-আসব বড়দা ? বলে দরজায় হালকা নক করে বলল ঊর্মিলা, ঊর্মিলা মানে এই দোকানের কেয়ারটেকার কাম ম্যানেজার, দোকান বলতে “আদি রাজনন্দিনী বস্ত্রালয়”, বড়বাজার এলাকার এক শতাব্দীরও প্রাচীন এই দোকান, আজ যদিও দোকান না বলে রীতিমত একটা মল’ই বলা যায়, তিন তলা দোকান, পুরোটাই শাড়ি আর মেয়েদের পোশাক।
-আরে আয় আয়, বললেন এই দোকানের বর্তমান মালিক দেবব্রত রায়, এই দোকান এদেরই চার পুরুষের ব্যবসা!
-বলছিলাম বড়দা সামনের মাসে একটু ছুটি পেলে ভালো হতো গো, মেয়েটার সামনে মাধ্যামিক, একটুও নজর দিতে পারছি না, তাই বলছিলাম যে দেখো না যদি একটু ম্যানেজ করতে পারো।
-আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে, নে না ছুটি, অসুবিধে কি? তবে বেশি দেরি করিস না যেন, সামনের মাসে কিন্তু বড় কাজ আছে, ভুলিস না যেন, হাসতে হাসতেই বললেন দেবব্রত বাবু।
-না না বড়দা সেটা কি হয় নাকি ?
-ঠিক আছে, আজকের কাজটুকু করে পুলক’কে কাজ বুঝিয়ে দে, বাকিটা দেখছি কি করা যায়, চলে আসিস কিন্তু ঠিক সময়ে।
-আচ্ছা বড়দা সে তুমি চিন্তা কর না, ওসব আমি সামলে নেব ঠিক, আমি তাইলে আসি এখন বড়দা ?
-হমম আয়।
আস্তে করে দরজা’টা টেনে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে ঊর্মিলা, সত্যি বড়দা খুব ভালো মানুষ, কম দিন তো হল না ওর এদের সাথে এই দোকানের ভার সামলাচ্ছে, বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে বাগবাজারের শরিকি বাড়ি ছেড়ে এই দোকানের উপরের ফ্লাটেই উঠে এসেছিল ওরা তাও প্রায় কুড়ি বছর বা তারও বেশিই হবে হয়তো, তবে পরিচয় তো আরও আগের!
সেই মায়ের সাথে আসত এই দোকানে তখন ওর কত আর বয়েস, পনেরো-ষোল হবে বা তারচেয়েও ছোটই ছিল মনে হয়, সেই থেকে দোকানে এসে বসে থাকতো, দেখত মা কাজ করছে, কাজ বলতে সকালে উঠে দোকান পরিস্কার হয়েছে কিনা দেখা, স্টক মিলিয়ে গুদামে রাখা, শহরের বাইরে মাল পৌঁছে দেওয়া, নতুন মাল এসছে কিনা দেখা, সব ছোটখাটো হিসেবপত্র মিলিয়ে দেখা, খাতা-বিলবই গুছিয়ে রাখা, অন্য কর্মচারীদের বেতন, তাদের থাকা খাওয়া সবকিছুর তদারকি করা, একা হাতে সবকিছু সামলানোই যেন ছিল তার কাজ, তখনকার মালিক মনীন্দ্রমামা না এলে ওর মা ঊষা দেবী’ই যেন মালকিন এই দোকানের।
একদিন মা কে জিজ্ঞেস’ই করে বসেছিল ঊর্মিল
– আচ্ছা মা, আমারা কি এদের কোন আত্মীয় হই?
মেয়ের এই প্রশ্ন শুনে ঊষাদেবী হেসে বলেছিলেন
-কেন রে? হঠাৎ এই প্রশ্ন করছিস?
-এই যে মণিমামা আমাদের যে এত বিশ্বাস করে!?
মা ঊষা দেবী বলেছিল – সে আনেক কথা রে, অনেক লম্বা গল্প, আর একটু বড় হ বুঝবি, আমার পরে তো তোকেই সব দেখতে হবে, তখন সব জানতে পারবি।
আজ ঊষা দেবীও মারা গেছেন বহুদিন হল, সেই থেকেই ঊর্মিলাই এই দোকানের সব কিছুর খেয়াল রাখে, মায়ের বলা সেই গল্পটা আজও যেন চোখে চোখে ভাসে, তবে আজকাল খুব চিন্তা হয় ওর কাজেও সেভাবে আর মন নেই যেন, বছরের এই সময়টা এলেই খুব ভয় হয়, ওর পরে জিনিয়া কি পারবে সব সামলাতে? সামনে ওর মাধ্যমিক, পরীক্ষা শেষ হলে কি একবার সব বলবে ওকে নাকি ওর স্বামী পুলকের সাথে একবার আলোচনা করবে এটা নিয়ে? ধুস আর ভাবতে পারছে না, যা হবে দেখা যাবে’খন, সামনে জিনিয়ার মাধ্যমিকটা তো সামলানো যাক।
____
আজ পরীক্ষা শেষ হল জিনিয়ার, ঝড় বয়ে গেল যেন এই কদিন, হাফ ছেড়ে আজ বাঁচল যেন ঊর্মিলা। অনেকদিন ধরে ওদের বায়না মায়ের হাতে বিরিয়ানি খাবে, করেওছে আজ সবার জন্যে, দোকানের বাকি সবাইকেও খাইয়েছে, দেবুদা বড়বৌদি আর ছোড়দাও এসছিল ছেলে মেয়েদের নিয়ে, খুব মজা হয়েছে আজ, জিনিয়া আর রাহুল একদম থালা পরিষ্কার করে খেয়েছে, দেখলেও ভাল লাগে।
বিকালের মধ্যে সব কাজ মিটিয়ে ঊর্মিলা গেল দোকানের ওই বিশেষ ঘরটায়, এখানে আসার অনুমতি আছে শুধু এই দোকানের মালিক রায় পরিবারের লোকেদের আর ওদের মানে ওর আর পুলকের, না আর কেউ আসে না এই ঘরে, দোকানের বাকিরা জানলেও আজ অব্দি কেউ ঢোকেনি এই ঘরটায়, একবার ঊর্মিলা শুনেছিল ওর মা’য়ের কাছে, বিনোদ বলে এক কর্মচারী নাকি বাকিদের সাথে বাজি ধরে ওই ঘরে ঢুকেছিল কিন্তু পরের দিন থেকে তার আর কোন খোঁজ মেলেনি, সত্যি মিথ্যে জানা নেই তবে এই কথা’টা সবাই মেনে চলে, রাহুল আর জিনিয়াও জিজ্ঞেস করেছে ওকে বহুবার,ও হেসেই উড়িয়ে দেয় সবসময়, এই ঘর থেকে আজ কিছু জিনিস বের করে পরিষ্কার করতে হবে সামনের সপ্তাহের জন্য।
রাতে সব কাজ মিটিয়ে শুতে যাবে হঠাৎ জিনিয়ার গলা
– ও মা তুমি আজ আবার ওই ঘর’টায় গেছিলে ? কি আছে গো মা ওই ঘরটায়, বল না গো মা, ও মা বলো না, রোজ দেখি তুমি যাও আর ওই ঘর থেকে নতুন নতুন শাড়ি, সালোয়ার পরিয়ে আনো ওই সুন্দর ম্যানিকিনটাকে, ওটা ওর স্পেশাল ঘর ?
এর কি যে জবাব দেবে বুঝে পায়না ঊর্মিলা, শুধু জিনিয়ার গাল দুটো আলতো করে টিপে দিয়ে বলে
– পাগলী মেয়ে আমার, সব জানবি দাঁড়া না।
– না না আজই বলো, সেই কবে থেকে জানতে চাইছি, তুমি বা বাবা কিচ্ছু বলো না আমাদেরকে, ও মা বল না……
একপ্রকার বায়না করাই শুরু করলো যেন জিনিয়া।
– ঠিক আছে মা সব বলব তোকে, তবে আর সাতদিন অপেক্ষা কর, সব জানতে পারবি।
– কেন মা আজকে কি হয়েছে? আজকেই বলো না মা।
– না রে সোনা সবের তো একটা সময় আছে, ওইদিন বলবো সব প্রমিশ!
– ঠিক তো?
– হমম ঠিক পাক্কা প্রমিস!
এইভাবে প্রায় ছয়দিন কেটেও গেল, পরের দিন জিনিয়া গেছিল কোন একটা বিষয়ের একজন টিচারের কাছে, আসতে আসতে বেশ সন্ধেই হয়ে গেল, তাই ওকে আর কিছু বলেনি ঊর্মিলা, কিন্তু ও বাবা, রাতের বেলা ঠিক মেয়ে হাজির হয়েছে মা’য়ের কাছে
-কি গো মা, তুমি তো ভুলেই গেলে
-না রে মা কিছু ভুলি নি আয়, এখানে মাথা রেখে শুয়ে পড় বলছি সব, তবে কথা দে ভয় পাবি না
-কেন ভয়ের গল্প নাকি মা?
-না না তবে প্রথমবার শুনে আমারও একটু ভয় লেগেছিল আর কি, তবে এখন আর লাগে না!
-না না ভয় পাবো বা তুমি বলো তো মা, মায়ের গা ঘেঁষে এসে একদম জড়িয়ে ধরে জিনিয়া।
আচ্ছা শোন তাইলে, অনেকদিন আগের কথা, তখন আমাদের এই কোলকাতা ছিল ব্রিটিশ’দের অধীনে, সালটা হবে ১৯০৫, সারা কলকাতা জুড়ে তখন গোলমাল, কারণ কি? না বড়লাট কার্জন বলেছেন বাংলা’কে ভাগ করা হবে, এই শুনে তো গোটা কলকাতা তখন রাগে ফুঁসছে……
মা কে বাধা দিয়ে জিনিয়া বলল – এই গল্প তো ইতিহাস বইতেই পড়েছি মা,
– আহা গল্প শোনার সময় মাঝখানে কথা বলতে নেই, মেয়ের উপর নকল রাগ দেখিয়ে বলল ঊর্মিলা।
– আচ্ছা আচ্ছা সরি মা, আর করব না, তুমি বলো, এই আমি চুপ করে শুলাম।
মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঊর্মিলা বলতে থাকল
– শোন তাইলে……সেইসময় শ্যামবাজার এলাকার রায়বাড়ীতে জন্ম নিল একটা ফুটফুটে মেয়ে, এই অনেকটা তোর মত!
-তারপর ?
– বলছি তো শোন না মন দিয়ে,
ঊর্মিলা বলে চললেন, এদিকে জিনিয়া যে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে খেয়ালই করেন নি, তারপর মেয়েকে দেখে আস্তে করে বালিশে শুইয়ে দিলেন।
_____
জিনিয়া হঠাৎ শুনল ওর মা ওকে ডাকছে
– কি রে গল্প শুনবি বললি যে, এখন ঘুম দিলে হবে? চল চল বেড়তে হবে তো।
– কোথায় ?
– আরে চল না……
তারপর মায়ের হাত ধরে দোকানের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে লাগলো জিনিয়া, কিন্তু এ কি!? এ তো কাঠের সিঁড়ি! দোকানের নীচের তলায় এসে আরো চমকে গেল যেন, সব আসবাব’ই কেমন যেন, সুন্দর কাঠ দিয়ে বানানো পুরনো দিনের শোকেস, যদিও এই দোকানটাও প্রায় একশ বছরেরও বেশী পুরোনো, তবুও দোকান’টা বহুবার নতুন করে সাজানো হয়েছে, এই তো কিছুদিন আগেও রঙ হলো, আসবাব বদল হলো, দোকানের কর্মচারীরাও সব কেমন যেন অচেনা অচেনা, এখনকার লোকগুলি সব গেল কোথায়!?
ওর মনের কথা বুঝতে পেরেই মনে হয় ওর মা বলল
– কি রে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি এত দেখছিস?
কিছুটা এগিয়েই দোকানের মূল ফটকটা খুলতেই যেন আটকে গেল জিনিয়া, এ আবার কোথায় এল ও !? রাস্তার দুধারে গ্যাসবাতি জ্বলছে, প্রায় অন্ধকার একটা রাস্তা, ওপাড়ের দোকান গুলিও যেন সব কেমন পুরনো পুরনো লাগছে, কিছু লোক বেরোচ্ছে, ঢুকছে ওদের দোকানেও, তাদের সবারই পোশাক আসাক কেমন যেন অদ্ভুত!
কোথা থেকে একটা আরদালির মত লোক এসে বলল
– গাড়ি তৈয়ার হ্যায়, আপ লোক জলদি আইয়ে মাইজি।
দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এ আবার কেমন গাড়ি!? এখনকার দিনে এই গাড়ি কেউ চড়ে নাকি!?
ওর দেরী হচ্ছে দেখে ওর মা ওকে একটা ঠেলা দিয়ে বলল
– কি রে জিনিয়া, তাড়াতাড়ি আয়!
ওরা গাড়িতে উঠতেই আরদালি মত লোকটা গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিল, না, এই রাস্তা দিয়ে জিনিয়া কোনদিন এসেছে বলে তো মনে পড়ল না ওর, ওটা কি গাড়ি গেল? ঘোড়ার গাড়ি না !? আর এটা আবার কোন রাস্তাটা? বাড়িগুলি হালকা হালকা চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু রাস্তাটা এরম হলো কি করে !? এত ফাঁকা ফাঁকা রাস্তা, খালি বারবার জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখতে লাগলো জিনিয়া, পূর্ণিমার আলোতে কি অদ্ভুত লাগছে রাস্তাটাকে, আওয়াজ বলতে শুধু ওদের গাড়ীটার আর কয়েকটা ঘোড়ার গাড়ি চলে যাওয়ার টগবগ টগবগ শব্দ!
চারিদিক কত শান্ত, ঘড়িতে কটা বাজে এখন বোঝার উপায় নেই, রাস্তায় লোক বলতে কিছু সাধারন লোক আর পুলিশ সেই একই সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ হেঁটে কেউ বা আবার ঘোড়ায় চড়ে, এই বাড়িটাও তো ও চেনে, কতবার এসেছে এখানে, কি যেন নাম………জায়গাটার? হমম……মনে পড়েছে……লালবাজার, বাবা বলেছিল এটা কলকাতা পুলিশের হেড কোয়ার্টার, কিন্তু পুলিশ গুলিকে আরো কাছ থেকে দেখে যেন চমকে উঠলো, আরে এরা তো সবাই ইংরেজ, তাইলে কি !? না..না এরম আবার হয় নাকি !? নিজের গায়ে নিজেই চিমটি কেটে দেখল, হমম বেশ জোরেই লাগলো তো, মা ওর দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসছে কেন!? দুস ওর যেন একটু ভয় লাগছে এবার, ওদের গাড়িটা ততক্ষনে চলে এসেছে একটা পেল্লায় বাড়ির সামনে, ওটা পেরোতে পেরোতে মা ওই ড্রাইভার লোকটাকে জিগ্যেস করলো
– আচ্ছা মাধব তোমার ছেলে এখানে ভর্তি আছে না? কেমন আছে এখন?
– এখন অনেক ভালো আছে মাইজি!
তাইলে কি এটা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ!? এরপরেই কি তাইলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়……প্রেসিডেন্সি..?
এই রাস্তাটা কি তাইলে কলেজ স্ট্রিট?
না..না আর ভাবা যাচ্ছে না, মা যে আজ কি একটা গল্প বলল সেই থেকে সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে, দুস!
এই ভেবে মায়ের কাঁধে মাথা রেখে আবার শুয়ে পড়ল জিনিয়া, মা বলল
– কি রে ঘুমালে হবে!? পুরো গল্পটা তো শোন!
-দুস মা, আমি ঘুমালাম, সারাদিন রেস্ট হয়নি, তুমি জাগিয়ে দিও।
______
– কি রে জিনিয়া ওঠে পর, আমরা চলে এসেছি
চোখ কচলাতে কচলাতে উঠল জিনিয়া
– আয় রে আমরা চলে এসেছি তো।
– কোথায় মা?
– নেমে আয় না সব দেখতে পাবি, ওর মা গাড়ি থেকে নেমে গিয়ে ওকে নেমে আসার জন্যে ডাকছে।
– হাম মাইজি গাড়ি থোড়া উধার লাগা রাহা হু, আপলোগ চলে আইয়ে গা, গাড়ির ওই ড্রাইভারদাদাটা বলে উঠল।
– হমম ঠিক আছে মাধব, তুমি যাও আমরা আসছি।
গাড়ি থেকে নেমেই তাক লেগে গেল জিনিয়ার, কি সুন্দর বাড়িটা, বাড়ি তো না এ তো রাজপ্রাসাদ, কি সুন্দর করে সাজানো, দেখলেই মনে হয় কোন অনুষ্ঠান আছে আজ এদের বাড়িতে, কত লোক, একদিকে রান্না হচ্ছে বিশাল বড় বড় কড়াইয়ে, একদিকে বড় করে চাঁদোয়া টানানো, সেখানে একদল বাচ্চা কাচ্চা খেলে বেড়াচ্ছে, কত আলো চারিদিকে, বাড়িটাও কি একটু চেনা চেনা লাগছে!?
– কি রে কি এত দেখছিস অতো ড্যাবড্যাব করে, চল আয় উপরে যাবি, বলেই মা হাত ধরে নিয়ে যেতে লাগলো জিনিয়াকে, সত্যি তো এই সিঁড়িটা ওর চেনা চেনা লাগছে, ছোটবেলায় তো এসেছে ও অনেকবার, এই সিঁড়ি, এই ব্যালকনি, আরে হ্যা মনে পড়েছে……এটা তো রায়মামাদের বাড়ি, হ্যা সব মনে পড়েছে, ওই তো এই বারান্দাটা পেরিয়ে ডানদিকে গেলেই তো দেবুমামার ঘর, পাশেরটা শিবুমামার, মা’য়ের হাত ছেড়ে একটা দৌড় লাগাতে গেল জিনিয়া।
-আরে আরে কোথায় যাচ্ছিস? দাঁড়া রে, আমি নিয়ে যাচ্ছি তো!
মা তারপর নিয়ে গেল উত্তর-পূর্ব কোনের ঘরটায়, কত মহিলা আর বাচ্চা মেয়ে ঘরটায়, সবাই একজনকে সাজাচ্ছে, কি সুন্দর একটা শাড়ি পড়ানো হয়েছে, এর মনে হয় বিয়ে আজ, কি অপূর্ব বেনারসিটা, একটা ঘোমটা টানা মুখটায়, তার পাশে দাঁড়ানো প্রায় সমবয়সী একজন মেয়ে, সে নববধূকে কানে কানে কি যেন বলল, একবার চমকে গিয়ে তাকাল মেয়েটি।
পাশে দাঁড়ানো মেয়েটি যেন ওদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো একবার, ওর মা ও হাসলো কি !? এরা কি তাইলে চেনে দুজন দুজনকে!? জিনিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল ওই মেয়েটার দিকে, মুখটা কোথায় যেন দেখেছে ও!
হঠাৎ পাশে দাঁড়ানো মেয়েটা ঘরের বাকিদেরকে বলে উঠল
– আপনারা সবাই আসুন তো এবার, বাচ্চারাও বেরিয়ে যা তোরা, এখন অনেক কাজ আমাদের।
– কি কাজ রে? বলে উঠল ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা ওদেরই বয়সি মেয়ে।
– যা যা বেড়িয়ে যা তোরা, নীচের ঘরের কাজ দেখ গিয়ে যা।
-আচ্ছা আচ্ছা যাই যাই, তোরা দুই সখীতে গল্প কর, হ্যা রে তোরা আয় রে লতা, ওদের থাকতে দে।
এই বলে হাসাহাসি করতে করতে বেরিয়ে গেল সবাই, জিনিয়া রা কিন্তু গেল না, সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর ওই মেয়েটা গিয়ে দরজায় ছিটকিনি আটকে দিলো, জিনিয়া দেখছে সব, মনে হচ্ছে যেন সিনেমা চলছে একটা ওর সামনে, ওই মেয়েটা, একবার জানলার খড়খড়ি তুলে বাইরে দেখল, আর একবার দরজা খুলে বাইরেটা দেখে নিলো, কিছু কি প্ল্যান করছে ওরা? তাই তো মনে হচ্ছে যেন দেখে, একটুপর আবার ওই মেয়েটা এসে নববধূর কানে কানে কি যেন বলল, দুজনেই প্রায় হন্তদন্ত হয়ে ঘরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল, জিনিয়া পিছু নিতে গেল, দেখল দুজন তো ছাদের সিঁড়ি ধরল।
ওর মা এসে কানে কানে বলল- চল আমাদের ও বেরোতে হবে!
– কোথায় মা?
– আরে আয় না দেখবি সব।
বলে ওর হাত ধরে প্রায় একটা দৌড় লাগলো ওর মা, সিঁড়ি পেরিয়ে, লোকজন এড়িয়ে, চাঁদোয়া পেরিয়ে, মূল সিংহদ্বার খুলে ওরা এসে দাঁড়ালো বাড়ির পূর্ব দিকের কোনার পাঁচিল ঘেঁষে, ওখানে দাঁড়িয়ে ছিল ওদের সেই গাড়িটা, পিছনের দরজাটা খোলা, গাড়িটা মনে হয় স্টার্ট করাই আছে, আওয়াজ আসছে একটা, ওর মা বাড়িটার ছাদের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলল
– ওই দেখ জিনিয়া
জিনিয়া দেখতে পেল চাদর মুড়ি দিয়ে দুজন যেন দড়ি বেয়ে নামছে
– ওরা কারা মা?
– ওঠ গাড়িতে সব বলবো
দুটো ছায়ামূর্তিই এসে গাড়িতে উঠল, একজন সামনের সিটে, একজন পেছনের সিটে, ওদের পাশের সিটটায়, আরে এ তো সেই মেয়েটা ! তাহলে সামনে গিয়ে বসল সে কে !?
সামনের সিট থেকে একটা নারীকণ্ঠ ভেসে এলো
– মাধব চলো গঙ্গাজি’কে ঘাট।
– জি ছোটে মাইজি, চলিয়ে সব ইন্তেজাম হো গায়া উধার।
_____
গাড়ি এসে দাঁড়ালো গঙ্গার ঘাটে, কোন গঙ্গার ঘাট এটা !? না দেখে বুঝতে পারলো না জিনিয়া, চারদিক অন্ধকার, আলো বলতে চাঁদের আলো আর ঘাটে বাঁধা নৌকার আলোগুলি আর দূরে ঐগুলি কি জ্বলছে? তাইলে কি ওটা কোনো শ্মশান!?
গাড়ি থেকে নেমে গেল তিনজনই, নারীমূর্তি দুটো গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো একটু তফাতে, ওদের দাঁড় করিয়ে রেখে মাধব বলে লোকটা যেন একটু এগিয়ে গেল ঘাটটার দিকে, কিছুক্ষন পর ফিরে এল আরো তিনজনকে নিয়ে, জিনিয়ার খুব ইচ্ছে করছিল ওদের খুব কাছ থেকে দেখতে
– যাবো মা, নেমে দেখবো একবার!?
ওর মা একটু হেসে বলল
– যা তবে বেশি কাছে যাস না, ওই যে গাছটা দেখছিস ওটার আড়াল থেকে দেখ, সব পরিষ্কার দেখতে আর শুনতে পারবি।
জিনিয়া দেখলো জোৎস্নায় দাঁড়িয়ে আছে পাঁচটি ছায়ামূর্তি আর মাধব বলে লোকটার চোখে যেন সতর্ক দৃষ্টি চারদিক সে দেখছে ঘুরে ঘুরে, কিছু কথা ভেসে এল জিনিয়ার কানে
– বন্দেমাতরম কমরেড, কি খবর?
একটা পুরুষকন্ঠ বলে উঠলো
– খবর ভালো নয়, নরেন ধরা পড়েছে, এই টেগার্টটাকে শাস্তি দিতেই হবে কমরেড।
– সুভাষ দার সাথে কথা হল?
অপর পুরুষকন্ঠ শোনা গেল
– হমম কাল সকালেই দেখা হয়েছিল, সুভাষদা মেয়র হলে আমাদের পাশে দাঁড়ানোর একটা লোক পাবো আমরা।
– হমম মাখন তুমি ঠিক বলেছ, বাইরে থেকে আমরা কাজ করব আর সুভাষ’দা ভিতর থেকে লড়বেন এর চেয়ে ভাল কিছু হয়না,
– আর দিল্লি লাহোরের কোন খবর পেলে!? জানতে চাইলো সেই নারীকণ্ঠ।
– যতীন’দার চলে যাওয়ার পরে সবাই এখন একটু শান্ত হয়ে গেছে কমরেড!
সেই নারীকন্ঠ বলে উঠল – তা বললে হবে না ভাই’রা, যতীনদার মৃত্যূ এভাবে বৃথা হতে দেওয়া যাবে না, সংগঠন কে গোপনে কাজ করে যেতে হবে, ঢাকা, কুমিল্লা আর চট্টগ্রামকেও সাহায্য করতে হবে আমাদের, ওদের অস্ত্র আর টাকা পাঠাতে হবে, আমি সামান্য ব্যবস্থা করেছি কমরেড, দেখ এগুলি একটু পৌঁছে দিও ওদের, বলে পাশে দাঁড়ানো সেই মেয়েটার দিকে ইশারা করলেন, ওই মেয়েটা একটা পুঁটলি এগিয়ে দিতে গেল, কিছু হয়তো বলতে শুরু করেছিলেন, হঠাৎ একটা গগনবিদারী আওয়াজে ঘাটের সমস্ত নিস্তব্ধতা খানখান হয়ে গেল, চমকে উঠল সব কটা ছায়ামূর্তি, দূর থেকে কার একটা চিৎকার ভেসে এলো
– মাইজি আপলোগ ভাগ জাইয়ে, পুলিস আহ রাহা হ্যায়!
তারপর আর একটা গুলির আওয়াজ, চমকে উঠল জিনিয়া, ওরই পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়ার সময় মাধব বলে লোকটা গুলি খেয়ে আছড়ে পড়ল মাটিতে, শুধু একটাই আওয়াজ শুনতে পেল
– বন্দেমাতর…পুরো কথাটাও শেষ হলো না, একজন ইংরেজ সিপাই এসে মাথা লক্ষ করে আর একবার গুলি ছুঁড়ল, সব শেষ….
জিনিয়া যেন দর্শক হয়ে দেখছে সব, ওর মা হাত নেড়ে ডাকছে ওকে গাড়িতে আসার জন্যে, না ও আর এগোতে পারছে না, কেও যেন ওকে কোনো মন্ত্রবলে পাথর করে দিয়েছে, ওর নাকে ভেসে আসছে তীব্র বারুদ পোড়া গন্ধ, ওর পাশ দিয়ে ছুটে গেল কম করে দশজন সিপাই,তাদের পিছনে ঘোড়ায় চড়ে আসছেন একজন, এদিকে সমস্ত ছায়ামূর্তি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল নিমিষের মধ্যে,
ঘোড়ায় চড়া সাহেবটা বলে উঠল
– সারেন্ডার করে ফেলুন অ্যাপন্যারা, পালাটে পারিবেন না, যে যার অস্ত্র ফেলিয়া ডিন,
হঠাৎ একটা আগুনের ফুলকি আর একটা কানফাটা আওয়াজ, এবার লুটিয়ে পড়ল একজন সিপাই, কেউ বুঝে ওঠার আগে আরও একবার আবার আর একজন সিপাই লুটিয়ে পড়ল মাটিতে, একদম মোক্ষম লক্ষ্যভেদ, কপালের মধ্যিখানে
সাহেব পুলিশটি বলে উঠলেন
-তবে হেই হাপনাদের উটটর? তবে টাই হোক, বলে নিজের সিপাই দের অর্ডার দিলেন
– ফায়ার, একটাও স্কাউনড্রেল যেন বাঁচিতে না পারে।
শুরু হল গুলির লড়াই, তারপর যোগ হল বোমাবর্ষণ, এতটা লড়াই মনে হয় পুলিশ’রা ভাবেওনি, গুলি লাগল সাহেবের ঘোড়াটারও, সাহেব মাটিতে নেমে খোঁড়াতে লাগলেন, তার দলের অবস্থা এখন খুব খারাপ, সুস্থ আছে মাত্র চারজন, বাকিরা হয় মৃত নয়তো সাংঘাতিক জখম, এদিকে কোথা থেকে গুলি আসছে কেউ আন্দাজও করতে পারছে না!
এবার গুলির আওয়াজ যেন থামলো কিছুটা, ধোঁয়ার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল চারটে ছায়ামূর্তি, তাদের সামনে এগিয়ে আসছে এটা কে !? আরে এ তো সেই মেয়েটা, এই মুখ তো জিনিয়ার খুব যেন চেনা, কোথায় যেন দেখেছে, মনে পড়ছে না এখন, তবে শাড়িটা!? হ্যা হ্যা মনে পড়ছে এটা তো সেই বেনারসিটা, রায়মামাদের বাড়িতে..ওই মেয়েটা…যার বিয়ে আজকে.. তাইলে কি!?
ওর চুলগুলি এখন এলোমেলো, ধোঁয়া আর চাঁদনী আলোতে কি মায়াবী লাগছে ওকে, ওর হাতে এখন একটা পিস্তল, ওর পেছনে দাঁড়ানো আরো চারজন, পাঁচটা পিস্তল একসাথে গর্জে উঠল, আবার লুটিয়ে পড়ল একজন সিপাই, সাহেবের পায়ে গুলি লেগেছে, কাতরাচ্ছে ওই সাহেব পুলিশটা, দলপতির এই অবস্থা দেখে পালাতে লাগলো পুলিশের দুজন সেপাই, ওদের পেছনে ধাওয়া করে গেল ওই দলটার একজন বিপ্লবী ছেলে!
ধীর পায়ে এগিয়ে এল সেই নারীমূর্তি, সাহেবের কপালে পিস্তলটা ঠেকিয়ে বলল
– মুখটা ভালো করে দেখে নিন উইলসন সাহেব, আজ যদি এখান থেকে বেঁচে ফিরি কথা দিলাম আপনাদের টেগার্টকে’ও এভাবেই মারব, দেখলেন তো পাঁচটা ছেলেমেয়ে কি করতে পারে, আবার এলে ফুল ফোর্স আনবেন স্যার, বন্দেমাতরম ধ্বনি দিয়ে ট্রিগার চিপে দিলেন সেই নারী মূর্তি, চারদিকে আবার সেই নীরবতা, পড়ে থাকলো শুধু ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধ।
দুরেও শোনা গেল দু বার গুলি ছোঁড়ার শব্দ!
কিছুক্ষন পর পাশের ঝোপটা থেকে বেরিয়ে এলো সেই বিপ্লবী ছেলেটা!
সকলে ফিরে যেতে লাগল গঙ্গার ঘাটের দিকে, এমন সময় জিনিয়া দেখল আরও একজন যেন বেরিয়ে এলো পাশের জঙ্গলটা থেকে, গায়ে একটা চাদর চাপা দেওয়া, একটা হাত যেন বেরিয়ে আসছে চাদরের তলা থেকে…কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছিলজেন……আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলো হাতটা……চাঁদের আলোয় ঝলসে উঠল কিছু একটা ধাতব জিনিস…জিনিয়া দেখলো লোকটার হাতে পিস্তল……কিন্তু নিশানা কাকে করছে? কেউ তো নেই ব্রিটিশদের, তাইলে কি লক্ষ্য এই দলটাই?
জিনিয়া ছটফট করে উঠলো যেন, না কিছুতেই এই দল’টার ক্ষতি হতে দেবে না ও, কিছুতেই না, গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে দৌড়াতে লাগল ওই দলটার দিকে!
না পারলো না ও, অল্পের জন্যে দেরী হয়ে গেল, পিছন থেকে লুকিয়ে আসা লোকটা গুলি ছুঁড়ে দিয়েছে, গুলির আঘাতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল সেই সাহসী মেয়েটা, দুটো গুলি লেগেছে তার পিঠে, হঠাৎ শব্দে পিছন ফিরল সবাই, আবার গর্জে উঠল তিনটে বন্দুক, এতগুলি গুলির আঘাতে কারোর বেঁচে থাকার কথা নয়, ওই দল থেকে এগিয়ে এলো একজন, আহত লোকটাকে দেখার জন্য……গুলি খেয়ে আহত হয়ে পড়ে থাকা লোকটার চাদর সরিয়ে দিল ওই দলের একজন……ছেলেটার চমকে যাওয়া ভাবটা এড়ালো না জিনিয়ার চোখ, ছেলেটা এসে শুধু অস্ফুটে একটা কথা বলল
– নরেন, ভাই তুই? শেষে তুই বেইমানিটা করলি? এর শাস্তি তুই পাবিই, এই বলে চরম ঘৃণা আর রাগে ওর বুকে পুরো বন্দুকটা খালি করে দিল ছেলেটা, মৃতদেহটা বারবার কেঁপে উঠতে লাগলো!
তিনজন যাদের মধ্যে একটা মেয়ে আর তিনজন পুরুষ আবার মিলিয়ে গেল অন্ধকারে, পরে রইল কয়েকটা মৃতদেহ, জিনিয়া ছুটে গেল ওই মেয়েটার দিকে, পিছন পিছন এসে দাঁড়িয়েছে ওর মাও, দুজনে মিলে কোলে তুলে শুইয়ে দিলো ওই মেয়েটাকে, এই মুখ, হ্যা..হ্যা এই মুখ জিনিয়া চেনে, এই শাড়িটাও ওর চেনা, এখন কাছ থেকে দেখে সব বুঝতে পারছে ও, রোজ এই মেয়েটাকে দেখে সেই ছোটবেলা থেকে…..সকাল…..সন্ধে…..রাত…..সব মনে পড়তে লাগল জিনিয়ার!
____
বিছানা থেকে ধড়ফড় করে উঠে পড়লো জিনিয়া, ওর শরীর ঘামছে, মাথা কাজ করছে না, কোথায় ছিল ও!? এখনই বা কোথায় আছে ও !?
চারিদিক একবার ভালো করে দেখে নেয় জিনিয়া না সব তো ঠিক আছে..ওর ঘরেই তো শুয়ে আছে, পাশে ওর মা শোয়া, সেই চেনা ঘর, তাইলে ও স্বপ্নই দেখছিল, কিন্তু এত জীবন্ত !!
না তাও একবার পরীক্ষা করে দেখতেই হবে, ও জানে কোথায় যেতে হবে, টেবিল ক্লকটায় দেখল ভোর ৪.৩০, বিছানা থেকে নেমে চুপিচুপি এগিয়ে গেল সেই ঘরটার দিকে, যেখানে ওর মা আর বাবা ছাড়া কেউ যেতে পারে না, একটা ছোট্ট বাল্ব জ্বালিয়ে দেরাজ থেকে বের করে আনলো একটা চাবি, ওই ঘরটার চাবি, মায়ের টেবিলের ড্রয়ারেই থাকে।
ওই পুতুল’টার কাঁচের ঘরের, যেই পুতুল’টার দিকে দোকানের সবাই হা করে তাকিয়ে থাকে, সবাই এসে সেলফি তোলে, পুতুলটা সত্যিই কি সুন্দর, যেন জীবন্ত, জিনিয়াও দেখেছে পুতুল’টার হাতের রেখা দেখা যায়, শিরা গুলিও খুব পরিষ্কার, কিন্তু ওর মা’ই একমাত্র এর দেখাশোনা করতে পারে আর রায়মামীরা, আর কেউ এই কাঁচের ঘরটায় ঢুকতে পারেনা, জিনিয়া দেখেছে পুতুলটাকে যখন নতুন ড্রেস পড়ানো হয় মা তখন পর্দা টেনে দেয় ঘরটার, খুব অদ্ভুত লাগতো জিনিয়ার, পুতুলের আবার এত লজ্জা কি !? অনেকবার জিগ্যেস করেছে মা’কে, মা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে বারবার!
তবে আজ ও দেখবেই, কাঁচের ঘরটা খুলে ফেলল জিনিয়া, কেমন যেন একটা পোড়া পোড়া গন্ধ নাকে এলো, আরে এই গন্ধটাই তো ও পাচ্ছিল একটু আগেও, পোড়া বারুদের গন্ধ!
আর একটু কাছে গিয়েই যেন আকাশ থেকে পড়ল জিনিয়া, এই তো সেই শাড়িটা, সেই বেনারাসিটা, এইটাই তো……হ্যা..এইটাই তো পড়েছিল মেয়েটা, তবে এটা কিসের দাগ বুকের কাছে শাড়িটায়!? একটা, না দুটো, দাগ না দুটো গর্ত যেন, তারথেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে এটা কি!? রক্ত, হুম ঠিক তাই, আঙুল দিয়েই বুঝলো জিনিয়া, তাইলে কি..না আর ভাবতে পারছে না জিনিয়া, পা গুলি আবার অসার হয়ে আসছে, পুতুল’টার মুখের দিকে তাকালো একবার, মনে হলো যেন হাসছে ওর দিকে তাকিয়েই, সেই মুখটা..হমম একদম..একদম সেই মুখটা..উইলসনের চোখে চোখ রেখে ট্রিগার টিপে দিয়েছিল যে…না না..আর ভাবতে পারছে না ও, ওর মনে হতে লাগলো ও যেন পড়ে যাচ্ছে কোনো গভীর অন্ধকারে, থামতে পারছে না, শুধু মনে হল কারোর দুটো হাত এসে যেন ধরল ওকে হঠাৎ ওকে।
জ্ঞান ফিরেছে জিনিয়ার, আস্তে আস্তে চোখ মেলতেই দেখলো ওর মা’য়ের কোলেই শুয়ে আছে, মাকে দেখেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল জিনিয়া,
মা বলল
– পাগলী মেয়ে কাঁদছিস কেন রে!? ভয় পাস না, আজ তো খুশির দিন
– ও কে মা, ও কে!? যা দেখলাম সব সত্যি মা !? সব সত্যি !?
– হ্যাঁ রে মা, সব সত্যি!
-আমায় গল্পটা বলো মা পুরোটা,
মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঊর্মিলা বলল
-পুরোটা তো দেখলি নিজের চোখেই!
-না না তাও বলো তুমি পুরোটা।
– শোন তবে, বিয়ের দিন রাতে পালিয়ে যায় এই রায়মামা’দেরই ঠাকুরদার এক বোন, সঙ্গে পালালো ওর ছোটবেলার সবচেয়ে কাছের বন্ধু গিরিজা।
– মানে ওই অন্য মেয়েটা?
– উফফ কথা বলিস না মাঝে, হমম ওই মেয়েটার নামই গিরিজা, গিরিজাবালা সেন, দুজন হরিহর আত্মা, একদম ছোটবেলা থেকেই, লোকে বলত দুই বোন!
একসাথে স্কুলে যাওয়া, খেলাধুলা তারপর একটু বড় হলে কলেজ যাওয়া সব একসাথেই, সে যুগের মেয়ে হলেও দুজনের বাড়ীর বড়রা বাধা দেয়নি ওদের কোন কাজেই।
তবে গোলমাল বাঁধল একদিন হঠাৎ করেই, দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে তেজেন্দ্রনারায়ন রায় পাড়ায় কানাঘুষো শুনলেন দুই মেয়েকে নাকি কংগ্রেস অফিসের বাইরে দেখা গেছে।
দুই মেয়ের পেছনেই লোক লাগালেন তিনি, খবর পেলেন দুই মেয়েই নাকি কংগ্রেসের সভায় চলে যায়, তবে সবচেয়ে বেশি দেখা যায় সুভাষ বাবুর মিটিং এ যেতে, দুই বন্ধু দু-একবার দেখাও করে এসেছে নাকি সুভাষ বাবুর বাড়িতে গিয়ে!
নিজে সেভাবে আন্দোলনে নাম না লেখালেও গোপনে সাহায্য করতেন তেজেন্দ্রনারায়ন কিন্তু বড় ভয় হতো তার বারবার তার বাড়ীর কেউ কি কোনো স্বদেশী দলে নাম লেখালো? তার এক ভাই পুলিশের গুলিতেই মারা গেছিলেন এই স্বদেশী করার অপরাধেই, তাই তার বড় চিন্তা হতো নিজের ছেলে মেয়েদের নিয়ে।
বাড়ির অন্য লোকেদের কানে যেতেও দেরি হলো না, দুশ্চিন্তা বাড়লো, ঠিক হল বিয়ে দিয়ে দেওয়া হবে, সেইমতো ব্যবস্থাও হলো, এই মাসে একজনের, পরের মাসে অন্যজনের, তবে গোপনে বাধ সাধলেন সুষমা দেবী, উনি চাইতেন তার মেয়ে বা ছেলে দেশের কাজে যাক, সংসারের হেঁসেল ঠেলা বা দোকানের হিসেব রাখার থেকে দেশের কাজ করুক।
তিনিই প্ল্যান বুঝিয়ে দিলেন দুজনকে, তবে উনি জানতেন না বাড়ির মেয়েই তার প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে গোপনে গড়ে তুলেছে “সরস্বতী বাহিনী”, এদের কাজ ছিল সব জায়গায় ঘুরে ঘুরে মেয়েদের লেখাপড়া শেখানো, বিপ্লবের ইতিহাস পড়ানো, আর বড় হয়ে গেলে পড়ানো হত রাজনীতি আর সমাজনীতির বই, দলের কোন মেয়ে খুব বিশ্বস্ত হয়ে গেলে গোপন ডেরায় নিয়ে গিয়ে লাঠি, ছুড়ি, তির-ধনুক, তলোয়ার, বন্দুক চালানো শেখানো হতো সঙ্গে চলত বোম্ব বানানো আর ক্যারাটে শিক্ষা।
আর ওদের নামটার জন্য পুলিশ সন্দেহও করেনি কোনদিন, নিজেরাও বহুবার গেছে স্কুলের জন্যে, পুজোর চাঁদা তুলতে লালবাজারে, অনেক চাঁদা উঠতো, কেউ সন্দেহ করতো না, সবাই ভাবতো কিই বা করবে এই দশ-বারো বছরের বাচ্চা মেয়েগুলি? ওরা মনে মনে খুব হাসতো, সত্যি কি বোকা এরা!
লালবাজারের আনাচে কানাচে ঘুরে এসে পুরো প্ল্যান এঁকে তুলে দিত অন্য দলদের হাতে! পরে অন্য গোপন বিপ্লবী দলরাও যোগ দিল ওদের সাথে, অনেক ছোট-বড় অপারেশন করত ওরা, কোন পুলিশ অফিসার হয়তো বাজার করতে বেরিয়েছে, রাস্তার পাশের কোন উঁচু গাছ বা বাড়ীর ছাদ বা জানলা থেকে একটা বিষ মাখা তীর ছুড়ে মারলো কেউ, কোন আওয়াজ নেই, হৈ হট্টগোল হওয়ার আগেই সেই বাচ্চা মেয়েটা ভিড়ে মিশে গেল, কখনো কোন থানায় গিয়ে চাঁদা তোলার অছিলায় জলে বিষ বা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিত, খুব কার্যকরী উপায় এগুলি, এভাবে বেশ চলছিল প্রায় বছর পাঁচেক, কেউ জানতেও পারেনি।
– তারপর?
-তারপর বিয়ের রাতে দুই মেয়ে পালিয়ে গেল বাগবাজার গঙ্গার ঘাটে, পুরো প্ল্যানটাই করেছিলেন সুষমা দেবী নিজেই, বাড়িতে কাউকে বলেন নি, প্ল্যান ছিল বিয়ের সব গয়নাগাঁটি আর মায়ের দেওয়া কিছু টাকা সবমিলিয়ে প্রায় পঁচিশহাজার টাকা তখনকার দিনে, সব ভাগ করে নিয়ে একটা দল পাড়ি দেবে লখনৌর দিকে ওখান থেকে দিল্লি আর অন্যদল পাড়ি দেবে ঢাকা, কিন্তু না, ধরা পড়ে গিয়ে নরেন পুরো প্ল্যান বলে দেয় পুলিশকে, তারপর তো তুই দেখলি সব
– আর ঐ মেয়েটা কোথায় গেল!?
– ওই পরে ওই দলের নেত্রী হয়, সে কে ছিল জানিস?
অবাক হয়ে জিজ্ঞ্যেস করে জিনিয়া
– কে মা !?
– তোর দিদার মা!
– সত্যি মা? জিনিয়ার চোখে মুখে গর্ব আর বিস্ময় যেন ফুটে উঠছে।
– হমম রে মা, উনি পাটনায় গিয়েও এই দলের কাজ চালাতেন, শোনা যায় ভগত সিং কে দেখতে ছদ্মবেশে লাহোর জেলেও গেছিলেন।
– তারপর ওই দিদিমা আর ফেরেন নি কলকাতায়?
– হমম ফিরেছিলেন তো, পুলিশ শত চেষ্টা করেও ওকে ধরতে পারেনি, নিজের দলের সব কাজ উনি করেছিলেন।
– তাইলে এই পুতুলটা কি করে এল!?
– এই ঘটনার পরের দিন পুলিশ গিয়ে বাড়িতে খবর দেয়, গঙ্গার ঘাটে একটা মহিলার দেহ পাওয়া গেছে, পোশাক দেখে কোন সম্ভ্রান্ত বাড়ীর বলেই মনে হয়েছিল পুলিশের, সনাক্ত করতে ডাক পড়লো, সনাক্তও হল, পুরো বাড়ি কান্নায় ভেঙে পড়লেও শক্ত রইলেন সুষমা দেবী, উনি হুকুম দিলেন মেয়ের দেহ দাহ উনি করতে দেবেন না, বাঁচিয়ে রাখবেন দেহটা যাতে বাকিরাও দেখে এগিয়ে আসে, বাকি মেয়েরাও যেন এগিয়ে আসে ওনার মেয়ের মতই।
– কি করে বাঁচিয়ে রাখলেন?
– এই যে মূর্তিটা দেখছিস, এটা একটা বিশেষ মোম দিয়ে তৈরি!
– তার মানে কি মা…পুরোটা বলতে পারলো না জিনিয়া, গলা আটকে আসছে ওর।
– হমম উনি মৃতা’ই তবু বছরের এইদিন উনি ফিরে আসেন আমাদের ওনার গল্প শোনাতে, যাতে আমরা ওঁদের অবদান ভুলে না যাই, সেই ১৯৩১ থেকে চলে আসছে!
– তারপর? উতলা হয়ে জিগ্যেস করল জিনিয়া।
– আমার দিদা মানে ওই গিরিজাদেবী যখন কলকাতায় ফিরলেন, উনিই দেখাশোনা শুরু করলেন নিজের বন্ধুর, নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে দেওয়া এই কথাটাও উনি রেখেছিলেন, সেই থেকে আমারাও এই বাড়ীরই একজন হয়ে গেলাম রে মা, প্রতিবছর এই দিনটাতে উনি আসেন, দেখা দিয়ে যান ওনার প্রিয় পরিবারের সবাইকে।
– আচছা ওনার নাম কি ছিল মা!?
– কমলিনী…..কমলিনী রায়…..
আচ্ছা যা যা অনেক গল্প শোনা হয়েছে, ছ’টা বাজে, যা ফ্রেশ হয়ে নে গিয়ে, পাগলী মেয়ে।
মায়ের কথা শুনে জিনিয়া বাথরুমে গেল, চোখে মুখে জল দিল, ঘোর যেন কিছুতেই কাটছে না ওর, ব্রাশে পেস্ট লাগানোর সময় খেয়াল করল, ওর হাতে এখনো লেগে আছে সেই রক্তের দাগ, ওর নিজের জামা থেকেও বেরোচ্ছে সেই বারুদ পোড়া গন্ধ…
ছুটে চলে গেলে সেই গোপন ঘরটায় যেখানে আজ অব্দি ও কোনদিন যায়নি, ও জানে আজ আর কোন ভয় নেই, এক ছুটে ঘরটায় ঢুকে পড়ল, দেখলো ঘরে রয়েছে একটা আলমারি, একটা পুরনো দিনের ড্রেসিং টেবিল আর একটা পড়ার টেবিল, কি মনে করে টেনে টেনে খুলতে লাগলো সব কটা ড্রয়ার, অবশেষে একটা ড্রয়ারে দেখল লাল কাপড়ে জড়ানো রয়েছে একটা পিস্তল, অনেক পুরনো, ভারী জিনিসটা হাতে তুলে নিয়ে নলটা নাকের কাছে আনল জিনিয়া,
নলটা এখনও গরম, নলের খোলা মুখে এখনও লেগে আছে পোড়া বারুদের গন্ধ!
______
স্বাধীনতা সংগ্রামের উপর ও মেক্সিকোর “লা পাস্কুলিয়াতা” নামক চলতি কিংব্দন্তি অবলম্বন করে লেখা – লেখক
Excellent
LikeLike
ধন্যবাদ দাদা, পাশে থেকো!
LikeLike