আজ অনেকদিন পর তিস্তা ছাদে উঠেছে। ছাদটা বরাবরই তার পছন্দের জায়গা। গভীর রাতই হোক বা নিস্তব্ধ দুপুর, উত্তর কলকাতার এই পুরোনো বাড়ির শ্যাওলা ধরা নিঃসঙ্গ ছাদটা তাকে সেই কোন ছোটবেলা থেকে এলোমেলো চিন্তার খোরাক জুগিয়েছে। তিস্তা এখনো ছাত্রী। দিন কয়েক আগে বাধ্য হয়ে উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে এসেছে কলকাতায় এবং বন্দী হয়েছে তার বড় প্রিয় চিলেকোঠার ঘরটাতে। বন্দী ই হয়েছে কারণ জন্মাবধি এই প্রথম তিস্তা ‘লক ডাউন’ দেখছে। দেখছে এক বিচিত্র, বিকট, অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। অবাক হয়ে দেখছে তিস্তা, তার প্রিয় ছাদটাও কেমন যেন পাল্টে গেছে। ছাদটা থেকে তিস্তার প্রিয় যে আকাশটা দেখা যায়, সেই আকাশটাও বদলে যাচ্ছে ক্রমশ।
উত্তরবঙ্গে থাকতেই তিস্তা জেনেছিল, প্রথম বিশ্ব এক অজানা মারণ ভাইরাসের দাপটে বিপর্যস্ত। পশ্চিমের হাত ধরে তার নিজের দেশেও থাবা বসিয়েছে ‘নোভেল করোনা ভাইরাস’, যাকে নিয়ে এক্ষুনি একটা আস্ত নভেল লিখে ফেলা যায়। এখন তিস্তার অখণ্ড অবসর। বই পরেই তার অনেকটা সময় কাটে। আজ এই গভীর রাতে নিঃসঙ্গ ছাদের একমাত্র সঙ্গী তিস্তা অনুভব করল এক যুগান্তরের ইশারা। কোথাও কী একটা নিঃশব্দে ঘোষণা চলছে? একটা বিদ্রোহ- একটা বিপ্লব- একটা প্রতিবাদ- একটা শাসন চলছে? কেউ কি জারি করেছে মৃত্যুর পরোয়ানা? ঝুলিয়েছে কি কেউ সাবধান বাণীর সেই নোটিশ? রক্তের কালিতে লিখে দিচ্ছে কি কেউ হুঁশিয়ারির ইশতেহার? অহিংসা নয়, ধৈর্যে নয়, অপেক্ষায় নয়, তবে কি হাজার মৃত্যুর মাইলস্টোন গুনেই রাত্রির শেষ বৃন্ত থেকে সূর্যমুখী ফোটে! ভাবছে তিস্তা। ভাবছে। ভাবাতে চাইছে তার চারপাশের মানুষগুলোকেও। তিস্তা দেখছে কটাদিন আগেও যে মানুষগুলো মন্দির মসজিদ গির্জা নিয়ে লড়াই করছিল, তারা সবাই আজ ঘরে সেঁধিয়েছে। বাঁচতে চাইছে তারা। যে ভ্যাটিকান সিটিতে পোপ কে একবার দেখার জন্য লক্ষ লক্ষ মানুষ জড়ো হত, আজ সেখানে শ্মশানের নিস্তব্ধতা। সভ্যতার আদিলগ্ন থেকে নাগরিক সভ্যতার জান্তব উল্লাসে যে মানুষ নির্বিচারে ধ্বংস করেছে প্রকৃতি পাহাড় জঙ্গল নদী সমুদ্র পশুপাখি, রেয়াত করেনি কিচ্ছু, যান্ত্রিক দাপটে অট্টহাসে উড়িয়েছে চূড়ান্ত স্বার্থপরতার ঝান্ডা, আজ সেই বিরাট, বিশাল শক্তির সামনে নেশাগ্রস্ত মনুষ্যত্বহীন মানবজাতি কি বিপন্ন? তিস্তা দেখতে পাচ্ছে প্রকৃতি যে হাসছে! নিঃশাস নিচ্ছে! আজ যে ওদের শান্তি। ভোগে, বিলাসে, আধুনিকতায় আচ্ছন্ন মৃতপ্রায় মানুষগুলো যেন কোথায় গেল! প্রকৃতি তার রূপের ডালি ছড়িয়ে সবিস্তারে সমারোহে সমাগত। আকাশের দিকে তাকিয়ে তিস্তা দেখলো, দূরের তারাগুলো আরো বেশি ঝিকমিক ঝিকমিক করে তাকে যেন ডাকছে। সময় গড়ায়। একসময় ভোর হয়। পাখির ডাক তার হুঁশ ফেরে। ভোর হয়। তিস্তার অনুভবি মন প্রসন্নতায় ভোরে যায়। এত নির্মল আকাশ। এত সুন্দর প্রকৃতি! এতটা শান্তি তিস্তা বহুদিন পায়নি। তার গর্বের, আদরের শহর কলকাতা এত বদলে গেল! তার চেনা পাড়া, চেনা গলি, এত পরিবর্তন!
মায়ের উদ্বিগ্ন ডাকে তিস্তা নেমে আসে আস্তে আস্তে। ব্যস্ত শহর ঝিমিয়ে আছে। কোনো আওয়াজ, মানুষের শব্দ নেই বললেই চলে। চা এর কাপটা নিয়ে চুপটি করে জানলার পাশে বসলো সে। এই জানলাটা দিয়ে বাইরেটা নয়, তার বাড়ির ভিতরটা দেখা যায়। ওদের বাড়িটা বেশ অন্যরকম। মাঝখানে একটাই উঠোন, আর তাকে ঘিরে ছ’টা আলাদা বাড়ি। ছ’টা আলাদা পরিবার। কেউই ভাড়াটে নয়। লিজ নেয়া বাড়ি। যাইহোক, এখানে আসার পর থেকেই সে ক্রমশ লক্ষ করছে, শুধুমাত্র বাইরে নয়, মানুষের অন্দরমহলেও এসেছে অদ্ভুত কিছু পরিবর্তন। ছবি তোলাতে বরাবরই আগ্রহ তিস্তার। ক্যামেরার শটের মতো তার অনুসন্ধানী মনে ধরা পড়েছে হরেক রকম বিচিত্র কিছু ছবি। এই ছ’টি পরিবার সকলেই বেশ প্রতিষ্ঠিত। শহর জুড়ে ঝাঁপ পড়ার কারণে অনিচ্ছাসত্ত্বেও সকলেই গৃহবন্দী। ২৪ ঘন্টার মধ্যে ৪৮ ঘন্টা বাড়িতে। মন দিয়ে তাঁদের দেখতে থেকেছে তিস্তা। মজা পেয়েছে, হাসি পেয়েছে, দুঃখও পেয়েছে। বিলু জেঠুকে দেখেছে, জেঠিমার সঙ্গে ২০ ঘন্টাই ঝগড়া করতে। বিষয়- পটল এত ট্যালট্যালে কেন? চা এ চিনিটা বড্ড কম ইত্যাদি। আবার সন্ধ্যের নরম সোহাগে চা এর কাপ হাতে জেঠিমাকে আলতো উষ্ণতায় বলতে শুনেছে, “আজ কতগুলো বছর পর সন্ধ্যেগুলো তুমি বাড়িতে!” বাকরুদ্ধ জেঠুর স্মিতহাসিটা অনুমান করেই তিস্তার ব্যাকুল মনটা আনন্দে ভরে গেছে। আবির দাকে হাতে হাত মিলিয়ে বৌদির সাথে কাজ করতে করতে বলতে শুনেছে, “আর যে কী কী করতে হবে, কে জানে!” তবে তিস্তা সবথেকে বেশি অবাক হয়েছে, তার প্রিয় রনো দাদা আর মোম দি কে দেখে। পেশাগত দূরত্ব, আদর্শগত বিরোধ, তৃতীয় ব্যক্তির উপস্থিতি ইত্যাদি নানা অভিঘাতে এলোমেলো হয়ে যাওয়া নীড় টা হয়তো নষ্ট হল না এই বন্দীদশার কারণেই। দীর্ঘ কথাবার্তায়, দীর্ঘ যাপনে সেরে গেল দীর্ঘ দিনের পুতিগন্ধময় রোগ। হয়তো খুঁজে পেল তারা একে অপরকে বন্ধুত্বে, ভালোবাসায়। ছোট্ট তাতাই বাবাকে একদম কাছে পেতনা। বাবা এখন কোথাও যাচ্ছেনা। তাই করোনা কে থ্যাংক ইউ চিঠি লিখে তিস্তা দিদি কে বলেছে, পোস্ট করে দিতে। আবার তিস্তার কানে এও এসেছে, বিলু জেঠুর কোন বন্ধু নাকি বলেছেন, ” এইভাবে সব বন্ধ করলে চলে নাকি! গরিব মানুষ খাবে কী?” তিস্তা খুব ভালো করে উপলব্ধি করে ফেলেছে, আসলে গরিব মানুষের চিন্তা নয়, মাছেভাতে বাঙালির মাছটা প্রতিদিন জুটছে না, পাঁচপদে খাবারটা ঠিক হচ্ছেনা, তাই এত্তো দুঃখ। ভোজনরসিক আড্ডাপ্রিয় বাঙালির ভোজন এবং আড্ডাতে টান, তাতেই উঠেছে ত্রাহি ত্রাহি রব। তিস্তা ভেবেই পায়না এদের বোঝানো যাবে কি উপায়ে। তার এক শিক্ষিত বন্ধু তাকে বলেছে ১৪০ কোটির দেশে ১০০ জন ও মারা যায়নি এখনো। এত ভাববার নাকি কিছু নেই। ভেবেই পায়না তিস্তা মানুষ এত তরল হয় কী করে! পাড়ার এক কাকিমাকে ঘটা করে পুজো দিতে যেতে দেখেছে সে। তার মা বারণ করাতে বেশ ঝাঁঝের সঙ্গে বলতে শুনেছে, “তা বলে পুজো দেবনা! আছিই তো ওনার কৃপায়।” তিস্তা বলেনি বা বলতে চায়নি, আরাধ্যকে ডাকতে গেলে সমাহিত হলেই চলে, আয়োজন লাগেনা। বলেনি সে, নির্লজ্জ মানুষ ঈশ্বরকে মিষ্টি নৈবেদ্য নিবেদন করার আগে সেটি নির্বাচন করে নিজের পছন্দ এবং স্বাদ অনুযায়ী। কড়া হিসেব চলে নিজের আস্বাদনের।
আবারও তার ভাবান্তর ঘটে। এবার টেলিভিশনের আওয়াজে। খবর ভেসে ওঠে টিভির পর্দায়। সারা বিশ্বে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছেন। অজানা শত্রুর আক্রমণে বিদ্ধস্ত মানুষ। আরও মৃত্যুর খবর। তার নিজের দেশেও। হঠাৎ একটা খবরে চমকে গেল তিস্তা। এখনো রমরমিয়ে চলছে পাখি ময়ূর মেরে মদ সহযোগে বনভোজন। ব্যাকুল তিস্তা উঠে পড়ে হতাশ হয়ে। তরতর করে চলে যায় চিলেকোঠার ঘরে। অস্থির ভাবে পায়চারি করতে করতে আবারও ডুবে যায় গভীর চিন্তায়।
এর শেষ কোথায়? আমরা কি একইরকম বর্বর থাকব? বারবার পৃথিবীর, প্রকৃতির ধৈর্যের পরীক্ষা নেব? আমরা কি কখনোই ঘটাব না, শাশ্বত রাত্রির বুকে অনন্ত সূর্যোদয়? সময় তো আমাদের শিখিয়ে দিলো কোনো ভোগ কোনো লালসাই অপরিহার্য নয়। আমরাই তো পারি অল্পে দিন গুজরান করতে। আমরাই পারি অপরিসীম ফুর্তি আর অহেতুক অপচয় থামাতে। পারি বাঁচতে দিতে, বাঁচতে। তিস্তাই তো দেখেছে তারই পাড়ার পাঁচ সাতটা ছোট ছেলে মেয়েদের নিজেদের রান্না করে রাস্তার কুকুরদের খাবার খাওয়াতে। মনুষ্যত্ব তো শেষ হয়ে যায়নি। অবিমিশ্র হঠকারিতায় জীবনটা না কাটিয়ে আমরাই তো পারি জীবনকে সঠিক দিশা দিতে। তিমিরবিলাসি, বিভ্রান্ত, মুহ্যমান, মোহগ্রস্থ, দুর্বল মানবজাতিকে আমরাই তো পারি তিমিরবিনাশের পথে মুক্তি দিতে। ভাবতে ভাবতে তিস্তার চোখ লেগে আসে। ভেসে যেতে থাকে তার স্বপ্নের পৃথিবীতে। তিস্তা জানে, “মিলবেই তাদের অবাধ স্বাধীনতা……।”