সাদা অর্কিড আর রজনীগন্ধার তোড়ায় ভরা নান্দনিক বসার ঘরে কলাকুশলীরা বসে আছেন, একে একে মিডিয়া, নেতা মন্ত্রীরা আসার খবর পাওয়া যাচ্ছে। বিশ্ববরেণ্য পরিচালক, যিনি কলকাতা শহরকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করেছেন, প্রয়াত।
আবহমান ছবির শুরু। এবং অদ্ভুতভাবে, ২০১৩ সালের ৩০ শে মে, ইন্দ্রাণী পার্কের ‘তাসের ঘর’-এর সকালটাও কাকতলীয় ভাবে এক হয়ে গেল!
“সত্যজিৎ রায় যদি ছবি না করতেন, তাহলে হয়তো আমারও ছবি করতে আসা হত না” এমন কথা অনেক সাক্ষাৎকার এ বলেছেন পরিচালক-অভিনেতা ঋতুপর্ণ ঘোষ। “আমার প্রথম ছবি সেন্সর হওয়ার সাত দিন আগে সত্যজিৎ রায় আমাদের ছেড়ে চলে যান ” হয়ত এই আক্ষেপ থেকে কোনো দিন বেরোতে পারেননি ঋতুপর্ণ।

মানুষের মনের অনেক ভিতরের টানাপোড়েন কে সেলুলয়েডে সাবলীল করেছেন বারবার। কিন্তু প্রায় সব ছবিতে যেটা লক্ষণীয়, সেটা হল সন্তানের সাথে বাবা-মা’র সম্পর্ক। সেলিব্রিটি মায়ের সাথে মেয়ের অভিমানের সংলাপ, অভিনেত্রী মেয়ের সঙ্গে বৃদ্ধ বাবার মার সম্পর্ক, একই পুরুষের প্রতি মা ও মেয়ের আকর্ষণ, রূপান্তরকামী সন্তানের সাথে তার বাবা মায়ের অভিঘাত, পরিচালক বাবা তাঁর মৃত্যশয্যায় নিজের আত্মজ’র নাম নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে – ঋতুপর্ণ ঘোষের অন্যতম USP হয়ে ওঠে সন্তান ও পিতামাতার এই শাশ্বত পারস্পরিক নির্ভরতা, যেখানে রূপান্তরকামী সন্তান মায়ের সাথে কোনোকিছুই চিরস্থায়ী নয় এই নিয়ে তর্ক করে, তখন মা তাকে বোঝায়, ” তাহলে বল, তুমি যে আমাদের সন্তান সেটাও permament নয়, আমরা যে তোমার বাবা মা, সেটাও permanent নয়, সেটাও change হতে পারে ” ।

শুধু সংলাপের অভিঘাত আর মুখের ওপর তেরচা ভাবে এসে পড়া আলোর screen satisfaction নয়, এই সংলাপগুলোর মধ্যে বাবা মা ও সন্তানের চিরকালীন একাত্মবোধ আমাদের বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসা বাঙালি মধ্যবিত্ত ভাবাবেগে চরম দ্যোতনার সৃষ্টি করে। আমাদের ভাবায়। মমতা শংকর উনিশে এপ্রিল দেখে এসে তাঁর ছোট ছেলেকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিলেন। বা, কে জানে, কোনো দূর প্রবাসে বসে থাকা সন্তান, চিত্রাঙ্গদা দেখার পর, তার মায়ের শাড়ি বেছে দেওয়ার বা টিপ টা ঠিক করে দেওয়ার মধুর স্মৃতি মনে করে, আদরের উপবাসে আরো ব্যাকুল হয়েছিল কিনা।
এই প্রশ্নগুলোর জবাব দেবে যে, সেই ঋতু আর নেই। তাসের ঘরে’র বসার ঘরে কোনো অভিনেতা আজ সাদা ফুল নিয়ে যাবেন না হয়তো এই লকডাউনে এ।
শুধু থেকে যাবে কাজগুলো।
জানলা দিয়ের তেরচা আলো এসে পড়বে মায়ের মুখে, আর আধভেজা চোখে মেয়েকে কবিতা পড়ে শোনাবেন তিনি,
আমার দুজন একটি গাঁয়ে থাকি, সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ।

৩০শে মে, একটি চিরকালীন মন খারাপের দিন।
প্রীতম চৌধুরী : অর্থনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করে বর্তমানে পেশায় তথ্য ও প্রযুক্তি কর্মী। সাহিত্যপ্রেমী ও ভ্রমণপিপাসু। সংগীত শিক্ষার্থী এবং নিয়মিত সংগীত চর্চায় রত। গুণী এসরাজবাদক ও যন্ত্রশিল্পে অনুরাগী। কথাবৃক্ষের সহ প্রতিষ্ঠাতা ও বর্তমানে সহ সম্পাদক।