জানুয়ারী মাসের শেষে যেদিন কলকাতা থেকে প্রায় ১২ হাজার কিলোমিটার দূরে ম্যাসাচুসেট্স এর অম্হের্স্ট শহরে ফিরলাম, সেদিন ও বুঝতে পারিনি যে অদূর ভবিষ্যতে কি অপেখ্যা করছে আমাদের জন্য।ভাবতেই পারিনি যে ভিন-দেশের এক ব্যাধি কি ভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মহামারীর আকার ধারণ করে সমগ্র বিশ্বের মানুষের জীবন কে প্রভাবিত করবে। সে জানুয়ারীর কথা, Covid 19 তখন চিনে তান্ডব মাতিয়েছে, সুদূর এই আমেরিকায় তার প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। অম্হের্স্ট এ ফিরে এসে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে গেলো, অন্ততো তাই মনে হয়েছিল। ফেব্রুয়ারী মাস টা মোটের মধ্যে নির্বিঘ্নেই কাটলো।
কিন্তু মার্চের গোড়া থেকেই আভাসটা বুঝতে পারলাম। রিসার্চ এর কাজ আর পড়ানোর ফাঁকে যেই সময়টা বের হয় তাতে আমরা মানে আমার মতো আমার বন্ধু সামাজিক গবেষকেরা মাঝে মধ্যেই আড্ডা দিই। সেই আড্ডার মূল বস্তু যখন আমেরিকা আর ইরান এর মধ্যে অবনমিত রাষ্ট্রনীতি, ট্রাম্প এর ইমপিচমেন্ট, ডেমোক্রেটিক পার্টির ডিবেট বা ভারতের নাগরিক আইন, দিল্লীর দাঙ্গা থেকে বদলে গিয়ে কেবলি Covid 19 নিয়ে শুরু হলো তখন থেকেই প্রমাদ গুনতে শুরু করলাম।
মার্চ এর প্রথম সপ্তাহে করোনার কারণে আক্রান্তের সংখ্যা খানিকটা বাড়তেই হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড, কলম্বিয়ার মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলি নিজেদের ক্যাম্পাস বন্ধ করে, পড়াশোনা আর গবেষণা অনলাইন এ পরিচালিত করবার সিদ্ধান্ত নিলো। ১১ ই মার্চ আমাদের ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ও সেই সিদ্ধান্তই নিলো।পরিস্থিতি কি দাঁড়াতে চলেছে তা বুঝতে পারাটা অসম্ভব সেই সময়ে। শুনলাম আমার অনেক বন্ধু’ই নিউ ইয়র্ক বা ক্যালিফর্নিয়া থেকে দেশে ফিরে যাচ্ছে। বাড়ি তে বাবা মা’এর কথা প্রায় অগ্রাহ্য করেই সিদ্ধান্ত নিলাম এই দুর্দিনেও দূরের এই দেশে থেকে যাবো। এর মধ্যে আমার এক বন্ধুর শরীর বেশ খারাপ হলো, ৫ দিন ধরে জ্বর, সারা শরীরে ব্যাথা, শুকনো কাশি- Covid19 এর সমস্ত লক্ষ্যন ই প্রকাশ পেলো, অথচ ডাক্তার পরীক্ষা না করিয়েই ওকে দু সপ্তাহ গৃহবন্দী হয়ে থাকতে বলে দিলো। শুনলাম এরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে অনেকেরই।আসলে মার্চ মাসের শুরুর দিকে পরীক্ষা-বিহীন পরিস্থিতিতে আমেরিকার বেশির ভাগ জায়গাতেই এইভাবে Covid19 পরিস্থিতির সঠিক প্রতিবেদন হয়নি।
১৩ই মার্চ সমগ্র দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলো রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প। এর মধ্যেই শুরু হলো আর এক উপদ্রব।মাঝে মধ্যেই খবর এ দেখছিলাম যে বাজার থেকে নাকি দৈনন্দিন আবশ্যক সামগ্রীর ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বিপদের মুখে বেশির ভাগ লোকেরা আবশ্যক সামগ্রী মজুত করা শুরু করেছে।সপ্তাহান্তে বাজার করবার পরিকল্পনা করেছিলাম।কলকাতায় যেমন বাড়ির বাইরে বেরোলেই বাজার, সেখানে সব কিছুই পাওয়া যায়; অম্হের্স্ট এর মতো একটা ইউনিভার্সিটি টাউন’এ কিন্তু সে সুবিধা নেই। এই দেশে বেশির ভাগ ইউনিভার্সিটি টাউন গুলোই গড়ে উঠেছে নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে। এখানে বাজার বলতে Wholefoods, বা Trader Joes এর মতো সুপারমার্কেট ‘গুলির সাপ্লাই-চেন এর কথা বলছি যা ক্যাম্পাস থেকে প্রায় কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত। অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা করাই আমার কাজ, তাই ঘাটতির এই ব্যাপারটা যাচাই করবার জন্য বাজারে গিয়ে দেখলাম ব্যাপারটা অনেক’টাই সত্যি।হ্যান্ড স্যানিটাইজার, কাগজের তোয়ালে, হাত ধোবার সাবান মেলাই ভার।এমনকি মাংস, টাটকা সবজি না পেয়ে শেষ-মেষ ফ্রোজেন আর ক্যান্ড খাবার কিনতে বাধ্য হলাম।পরের সপ্তাহে অবশ্য সেই সমস্ত সুপারমার্কেট গুলি তে সামগ্রী এসেছে শুনে তরী ঘড়ি গেছিলাম বাজার করতে। প্রচুর ভিড় এর সম্মুখীন হয়া সত্ত্বেও এবার আশাহত হলাম না, মোটামুটি সপ্তাহ দু এক এর মতো আবশ্যক কিনে নিয়ে ফিরলাম বাড়ি।
মানুষের আতঙ্ক যে কতটা বাড়াবাড়ি আকার ধারণ করতে পারে তা সেদিন বাজারে না গেলে বোধয় বুঝতে পারতাম না।আরো একটা জিনিস অনুভব করেছিলাম সেদিন: দুর্দিনে এই উন্নত দেশের মানুষগুলির প্রতিক্রিয়া উন্নতশীল দেশের মানুষের মতোই। সিরিয়া থেকে যখন উদ্বাস্তু সমস্যা বেড়ে গিয়েছিলো তখন ইউরোপীয় সভ্যতা তিরস্কার করেছিল সেই সমস্ত দীনজনদের। রোহিঙ্গ্যার উদ্বাস্তুদের অসহায়তা দেখে উন্নত দেশের অনেকেই সমালোচনা করেছিল ওদের।আজ এই দুর্দিনে এই বিশেষাধিকারভোগি কিছু শ্রেণীর মানুষ যখন আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে নিত্য দৈনন্দিন আবশ্যক সামগ্রী মজুত করা শুরু করেছে, তখন ভাগ্যের এই পরিহাস দেখে বেশ অদ্ভুত লাগলো। বুঝলাম দুর্দিনে মানুষ একরকম ভাবেই ভাবতে শুরু করে, অর্থনীতি তে আমরা যাকে বলে থাকি “ইন্ডিভিজুয়াল রাশনালিটি, কালেকটিভ ইররাশনালিটি” (Individual Rationality, Collective Irrationality)।
এর মধ্যেই দেখতে লাগলাম করোনার কারণে কি ভাবে সমগ্র দেশে ভীতি আর আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। যতই দিন যেতে লাগলো, আক্রান্তদের সংখ্যাও ততই ক্রমে বাড়তে লাগলো। আরো অদ্ভুত লাগলো কি ভাবে এই মহামারী নিয়েও চূড়ান্ত পর্যায়ের রাজনীতির খেলা শুরু হয়েছে। আমাদের দেশে কেন্দ্র আর রাজ্য সরকার এর মধ্যে বনিবনার অভাবে সাধারণ মানুষদের কে প্রভাবিত হতে দেখেছি, কিন্তু এই দেশেও যে এরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এই মহামারী নিয়ে রাজনীতি হবে তা ভাবি নি। ব্যাপারটা তবে আরেকটু বুঝিয়ে বলি।এই বছর নভেম্বর মাসে এই দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হওয়ার কথা, আর তার আগে করোনার কারণে নানারকম নিষেধাজ্ঞার প্রভাবে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা আসার পরিস্থিতি হয়েছে। আর নির্বাচনের বছরে মন্দা কোনো ভাবেই দেশের রাষ্ট্রনেতার জন্য সুখবর নয়। এই কারণেই ট্রাম্প মার্চ এর শেষ অবধিও চেষ্টা চালিয়েছে যাতে বেশিরভাগ রাজ্যে সম্পূর্ণরূপে লকডাউন না হয়। জরুরি অবস্থা জারি হলেও বিমান বা ট্রেন পরিষেবা এখনো বন্ধ হয়নি এদেশে।এমনকি মার্চ মাসের শেষের দিকেও বহু রাজ্যে নিষেধাজ্ঞার অভাবে মানুষ বাইরে বেরিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করেছে। সঠিক নীতি রূপায়ণ এর অভাবেই আজ এদেশের এমন দুরাবস্থা। যখন পরিস্থিতি আয়ত্তের বাইরে বেরিয়ে গেছে, তখন সেই অভাব ঢাকতে চীন বা দেশের ভগ্ন স্বাস্থ পরিষেবা এমনকি বারাক ওবামাকেও দোষারুপ করতে কুন্ঠা বোধ করেনি রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প।
অথচ মূল সমস্যা কিন্তু অন্য জায়গায়। এই দেশে ভেন্টিলেটর, হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা ফেস মাস্ক এর মতো খুবই সাধারণ অথচ গুরুত্বপূর্ণ জিনিস সরবরাহ করে এখানকার বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি।আমেরিকার স্বাস্থ-পরিষেবা সম্পূর্ণ রূপে বেসরকারি হওয়ার কারণে আছে উদার বাজার অর্থনীতির প্রভাব।তাই এরকম দুর্দিনে অত্যাধিক চাহিদার বাজারে ঘাটতি সৃষ্টি হওয়াটা খুব একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার না, এই সময় তাই সরকারি হস্তখেপ অবশ্যম্ভাবী হয়ে পরে। অথচ এরকম ভীষণ পরিস্থিতিতেও এখানকার রাষ্ট্রপতি কিন্তু নিজের রাজনীতি ছাড়েনি; যে সমস্ত রাজ্য বিরোধী পক্ষ্য অর্থাৎ ডেমোক্রেটিক পার্টির দ্বারা পরিচালিত, এবং যাদের গভর্নর’রা ট্রাম্প এর বিশেষ অনুরাগী নয়, তারা বিশেষ সাহায্য থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সি, ক্যালিফর্নিয়া, ম্যাসাচুসেটস, বা ওয়াশিংটন সমূহ ডেমোক্রেটিক পার্টির দ্বারা পরিচালিত রাজ্যের বাসিন্দারা করোনার কারণে এবং রাজনীতির শিকার হয়ে সব থেকে বেশি প্রভাবিত হয়েছে আজ।
কিন্তু এতেও সম্পূর্ণ ধাঁধার সমাধান হলো না। আমার চেনা পরিচিত অনেকেই জানতে চেয়েছে যে আমেরিকার মতো একটা উন্নত দেশের আজ এরকম করুণ অবস্থা কেন। এটা তো কেবল মাত্র রাজনীতির পরিণাম হতে পারে না।এই ব্যাপার টা কে সম্পূর্ণ রূপে বুঝতে গেলে তাহলে এই দেশের সমাজ নিয়ে আলোচনা প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। রুপোলি পর্দায় যেই মার্কীন সমাজ কে দেখে অনেকএই আমেরিকান ড্রিম’এর চিন্তায় মগ্ন থাকেন, তারা দেশের আরেকটা রূপ বোধ করি জানেন না।তা হলো এই দেশের বৈষম্য, যা আরো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বাজার অর্থনীতি এর প্রভাবে।নব্যউদার বাজার অর্থনীতির এর ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই সমাজে বৈষম্য করোনার থেকেও বড় মহামারী।নিউ ইয়র্ক এর সারি সারি উঁচু উঁচু বাড়িগুলি যেমন সত্য, ঠিক তেমনি ওখানকার সাবওয়ে বা রাস্তায় ভিকারীদের করুন স্বরও ততটাই সত্য।তফাৎ আমরা কোন সত্যকে সাগর পাড়ের মানুষের কাছে তুলে ধরি। এই দেশে এখনো বহু মানুষের কোনো ইন্সুরেন্সই নেই, যাদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ এবং ল্যাটিন আমেরিকানদের সংখ্যা অনেক বেশি।তাই বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার ফলে বাসস্থান বা খাদ্যাভাবের সাথে সঠিক চিকিৎসার অভাবেও এই মানুষগুলিই বেশি আক্রান্ত হবে। বর্ণ বৈষম্যের থেকেও স্বাস্থ, শিখ্যা, ও নাগরিক পরিষেবার সুযোগ পাবার এই বৈষম্য বোধয় আরো বেশি কুৎসিত, যা নব্যউদার পুঁজিতন্ত্রের চরম পর্যায়ে পৌঁছে এদেশের বহু মানুষ অনুভব করতে পারছে আজ। করোনার মতো মহামারীর প্রকোপ মার্কীন সমাজের ভগ্ন কুৎসিত এই চেহারাটাকে আজ প্রকাশ করেছে বাইরের মানুষের কাছে।বিজ্ঞানের জন্য আমরা এই করোনাকে হয়তো জয় করতে পারবো খুব শীঘ্রই, কিন্তু করোনার কারণে মার্কীন সমাজের যেই কুৎসিত চেহারা আজ বিশ্বের কাছে ফুটে উঠেছে, তা ঠিক করতে হলে বোধয় সমাজের এক বিপুল পরিবর্তনের দরকার হয়ে পড়বে অদূর ভবিষ্যতে।
ভাল লাগল। কিন্তু একটা প্রশ্ন আছে। করোনার সংক্রমণ কি তাহলে প্রান্তিক মানুষদের মধ্যেই বেশিআগে ছড়িয়েছে? আক্রান্তের সংখ্যা কাদের মধ্যে বেশি?
LikeLike
ধন্যবাদ আপনার প্রশ্নের জন্য। ঠিকই বলেছেন, করোনা আক্রান্তদের মধ্যে আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের সংখ্যা অন্য জাতীয় গোষ্ঠীর থেকে বেশি। যেমন ধরুন, শিকাগোতে এপ্রিল মাস অবদি মৃতদের মধ্যে কৃষ্ণাঙ্গের সংখ্যা ৭২ শতাংশ। এর কারণও আছে, কৃষ্ণাঙ্গ বা ল্যাটিন আমেরিকানরা এমনিতেই মার্কীন সমাজে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সবথেকে বেশি অবহেলিত। এরকম অতিমারীর সময়ে ওদের অবস্থা আরো করুন হয়ে দাঁড়িয়েছে চিকিৎসা, বাসস্থান এবং খাদ্যাভাবের দরুন। এর মানে যে করোনা কেবল এই এক শ্রেণীর মানুষকেই আক্রান্ত করেছে তা কিন্তু নয়। করোনার শিকার আজ পৃথিবীর সবাই- সামাজিক কোনো শ্রেণী-বিভাজন সে মানে না, কিন্তু কৃষ্ণাঙ্গ এবং ল্যাটিন আমেরিকানরা করোনার দ্বারা আপেক্ষিকভাবে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্বেতচর্ম এবং ককেশীয়দের থেকে।
LikeLike