিনে এই উত্তর পেলাম নিজের কাছ থেকেই; তুমি পারবেনা ওই নির্জনতাকে স্বেচ্ছা সঙ্গী করতে, পারবেনা ওই মোহময়ী শান্তি কে আলিঙ্গন করতে, মানুষের মাঝে দাঁড়াও, আলিঙ্গন করো, ভালোবাসো তাদের, তোমার মুক্তি ওখানেই!
লেখাটির নামের জন্য ঋণ স্বীকার: জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র