অগ্নিহোত্র – অভিজিৎ লাল রায়

বেশ গরম পরেছে কয়েকদিন ধরে; দমবন্ধ করা গরম। বুকের ভিতরটা কিরকম ভারী লাগছে! কেন এরকম হচ্ছে, কিসের অস্বস্তি? একটা ফিল্ম এর শট এর মতন ছবিগুলো ভেসে আসছিল।  কোন নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে, নাকি এলোমেলো, তাৎপর্যহীন কিছু ছবি? অফিসের কিছু কাজ মাথায় ঘুরছিল।করতে ইছেও করছে না। আজ পনেরোদিনের উপরে হয়ে গেল বাড়িতে বসে।বাড়িতে বসে কিছু কাজ গোছানো। কিসের গোছানো? কেন গোছানো? সব কিছু তো এলোমেলো, ওলটপালট হয়ে গেছে গত কয়েক দিনে। যা কিছু গোছানো ছিল সব অগোছালো হয়ে গেছে; রাস্তা-ঘাট, দোকান-বাজার, বাস-গাড়ী, যা কিছু গোছানো দেখতে অভ্যস্ত, সব অগোছালো হয়ে গেছে। হঠাৎ করে একটা জাল এর ঘেরাটোপ উপর থেকে চাপিয়ে দিলে যেরকম হয়, সেই ঘেরাটোপ- এর মধেই বন্দী থাকা, দমবন্ধ হয়ে আসা! কিন্তু বাইরে তাকিয়ে যতটুকু দেখতে পায়, কিরকম গোছানো হয়ে গেছে সব; গোছানো আকাশ, গোছানো গাছপালা, গোছানো পাখিদের জীবন!আর সন্ধ্যাবেলা যখন অবিন্যস্ত হাওয়া দেয়, ঐ ঘেরাটোপ-এর উপর আছড়ে পরে, আয় আয় করে ডাকতে থাকে,যখন শৈশব ডাকে আয়, আয় করে, তখনই, ঠিক তখনই ঘেরাটোপ ছিঁড়ে, খুঁড়ে বেড়িয়ে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে ছুঁতে ঐ গোছানো আকাশ, গোছানো গাছপালা, গোছানো পাখিদের জীবন!  

ছোটবেলা থেকে বাবাকে দেখে এসেছে শয্যাশায়ী । সবাই বলতো বাবার অসুখ সেরে যাবে। কিছুদিনের মধ্যেই ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া বাবার কপালে হাত বুলিয়ে বুঝেছিল এই অসুখ সারে না। বাবা যেমন ওই অসুখে অকালে বুড়িয়ে গিয়েছিলেন, সেইরকমই অকালে বুড়িয়ে যাওয়া পৃথিবীর, পৃথিবীর মানুষের গভীরতর অসুখ এখন।

এক অদৃশ্য শত্রুরর সঙ্গে যুদ্ধ চোখের উপরে ভেসে ওঠে ‘মার’ এর ছবি। অবনীন্দ্রনাথের আঁকা না? ওই ‘মার’ পুরো পৃথিবী কে শক্ত করে কামড়ে ধরেছে । ট্যারান্টুলা মাকড়সার রসে আটকে থাকা শিকার যেরকম নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পারেনা, আস্তে আস্তে মুখের কালো গহ্বরে ঢুকে যায় ওই মাকড়সার, সেই রকম ভাবেই পৃথিবী ঢুকে যাচ্ছে ওই ‘মার’ এর কালো গহ্বরে, অতিমারীর ওই কালো গহ্বরে । 

ভাবতে ভাবতে আরও নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, আর বুক এর উপরে চাপটা বেড়ে যায় যেন । অতিমারীর মুখের গহ্বর থেকে বাঁচতে গেলে একজন মানুষকে আর একজন মানুষের থেকে ছিটকে দূরে সরে যেতে হবে । যে ছিটকে দূরে সরে যেতে পারবে, সে বেঁচে যাবে ওই মুখের গহ্বরে ঢুকে যাওয়া থেকে । যে অতিমারীর ওই ছোবল খাবে, যে নেবে ওই বিষ, সে ঢুকে যাবে ওই মুখের গহ্বরে। চোখের সামনে গোষ্ঠী, যূথ’ সমাজ সব ভেঙ্গে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে পরছে, সব যূথবদ্ধতা অসাড় হয়ে যাচ্ছে ওই মুখগহ্বরের কাছে গিয়ে। পৃথিবীর গভীরতর অসুখ এখন, মানুষের গভীরতর অসুখ এখন ।

ঘামে ভিজে  উঠেছে কপাল, ঘাড়, কাঁধ। অনেক ভেবেছে আর ভাববেনা। মৃত্যু যখন একটা সংখ্যা, একটা গ্রাফ, তখন এই গুলো নিয়ে আর ভাববে না। বুকের উপর থেকে পাশে পড়ে যাওয়া খবরের কাগজটা সরিয়ে রাখতে গিয়ে আবারও চোখ  আটকে যায় ওই গ্রাফ এর দিকে। মৃত্যু, সার দিয়ে মৃত্যু। এক কোষ থেকে আরেক কোষে ছড়িয়ে পরা মৃত্যু, পঙ্গপাল এর মতন ঝাঁপিয়ে পড়া, প্রাণের রস নিংড়ে নেওয়া মৃত্যু! কিসের আকর্ষণে মানুষগুলো মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেল? পিতা দেখল পুত্র কে, পুত্র দেখল মা কে, স্ত্রী দেখল স্বামীকে এক অমোঘ আকর্ষণে মৃত্যু ডাকছে। মৃত্যু এত শীতল, এত নিস্পলক তার চাউনি; চোখের পাতা পরছে না যে্ন! কতক্ষণে, কতক্ষণে ঐ মুখগহ্বরে টেনে নেবে সবাইকে।

খবেরর কাগজের একটা খবর থেকে দাবানলের মতন ছড়াতে লাগলো খবর। ভাইরাস এক মানুষের শরীরে বাসা বেঁধে, তাকে মেরে আর একটা শরীর খুজছে; কখন ওই আর একটা শরীরে বাসা বাধবে, মারবে তাকে। তারপরে, এক শহর থেকে আর এক শহর, এক প্রদেশ থেকে আর এক প্রদেশ, এক দেশ থেকে আর এক দেশ, এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশ । সবাই ন্যুব্জ ওই অতিমারীর মুখের সামনে গিয়ে। উন্নত দেশের উদ্ধত রাষ্ট্রপ্রধান বিমূঢ় । প্রলাপ বকছেন তাই। আর এক গোপনে হাসা রাষ্ট্রপ্রধানের মাথা উঁচু করে থাকবার নিষ্ফল চেষ্টা করেও এবারে ন্যুব্জ হয়ে যাবার পালা । হাতে একটি অস্ত্র; অনুশাসন। মানুষ কে জালের ঘেরাটোপে ঘিরে ফেলা। অদৃশ্য শক্তি যুঝবার ওই একটা অস্ত্র; অনুশাসন। মানুষ কে জালের ঘেরাটোপে ঘিরে ফেলা । শাস্ত্রের বিধি যেমন । ওই ঘেরাটোপের মধ্যে থেকেও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে । এখন দধীচি আর নেই যে, নিজের হাড় দিয়ে বাঁচাবেন মানুষের জীবন। গভীর থেকে পচে যাওয়া সমাজের গভীরতর অসুখ এখন । মনের বিচ্ছিন্নতা আগেই ঘটে গিয়েছিল, এখন ঘটে যাচ্ছে শরীরের বিচ্ছিন্নতা। জায়মান বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে এক থেকে আর এক জনের মধ্যে । দরজার ফোঁকর থেকে উঁকি মেরে দেখতে হয় আর এক মানুষ কে; ভয় এখন, ত্রাস এখন, গভীরতর অসুখ এখন। শব্দ স্তিমিত, চেনা মানুষের গায়ের গন্ধ পাওয়া যায়না আর। নিশ্তব্ধতা, নির্জনতা নির্বাক, নির্মোহ, নিরেট।

ক্রমশ ঘুমের অতলে চলে যাচ্ছে সে; গভীর থেকে আরও গভীরতায় । 

আরে, অদ্ভুত তো; কি দেখছে! একটা গুহার মধ্যে কয়েকজন নরনারী; নগ্ন তারা, একে অপরের গা ঘেঁসে বসে আছে । উষ্ণতার সন্ধানে তারা। কিন্তু উষ্ণতা কই? হাড় উপড়ে বার করে দেবার মতন শীতলতা। নগ্ন নারীপুরুষ আলিঙ্গন করে একে অন্যকে, একের শরীর অন্যের শরীরে মিশে যায়। কিন্তু অনেক, অনেক বেশি উষ্ণতার প্রয়োজন তাদের। স্নায়ু শীতল হয়ে আসছে, অবশ হয়ে যাচ্ছে হাত-পা, শরীর। কোথায় পাবে সেই অনাস্বাদিত উষ্ণতা? ওরা দেখেছে দূরে গাছের মাথায় মাথায় হঠাৎ এক উজ্জ্বলতা, ওদের শরীরে ছিটকে আসে উত্তাপের সেই উজ্জ্বলতা। অসাড় হয়ে যাওয়া শরীরে দলপতি ভাবে, আনা যায় কি ওই উজ্জলতা নিজেদের জীবনে? ভাবে যে মানুষের শরীরে ঘষলে যে উত্তাপের সৃষ্টি হয়, সেইরকম একটা পাথরের সঙ্গে আর একটা পাথর ঘষা খেলে কি বেরোবে সেই উত্তাপ? ভাবে সে, উত্তর পায় না সহসা।

গুহার সামনে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার ঘুরে বেড়ায়, ওই নগ্ন নারী পুরুষের মাংস দরকার তাদের। দলপতি দল-এর লোকেদের বলে ‘তোমরা ছুঁচোলো করা পাথর ছুঁড়ে মারো। মারতে না পারো, দূরে রাখো তাদের’। দল ছুঁচোলো করা পাথর ছুঁড়ে মারে। হিংস্র জানোয়ার গুলো দূরে সরে যায় আর দু একটা সেই পাথারের ঘায়ে মারা পরে। 

একদিন সেই ছুঁচোলো পাথর আরো ছুঁচোলো, আরো ছুঁচোলো করতে গিয়ে, দুই পাথরের ঘষা লেগে কি যেন একটা বেরিয়ে এল – উজ্জ্বলতা, দূরে গাছের মাথায় যা জ্বলতে দেখেছে! ও কি ও? ঐ উজ্জ্বলতা? অন্ধকার’ দূরে সরিয়ে দিচ্ছে, দিচ্ছে তাদের শরীরের সেই বহুকাঙ্খিত উত্তাপ! এই উত্তাপ-ই তো তারা খুঁজছিল ।দলপতিকে মাথায় ঘিরে নিয়ে নাচতে থাকে সেই নগ্ন মানুষ মানুষী; কি জিনিস আবিষ্কার করেছে তারা ! সকলে মিলে গোল করে বসে সেই উজ্জ্বলতা ঘিরে, একে অপরের গা ঘেঁসে। তারা একে অপরের শরীরের ভাষা বোঝে যে, সেই উজ্জ্বলতার উত্তাপ, আনান্দের স্রোত প্রত্যেকের শরীরে ছরিয়ে পড়ছে, তারা হাতের মুঠোয় পেয়ে গেছে আগুন! ওরা তো দেখেছে যে গাছের মাথায় জ্বলতে থাকা আগুন যখন ছড়াতে থাকে, লাফাতে থাকে, তখন অনেক জন্তু-জানোয়ার ভয়ের চোটে চিৎকার করতে করতে এদিক ওদিক ছুটে বেড়ায়, মারা পরে বেশ কিছু।তাহলে তো শিকার করা জন্তুগুলোর শরীর এই আগুনে ঝলসানো যায়। দলপতিকে গিয়ে আবার বলে সেই কথা। দলপতির নির্দেশে দলের লোকেরা ঐ অগ্নিকুণ্ডের মধ্যে ফেলে দেয় শিকার করা জন্তু-জানোয়ারের শরীর। ঝলসানো শরীরের স্বাদই আলাদা!’ তাহলে আমরা আজ থেকে এইরকম ঝলসানো মাংস খাই, দলপতি’? দলপতি আত্মতৃপ্তির হাসি হাসেন। বলেন, ‘চল আজ আমরা সবাই মিলে গোল করে বসে খাব এই ঝলসানো মাংস’। একসঙ্গে  গোল করে বসা, একসঙ্গে আগুনের উত্তাপ নেওয়া, একসঙ্গে খাওয়া, একসঙ্গে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার তাড়ানো, জয়ের উল্লাসের এক সুর;  আগুনই দল কে আর দৃঢ়বদ্ধ করে। 

তার দেখা আরও এগিয়ে যায় খানিক। আরও দেখে; পিতা আজ বসবেন যজ্ঞে ঊষাকালে পুত্রকে নিয়ে নদীতে স্নান করে পিতা ও পুত্র উভয়েই শুভ্র পট্টবস্ত্র পরিধান করেছেন। পুত্রের কপালে রক্তচন্দন লেপন করে; সেই চন্দন নিজের কপালে লেপন করেছেন পিতা। পুত্র অধীর আগ্রহে, পিতাকে জিজ্ঞাসা করে, “পিতা, কি যজ্ঞ হবে আজ, কেন এই বিশেষ আয়োজন ?” পুত্র দেখে পিতার শরীর উত্তেজনায় কম্পমান। দীপ্ত প্রদীপের শিখা যেন! পিতা অপলকে চেয়ে রয়েছেন অনেক দূরে । তাঁর চোখের পলক পড়ছেনা। অনেক জিজ্ঞাসার পরে সম্বিৎ ফিরে পান পিতা। কোনো গুহাকন্দর থেকে যেন নির্গত হয় পিতার কণ্ঠ, যেন পাঞ্চজন্য বেজে ওঠে । পিতার মুখেই শুনেছে, যুদ্ধের প্রস্তুতি হিসেবে বাজে পাঞ্চজন্য। তার শান্ত, সৌম্য পিতা আজ কোন যুদ্ধ করবেন? কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবেন ? কম্বুনিন্দিত কণ্ঠে পিতা বলেন, “আজ আমি তোমাকে শেখাব অগ্নিহোত্র যজ্ঞ”। পিতা কে আবারও জিজ্ঞাসা করে পুত্র, “পিতা অগ্নিহোত্র যজ্ঞ কি?” আবারও কোথাও দূরে হারিয়ে যান পিতা। আবার দূর থেকে এসে বলেন, “এই যজ্ঞের অগ্নি প্রজ্বলিত করলে তা নির্বাপিত হয়না। জ্বলে, অনির্বান, অবিকম্প”। পুত্র পিতাকে জিজ্ঞেস করে, “সেও কি সম্ভব পিতা?” পিতা সেই অবিকম্প অগ্নিশিখাকে যেন কন্ঠে ধারণ করে বলেন, “অসম্ভব কে সম্ভব করার প্রতিকল্পই এই অগ্নিহোত্র যজ্ঞ। পুত্র, আমি আজ তোমাকে শেখাব এই অগ্নিহোত্র যজ্ঞ-প্রক্রিয়া, শেখাব তার মন্ত্র। পুত্র আবারও পিতা কে বলে, “পিতা আপনি যেন অনেক দূরে চলে গিয়েছেন, আপনার কণ্ঠ যেন অনেক দূর থেকে নির্গত হচ্ছে, আর সামনের দিকে গিয়ে অনেক দূরে কোথাও নিক্ষিপ্ত হচ্ছে । পিতা উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন পুত্রের এই কথায় । শিশুর মতন উচ্ছাসে বলেন, ‘তুমি পারবে, তুমিই পারবে, এই অগ্নিহোত্র যজ্ঞ ক্রিয়া সম্পন্ন করতে”। পিতা কেন বললেন এই কথা! পিতা আবারও বললেন, ‘পুত্র এই যজ্ঞের অগ্নি যখন প্রজ্বলিত হবে, তখন অতীত কে সে বহন করে নিয়ে আসবে। ভীষণ কঠিন সেই প্রক্রিয়া। কঠিনতর প্রক্রিয়া, যখন ভবিষ্যতের অন্ধকার গর্ভে এই অগ্নি প্রজ্বলিত হবে। সেই অন্ধকার গর্ভ  আলোকিত হবে। সেই অগ্নি প্রজ্বলিত থাকবে অবিকম্প, অবিচল। তুমি ঠিকই বলেছো পুত্র। আমার কণ্ঠে সেই অতীত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে আর সেই একই কণ্ঠ অনাগতকে আহবান করছে’।

ভয়ে ভয়ে পুত্র জিজ্ঞাসা করে পিতা কে, ‘পিতা এই অগ্নি প্রজ্বলনে আপনার শরীরের কোন ক্ষয় হবে না তো? পিতা বলেন ‘আমার ক্ষয় দিয়ে আমি অনাগতের জন্য যে অগ্নি প্রজ্বলন করে যাব, তুমি সেই ভার বহন করবে। তোমার হাতে দিয়ে যাব সেই অগ্নিহোত্রর যজ্ঞের অগ্নি । তুমি দেবে তোমার পুত্রর হাতে , সেই অগ্নি প্রজ্বলিত থাকবে, কোনওদিনও নির্বাপিত হবে না। 

আবারও দৃশ্যান্তর হচ্ছে।

অনেক বিষ ঢেলে, ক্লান্ত হয়ে নির্বিষ এখন অতিমারী।

অতিমারীর বিশল্যকরণী আবিষ্কৃত হয়েছে। আরও,আরও অতিমারী আসে যদি, তার সঙ্গেও লড়বে মানুষ। একদিকে  যুদ্ধের রণসজ্জা, মানুষ মারার লোভ, লাভ আর অন্যদিকে অতিমারীর হাত থেকে বাঁচার অস্ত্র। ধ্বংসকে এক হাতের মুঠোয় ধরে আরেক মুঠো আলগা করে সৃষ্টি করা! দুই হাতে কালের মন্দিরা তবে এইভাবেই বাজে! আর চলছে সেই মারার এবং বাঁচার প্রতিযোগিতা এক দেশের সাথে আরেক দেশের, এক মহাদেশের সাথে আরেক মহাদেশের। ওই তো দেখা যাছে এক রাষ্ট্র নায়ক তাঁর পারিষদদের নিয়ে বসে মন্ত্রণা করছেন, ‘যুদ্ধ বাধাও আর যুদ্ধ হলে কতজন মানুষ কি ভাবে মারা যাবে তার হিসেব করো আর এও হিসেব করতে ভুলোনা যে দুর্ভিক্ষ, বন্যা, ভুমিকম্প, অতিপ্লাবন, অতিমারী হলে কত মানুষকে বাঁচানো যাবে। তা না হলে আমি ক্ষমতায় থাকবো কি করে’? আর এক রাষ্ট্র প্রধান বলে্‌ন, “ও  যুদ্ধবাজ, ও ফন্দীবাজ। ওর পথে চলোনা তোমরা জগতবাসী। আমার পথে চলো। আমি তোমাদের সত্যের পথে, সাম্যের পথে নিয়ে যাবো”। 

সে দেখতে থাকে, সব পথ এসে মিলে গেল শেষে সেইখানে যেখানে মানুষ পরিত্রাণ পাবার জন্য ছটফট করছে। বেশি GDP?  এক রাষ্ট্র প্রধান বললেন একটা সংখ্যা।আর এক রাষ্ট্রপ্রধান বললেন ‘ও মিথ্যে বলছে । ওরটা এত, আমারটা তার থেকে বেশী’। সে দেখতে পাচ্ছে এবং দিব্যি বুঝতে পারছে, আসলে সবাই মিথ্যে বলছে। Happiness! হাসিমুখের বিজ্ঞাপন আর বিপণনের হুড়োহুড়ি? ছেলে ভুলিয়ে রাখা খেলনা দিয়ে? ‘রাষ্টৃপ্রধান- ক এবং খ, তোমরা বুঝতে পারো নি, ওই ছেলে কেন খেলনা ছুঁড়ে ফেলে দিচ্ছে? আমি তো দেখতে পাচ্ছি। আমি তো বুঝতে পারছি ও কেন খেলনা ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে। তাকিয়ে দেখো, জানালার বাইরে ফুটপাথে থাকা এক শিশু লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তোমার দেওয়া ওই খেলনার দিকে। ও এখনো বোঝেনি যে ওই খেলনা মিথ্যে। আমি ওকে বুঝিয়ে দেব। আমাকে বোঝাতেই হবে। আর এও বোঝোনি ওই লোভাতুর দৃষ্টি কি চরম অস্বস্তিতে দীর্ণ করে দিচ্ছে ঘরের ভিতরে থাকা ওই শিশুটিকে? না পাওয়ার বিপ্রতীপে থাকা, অনেক পাওয়ার ভার, যে ভার ছুঁড়ে ফেলে দিতে ইছে করে তার।

সে দেখতে থাকে মাস যায়, বছর যায়, যুগ যায়। আরও লোভ বাড়তে থাকে, আরও প্রসারিত হয় লোভের হাত। চাষের খেত ধ্বংস হয়, ধ্বংস হয় অরণ্য। নগর সভ্যতার আর অরণ্য সভ্যতার ব্যাবধান কমে আসে। লোভে পাওয়া ওই মানুষগুলো ভুলে যায় ঐ ব্যবধান ঘোচানো মানে, অরণ্যের দিকে আরও অগ্রসর হওয়া, প্রকৃতির গায়ে আরও ক্ষত জাগিয়ে তোলা। ওই মানুষগুলো যত অরণ্য সভ্যতাকে মেরে এগোতে থাকে, অরণ্য সভ্যতা প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে আসে মানুষের দিকে, আরো এগিয়ে আসে আর ভাইরাস এর থাবা যার চিকিৎসা মানুষের দুরতিক্রম্য। আরো সংক্রমণ, আরো মহামারি, আরো অতিমারী। 

উষ্ণতা তাকে যেরকম করে গ্রাস করতে আসছে, সেইরকমই সারা পৃথিবীকেও গ্রাস করতে আসছে।তার যেরকম শ্বাস রোধ; পৃথিবীরও শ্বাস ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে আসছে। হিমবাহ গলছে, বাড়ছে সমুদ্রস্তরের উচ্চতা। বাড়ছে বাষ্প, বাড়ছে দহন, বাড়ছে ধুলো; উফফ, ক্রমশ আরও দমবন্ধ হয়ে আসছে তার। ছট্ফট্ করছে একটু শ্বাস নেবার জন্য, একটু। তাহলে বেঁচে যেতে পারবে।মনে হয় তার শরীরটাই সঙ্কুচিত হতে হতে একটা ভাইরাস এ পরিণত হয়েছে। লোভীর মত খুজছে কার শরীরে বাসা বাঁধা যায়। তার তো খিদে বাড়িয়ে দিয়েছে মানুষ। তবে কি সে ধ্বংস করে দেবে সব কিছু ? ধ্বংস, আরও ধ্বংস! সৃষ্টি, স্থিতির পরই ধ্বংস। মানুষের এই সভ্যতায় কি ধ্বংসের বীজ নিহিত ছিল, সর্বনাশের বিষ নিহিত ছিল যা তলে তলে, নীল করে দিছিল সভ্যতাকে? এখনও সমরসজ্জা? এখনও রাষ্ট্র প্রধানদের ব্যর্থ চিৎকার? এখনও ক্ষমতার অশ্লীল উলম্ফন?

সে দেখছে এক চোখ ধাঁধানো উজ্জ্বলতা, যে উজ্জ্বলতা গুহার একদল মানুষকে বেঁধেছিল সভ্যতার ডোরে, যে মানুষ বুঝেছিল বাঁচতে গেলে, সমাজবদ্ধ হয়ে বাঁচতে হবে,একে অপরের পাশে দাঁড়াতে হবে, সেই মানুষ আজ একে অপরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। মারণাস্ত্র ছুটে আসছে এক দেশ থেকে আরেক দেশের দিকে। সমস্ত শক্তি পুঞ্জীভুত করা সেই উজ্জ্বলতা, সেই শক্তি অনুকণা হয়ে ভেঙ্গে পড়ছে। 

সে ওই ধ্বংসের অনুকণার মতনই এক ভাইরাসে পরিণত হয়েছে। সে মারবে, আরও অনেককে মারবে। আর তার মতন আরও অনেক ভাইরাস পিছনে সারি বেঁধে আসছে। তারা জানে যে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে যাওয়া এই মানুষের সভ্যতাকে আঘাত করতে অণুসময় লাগবে। ধ্বংসের বীজ নিহিত ছিলই, স্ফূরিত হছে, মুকুলিত হছে। কী শ্বাসরোধকারী, কী অমোঘভাবে এক বৃন্ত থেকে আর এক বৃন্তে মৃত্যুকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ধ্বংস হছে সভ্যতা, ধ্বংস হচ্ছে সব কিছু।

একদম অন্ধকার হয়ে গিয়ে এবারে চোখের পর্দায় ভেসে উঠছে এক উজ্বল আলো। আশ্চর্য তো! যুগান্ত ঘটে গেছে এরমধ্যে। যে ভূখণ্ডগুলি একে অন্যের থেকে সরে গিয়েছিল, তৈরি হয়েছিল এক দেশ থেকে আর এক দেশ, এক মহাদেশ থেকে আর এক মহাদেশ, তারা যেন অনাদিকালের এক  অমোঘ আকর্ষণে আবার একে অন্যের কাছে ফিরে আসছে, সমস্ত বাস্তব, সমস্ত সত্যকে ভূলুণ্ঠিত করে তারা আবার একে অন্যের কাছে ফিরে আসছে। জন্ম নিচ্ছে এক নতুন পৃথিবী। সৃষ্টি, স্থিতি, ধংস পেরিয়ে, যুগান্ত পেরিয়ে এক বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে আবার অঙ্কুরিত হছে সৃষ্টির বীজ।  আর যে মানুষেরা হাতে তুলে নিয়েছে এই বিনির্মাণের ভার, তারা উন্নুততর মানুষ। অনেক শতাব্দীর মনীষার ফল তাদের মস্তিষ্কে; তাদের বুদ্ধি শীর্ষতম চূড়াকে ছাড়িয়ে গেলেও, তারা বুঝেছে বুদ্ধি নয়, বোধ দিয়ে তারা পরিচালনা করবে তাদের নিজেকে। হ্যাঁ, তারা পরিচালনা করবে তাদের নিজেকে। কোন উদ্ধত, দম্ভতাড়িত রাষ্ট্রপ্রধান নয়, সমষ্টির মধ্যে থেকে উঠে আসছে জননেতা। তারা জানে যে সমাজবদ্ধতা কোন নির্দিষ্ট নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হয় না। পরিচালিত হয়, ব্যাক্তিগত এবং সমষ্টিগত বোধ দ্বারা, একের বোধ অন্যের মধ্যে সঞ্চারিত করা, একের বোধে সাড়া দেয়া অন্যজনের। আর সৃষ্টির নেশায় মেতে রয়েছে তারা। উৎপাদনের সমবন্টন ব্যাবস্থার মধ্যে দিয়ে তারা যেমন একটি ছন্দ আনতে পেরেছে তাদের জীবনে, সেই ছন্দেরই অভিঘাতে সৃষ্টি হছে নান্দনিক শিল্প। কারিগরও শিল্পী আর নন্দনচর্চা; মানুষের নিজস্ব গণ্ডীকে অতিক্রম করে যাবার জন্য যে মানুষেরা রয়েছেন তাঁরাও শিল্পী; বিজ্ঞানী আজ শিল্পী, কারিগর আজ শিল্পী, কবি আজ শিল্পী, ক্রীড়াবিদ আজ শিল্পী। শিল্প সৃষ্টি হয়ে চলেছে নিরন্তর। সংবেদনশীল, সহমরমী, সমমনস্ক মানুষ। তারা শিল্পী বলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে পরিবেশ, রোধ করছে দূষণ। তাদের ইছার আকার-প্রকারই গেছে বদলে। সৃষ্টির তাগিদ আসছে যে ইচ্ছে থেকে, সেই ইচ্ছে অপর প্রান্তে গিয়ে গিয়ে শিখিয়ে দিছে তাদের নিয়ন্ত্রণ; কোথাও যাতে উপছে বেশি না হয়ে যায়, মারবার, মরবার উপাদান নয়। পৃথিবীর সবাইয়ের, সব কিছুর, সব শক্তি যাতে বাঁচার জন্য সমান ভাগ পায় তাই নিয়ন্ত্রণ করছে ওই ইছে; অনেক শতাব্দীর,  অনেক মনীষার একত্রিত ফসল।

ঘুম ভাঙ্গে তার, কত যুগ ঘুমিয়েছে, কত কত যুগ! ঘুম থেকে উঠে হাঁটতে থাকে এই নতুন পৃথিবীর বুক দিয়ে। সব কিছু বদলে গেছে, কিন্তু যেন খুব চেনা, সব কিছু। এইরকমটাই হওয়ার ছিল। অনেক শতাব্দীর মনীষার ফসল এইরকমভাবেই উন্মোচিত হবার ছিল। তার ঘুম ভাঙ্গা পায়ে সে এগোতে থাকে। অনেক শতাব্দী পার করে সে এগোতে থাকে। উজ্জ্বল আলো, প্রাণ ভরা নিঃশ্বাস; আঃ! এগোতে থাকে । কোন বাঁক নেই, কোন অলিগলি নেই, কোন চোরাপথ নেই । পুরো পৃথিবীর বুকে যেন সে এইরকমভাবেই সমন্তরাল রেখায় এগোতে পারবে। এগোতে থাকে, সে এগোতে থাকে।   

এক-আকাশ ভরা আলোর মাঝে দেখা যায় এক নবীন কিশোর তার দিকে এগিয়ে আসছে।, তার হাতে, ও কি ও? প্রজ্বলিত অগ্নিকুন্ড; অগ্নিহোত্র । সেই অগ্নিহোত্রী কিশোর, আদিম মানবের গুহাকন্দরের আগুন নিয়ে, যজ্ঞের অবিকম্প,অনির্বাণ অগ্নিশিখা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে তাকে আলিঙ্গন করতে! তার অতীত, তার ভবিষ্যৎ ঐ আগুনের নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গে তার দিকে এগিয়ে আসছে, আর সেই নবীন কিশোরের পিছনে আনেক মানুষ, তারই দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে এগিয়ে আসছে! অতীত, অনাগতকে নিয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে, এগিয়ে আসছে!

বুকের কাছ থেকে পাশে পড়ে যাওয়া খবরের কাগজে চোখ পড়ে যায় তার; সব সংখ্যা মুছে গিয়েছে, মুছে গিয়েছে সব মৃত্যুর পরিসংখ্যান। অক্ষর,শব্দ, সংখ্যা কিছুই নেই। শুধু রং, লাফাচ্ছে নাচছে,হাসছে, সেই রঙ। অতি যত্নে, ললিত আদরে সে সেই কাগজ তুলে নেয় বুকের উপরে। 

অভিজিৎ লাল রায় কথাবৃক্ষের একজন নিয়মিত পাঠক এবং লেখক, এই ভাবে যাঁরা কথাবৃক্ষের পাশে রয়েছেন তাঁদের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা অপরিসীম। এই কাজে বাংলা হরফে পুরো লেখাটিকে করার ব্যাপারে লেখক কে সাহায্য করেছেন শ্রীমতী নন্দিতা চৌধুরী এবং শ্রী অসীম চৌধুরী।

2 Comments Add yours

  1. দীপঙ্কর চৌধুরী says:

    অসাধারণ একটি লেখা। মুগ্ধ হলাম পড়ে।

    Like

  2. এক কথায় অসাধারণ, অসামান্য। কঠিন বাস্তব, জীবন দর্শন ও উপলব্ধি অনুভব করলাম। এই সময়ের জন্য ভীষন প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। মন ছুঁয়ে গেল একেবারে। লেখকের প্রতি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম ও ভালোবাসা রইল।

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.