অন্ধকার অসময় থেকে সুসময়ে ফেরার ছোটগল্প – শাল্মলী রায়


“Leaves. On the ivy vine. When the last one falls I must go, too. I’ve known that for three days. ” – The Last Leaf, O. Henry

জানলাটায় ছুঁয়ে সূর্যের আলো ঘরে এসে পড়ছিল। আর সে গুনে চলছিল একটা দুটো করে পাতা। নভেম্বর। পাতা ঝরার মরশুম। শীত আসার আগে, একেবারে জরাগ্রস্ত হবার আগে পৃথিবীর শেষ হাসি। শেষ পাতাটা ঝরবে যখন তখনি আসবে শীত; তখনি আসবে মৃত্যু; তখনি আসবে তুলির শেষ আঁচড়, জীবনের মহাকাব্যে। আসবে মেঘ, আসবে তুষারপাত। আর একেবারে ঘুমিয়ে পড়ার আগে শুনশান জানলায় সে গুনবে শেষ পাতাটা। The last ivy leaf….

এটুকু পড়েই চোখ ঝাপসা হয়ে এল। আর পড়তে পারলাম না। খেয়াল করলাম জানলা দিয়ে আলোও কমে এসেছে।সূর্যাস্তের আভা এসে পড়ছে বইয়ের পাতায়। ওয়াশিংটন থেকে অনেক দূরে আমার শহর; মাসটাও নভেম্বর নয়, চৈত্র মাসের শেষ বসন্ত। ফোঁটা ফুল বা ঝরা ফুলের হিসেব রাখার বসন্ত এবার আসেনি। এবার বসন্ত মৃত্যুর শীতলতা নিয়ে এসেছে। নিউমোনিয়ার লোকালয় উজাড় করা ঠান্ডা আঙুলের মত আঙুলে এখন সারা পৃথিবী ছুঁয়েছে কোরোনা নামক ভাইরাস ।সারা প্রকৃতি যখন নিত্য নতুন রঙে মুড়ে দিচ্ছে তার অঙ্গ, তার সৌন্দর্যের ডালা উপুর করে দিয়ে চলেছে চোখের সামনে, তখন আমাদের মন ‘selfish giant’ এর বাগান । এই বাগানে কেবল অপেক্ষারা সঙ্গী । কবে সত্যিকরের বসন্ত আসবে? আকাশটা কমলা রঙে সেজে উঠেছে। তবু মনে হচ্ছে আমি, আমরা আমার শহর আমার দেশ , পৃথিবী আসলে সেই Johonsy র মতই গাছের পাতা গুনছি।বা Sue এর মত বুঝতে চাইছি কোন পাতায় লেখা আছে আমার বা আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষের মৃত্যু পরোয়ানা। আর কেবল ম সান্তনা দিয়ে চলেছি যে সমুদ্রের ছবি আঁকার মত তারও কোনো স্বপ্ন ছিল। স্বপ্নটা মৃত্যুর চেয়ে অনেক বড়! স্বপ্নটা সত্যি হবে! ঠিক সুসময় আসবে।


আমরা আসলে বুঝিনি নিউমোনিয়ার মতো ভয়ংকর এক রোগ গ্রাস করেছিল আমাদের মানবিকতার অস্তিত্ব। বহু শতাব্দী ধরে অমানবিকতার নিউমোনিয়া কুরে কুরে খেয়েছে আমাদের আমরা টের পাইনি। বা বলা ভাল টের পেতে চাইনি।যখন টের পেলাম তখন গাছের পাতাগুলো ঝরতে শুরু করেছে,বাকি আছে কটি মাত্র পাতা। কিন্তু সত্যিই জানিনা শেষ পাতাটা ঝরে যাবে কিনা কিংবা শেষ পাতার সঙ্গে আমরাও হারিয়ে যাব কিনা।


O. Henry এর গল্পটা শেষ হয়েছিল একটা মৃত্যুর বিনিময়ে স্বপ্ন কে বাঁচিয়ে দেবার রেশে। শিল্পীর নিজেকে শেষ করে শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার রেশে আর সেই সাথেই শিল্প দিয়ে জীবনকে বাঁচিয়ে দেবার, জিতিয়ে দেবার রেশে। আমরাও এখন মৃত্যুর মুখোমুখি। অসহায় আত্মসমর্পণের ঠিক আগের মূহুর্তে দাঁড়িয়ে আছি। Behrman এর মত কেউ আসবে? যে মৃত্যুকে বুকে নিয়ে শিল্প কে বাঁচিয়ে দেবে? বাঁচিয়ে দেবে জীবনকে? যে বসন্তকে এনে দেবে?


শুনেছি অসময় তার সঙ্গে এক বন্ধু নিয়ে আসে। কিছুদিন আগে বন্ধুদের সঙ্গে অর্ক মুখার্জির এক অনুষ্ঠানে শুনেছিলাম মানুষের পাশে থাকার মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার গান ।শেষের সমবেত গানে চোখের জলে বুঝেছিলাম যে মানুষই পারে অসময়কে পাল্টাতে।আমরাই পারি অসময়ের উর্ধে উঠে পৃথিবীকে বাঁচাতে। এখনো সবটা শেষ হয়ে যায়নি।এখনো Behrman এর মত মানুষেরা লড়ে চলেছে নিজের সব অসহায়তাকে উপেক্ষা করে। এঁকে চলেছে তার মাস্টার পিস, সবার অলক্ষে, সব প্রতিবন্ধকতাকে হেলায় দূরে সরিয়ে রেখে। আমরা কি এবার সত্যিই খুঁজে নেবনা তাদের? Sue বা Johnsy পারেনি কিন্তু আমরা তো পারি তাঁকে বা তাদের খুঁজে নিতে? তাদের মাস্টারপিসকে স্বীকৃতি দিতে? নিজেদের মানবিকতা আর শুভবোধ কে জিতিয়ে আমরাই পারি কোরোনা ভাইরাস পরবর্তী জীবনে শুধুই মানুষের পাশে ভালোবাসার দুহাত বাড়িয়ে দিতে। এখন কেবল সেই দিনটার অপেক্ষা, যেদিন সব ভালবাসাগুলো আবার ছুঁয়ে দেবে একে অপরকে, তৈরী হবে জীবনের চিরকালীন মাস্টার পিস।


মূল গল্প Link :

http://www.eastoftheweb.com/short-stories/UBooks/LasLea.shtml

ছবি: প্রীতম চৌধুরী