ছাড়তে ছাড়তেই বোধহয় পাওয়া সম্পূর্ণ হয়। এতদিন অনেককিছুতেই ভুলে ছিলাম অনেককিছু ছিল বলে। এখন আছে একটা ঘর,একটা জানলা,এক ফালি রোদ। যা কিছু ছিল যোগসূত্র, সব গেলো একে একে। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আর ভণিতা চলে না, মিথ্যের পিলারগুলো নড়বড়ে হতে হতে ভেঙে চুরমার। বোঝা যায়, চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আবর্জনার স্তূপ সরিয়ে এবার ঘরে ফেরার পালা। বৃত্তের কেন্দ্রে যে বসে থাকে,মনে করি সে আমারই। নিজের মনে করে তাকে রেখে দিয়েছিলাম আলগোছে। ফেরার সে পথে জমে যায় ধুলোবালি, কুয়াশা, খেয়াল করিনি কোনোদিন। বৃত্তের পরিধিতে উৎসবে, উল্লাসে, আলোয় রঙিন হতে হতে এগিয়ে গিয়েছি আরো এক দুই পা। পরিধি বেড়েছে শুধু, বেড়েছে লোকের আনাগোনা।
হঠাৎ যেদিন আলো নিভলো, সব পথ অন্ধকার, মনে হলো আলো কই? আলোর পথেই পা ফেলেছি এতদিন। সমস্ত ভুলিয়ে রাখা মিথ্যেগুলো হুড়মুড় করে ভাঙছে,আমি শুনতে পাচ্ছি। সমস্ত রাত চলে ভাঙনের উৎসব। প্রথম আলো আসে আমার জানলায়,একফালি রোদ। চতুর্দিকে গরাদ, তাই এবার হাঁটতে হবে কেন্দ্রের দিকে। মনে পড়ে যায় সে মানুষ বসে আছে আমি ফিরবো বলে। কান্না পায়, এতদিন ভুলেছিলাম কি করে! এক্ষুনি যেতে চাই,এই মুহূর্তে। কিন্তু এগোবো কি করে! এই ধ্বংসের মধ্যে পথ কই?
রোদ আসে রোদ যায়,জানলা খোলাই থাকে রোজ। রোদের আলোয় তার নরম হাসির রঙ থাকে। রাত হলে আকাশ নামে জানলায়, তার আকাশডোবানো দুটো চোখ যেন বলে ওঠে “ফিরে এসো”। আমায় ফিরতেই হয়। পথ কেটে ফিরতে হয়। আলো হারিয়ে,উৎসব হারিয়ে উল্লাস হারিয়ে ফিরছি আমার কেন্দ্রে যেখানে সে বসে আছে সেই কবে থেকে। সে চলার পথে সুখ নেই, দুঃখ নেই,আছে কেবল আনন্দ। ঝড় আসে, জল পড়ে, মেঘ রোদের লুকোচুরি। কুয়াশার নীল রঙ আরো ঘন হয়।
সে তো জেগে বসে আছে, বসে আছে আমার সমস্ত হারানো দিনকাল নিয়ে। এদিকে আমার সুখ যায়, শান্তি যায়, ঘুম যায়। কুয়াশার ঘেরাটোপে লেগে থাকে হালকা রোদের লাল রঙ, জেগে থাকে রাতের আকাশে থাকা তারাদের আলো। পেছনে তাকিয়ে দেখি সেই ঘরে সেই জানলায় এলিয়ে পড়েই থাকে রোদ্দুর, চাঁদ, তারা। পরিধিই ছোট হয়ে যায় বুঝি! জানলা সঙ্গে আসে, এগিয়ে যাই সামনের দিকে। আকাশ ডোবাবে বলে চোখ তুলে চেয়ে আছে যে, তার কাছে হয়তো পৌঁছোবো না কোনোদিন, তবু কেন্দ্রে ফেরার পথ কেটে যাবো রোজ। জানলার গরাদ হয়তো খুলে যাবে একদিন, তবু চাই এ ফেরার পথ যেন শেষ না হয়। এইভাবে ছাড়তে ছাড়তে একদিন হয়তো ঠিক পৌঁছে যাবো তার কাছে, আমার নিজের কাছে।
প্রচ্ছদ: নীলিমেশ রায়