অসত্য তা-ই যা প্রথমে সত্য। যাত্রাপথে সে একটি উড়ো অ-কে সাথী করে মাত্র। জীবন ঠিক ততখানিই সত্য। মৃত্যু শুধু জীবনকে স্তব্ধ করে জীবিত করে; সেটুকুই মৃত্যু। যে জীবনকে করে জীবিত, জীবিতকে দেয় জীবন ; সে মৃত্যুরই সহচর। সে-ই চরম জীবনের পরম দূত।
প্রথম ।। পৃথিবী দিয়েছিল মোর আশ্রয় এক জীবনের ঋণে।
যতক্ষণ ছিলাম জীবিত, ততক্ষণই ছিল মোর জীবন।
যখন ভেঙে গেল আশ্রয়, দেখি জীবন ঋণী হয়েছে জীবনের জন্য।
দ্বিতীয় ।। তুমি মৃত্যু চাওনি? যখন তোমার জীবন চেয়েছিল একটু মুক্তি?
জীবিতের আশা ছিল জীবনের থেকে, দিয়েছিলে প্রাণ তাকে?
প্রথম ।। পৃথিবীতে প্রাণ আছে, কে-ই বা জানে ? শাস্ত্র শিখেয়েছে স্বর্গ-ই জীবন ;
সিন্দুকের সম্ভার, অমরাবতীর অপ্সরা, বসন্তের বনানী ! বারেবারে মনে হয়েছে
পৃথিবী ছিল এক জাদুগরের মায়া ! শুধুই জীবনের আশ্রয় ; নয় সে মাতৃভূমি !
দ্বিতীয়।। মৃত্যুকে আহ্বান দিয়ে আজ তাকেই দিতে চাও অকালমৃত্যু ?
প্রথম ।। উপহাস করছ আমায় ! মৃত্যু আমি চাইনি ! চেয়েছিলাম শান্তি !
দ্বিতীয় ।। তুমিই আজ সবচেয়ে প্রিয় হলে আমার ! আজ এই স্বর্গপুরীর তোরণে দাঁড়িয়ে
একমাত্র যদি কেও আমার-ও মৃত্যুর কোনও বন্ধু থাকে, তবে তা তুমি !
তুমি কখনও হারিয়ে যাবেনা !
প্রীতি আর নীতি ! ছল আর বল ! ছায়া আর মায়া !
ক্লান্তি আর শ্রান্তি ! ভ্রম আর শ্রম !
যতকিছু ছিল ওইপারে,
তার সবই উপহার দিয়েছ তুমি আমায় ! এই স্বর্গপুরীকে করেছ লক্ষ দান !
প্রথম ।। কিন্তু ওই যে ! আমাদের সাড়হীন দেহগুলি !
শত শত লোকেরা ঘিরে রয়েছে তোমায়-আমায় ! সেই তুমি কি তুমি
নও ? সেই আমিও কি আমি নই ! আমাদের ছিল না মিত্রতা ?
দ্বিতীয় ।। সে তুমি যে তুমি নও! এখানে যে দাঁড়িয়ে আছ, তা-ই তুমি ! এ মৃত্যুদেবতার
লীলা! যে জীবন প্রাণকে করে বঞ্চিত, সেই জীবন সৌভাগ্যের আশায়,
ত্যাগের লোভে প্রাণকেই বলি দেয় মৃত্যুদেবতার কাছে। তাই করেছ তুমি।
প্রথম ।। আগে জেনেছি দেবতাই বরে আমরা জীবনলাভ করি। এখন বুঝছি সবই মিথ্যা।
দেবতা শুধুই ছলনা ! যদি দেবতা হ’ত, তবে সে-ই আমার জীবনের মূল্য বুঝিয়ে
দিত। জাগিয়ে দিত সত্য !
দ্বিতীয় ।। দেবতা শুধুই তো দাতা নন ! দেবতা গ্রহীতা-ও ! জীবনে যে কলঙ্ক লাগে,
সেই কলঙ্কটুকুই তিনি নিয়ে নেন। তোমার জীবন এখনও পৃথিবীতে। প্রাণটুকুই
এখানে। প্রাণের মায়া ক’জনের থাকে ! জীবনের মায়াই আমাদের নিঃস্ব করে দেয়।
আজ এই স্বর্গপুরীতে তুমি প্রাণকে ফিরে পেয়েছ।
প্রথম ।। স্বর্গপুরী !! এ মৃত্যুপুরী !! এ যদি স্বর্গ হয়, তবে ধিক্কার !
দ্বিতীয় ।। স্বর্গ জীবনের নয়, স্বর্গ প্রাণের দেশ। জীবনে যে সামান্য প্রাণের
অনুভব করতে পারে, তার মৃত্যু হয়না। স্বর্গ-ই তার কাছে মৃত্যু।
প্রথম ।। তুমি তো মৃত্যু চাওনি ? তবে এই অকালে, এই যৌবনে কেন তবে তোমার মৃত্যু ?
প্রিয়জনের মিলন থেকে এই অকালে কেন হতে হ’ল দূর তোমায় ? উত্তর আছে ?
দ্বিতীয় ।। মিলনে বাধা আছে, প্রেমে বাধা নেই।
মিলন মুক্তি দেয়, প্রেম মুক্ত করে।
প্রিয়তমকে হারিয়েছি, প্রিয়-কে নয়।
মহাদেবের তৃতীয় নয়নের অগ্নিতে মদনদেব ভস্ম হয়েছে বলেই আজ সবার মনে
বসন্ত বাসা করেছে। সে জীবিত থাকলে শুধু একটুতেই থাকত। সে নিজে নেই
ব’লেই সবার কাছে আছে। মৃত্যুর দেবতা তাই তাকে দিয়েছেলেন মৃত্যু।
প্রথম ।। তবে বলতে চাও তোমার মৃত্যু হয়নি ? তোমার দেবতা তোমায় দেখা দেননি ?
দ্বিতীয় ।। সেকথাই যে তোমায় বুঝে নিতে হবে বন্ধু। তোমার আপনজনের থেকে দূরে এসেছ,
কিন্তু আজ তাদের তুমি এখানে থেকে দেখতে পাচ্ছ। তোমার জীবনের মৃত্যুতে
প্রেমকে স্পর্শ করেছে। তুমি তাই মৃত নও ।
প্রথম ।। ফিরবার পথ নেই কোনও !
দ্বিতীয় ।। শান্তি আছে। তোমার পরিবার, তোমার আপনজনেদের মধ্যে তুমি-ই শান্তি।
তুমি-ই বিশ্বাস ! ওই চিরবিশ্বাসেই তোমার জীবন থাকবে পৃথিবীতে আর সেই
জীবনকে প্রাণভরে উপভোগ করবে। সেই জীবন কখনও মৃত হবেনা।
প্রথম ।। তোমার দেবতা-ই বোধহয় আমরা মৃত্যুকে ভয় পাইনি, মৃত্যু না হওয়ার
ভয়ই আমাদের শেষ করে দেয়। যদি এই বিষের অব্যর্থ হওয়ার প্রমাণ মিলত,
তবে কিসের থাকত মৃত্যুভয় ?
দ্বিতীয় ।। মৃত্যুদেবতা অ’ত সহজে ধরা দেননা।
প্রথম ।। ভয় সুখকে হারানোর ?
ভয় জীবনকে হারানোর ?
ভয় পাওয়াকে হারানোর ?
দ্বিতীয় ।। কোনও দ্বিধা নেই।
প্রথম ।। মৃত্যু চিনেয়েছে আমায় প্রাণ ক’তখানি !
শুধু পৃথিবীতে থাকা জীবনের জন্য নয় ;
জীবন থেমে যায়, প্রাণ চলতে থাকে।
আশ্রয় হারায় গৃহী, পথিক দেয় পথের সবাইকে দেখা।
দ্বিতীয় ।। তুমি আজ প্রাণ পেলে। পৃথিবী তোমায় বলেছিল ‘ মিলে যেতে ’ ;
তুমি মিশেছিলে, আজ মিলে গেলে। দেবতার এই দান।