তাডোবায় তাণ্ডব – বিদিশা ভট্টাচার্য

এই শিরোনামটা পড়েই যাঁরা জটায়ুর সঙ্গে মিল খুঁজে পেয়ে গেলেন, বা পেতে সচেষ্ট হয়ে এক চোখ ভুরুর বেড়া টপকে কপালে তুলে দিলেন, তাঁরা কিন্তু যারপরনাই হতাশ হবেন, তা আমি স্পষ্ট বলে রাখছি। আমাদের এই বেড়ানোর গল্পটা সত্যি বলতে কি পুরো জগাখিচুড়ি জিনিস। “ধরি ধরি ধরিতে না পারি” ধরণের। যাইহোক, কুশীলবেরা হলাম, কেটেছেঁটে আমরা সাতজন। কুশীলব বলা ভুল, আমরা সাত বঙ্গললনা। লবও নেই, কুশও নেই। এই কাটছাঁটের একটা আবার ভূমিকা আছে। আমরা সবাই পুঁচকেবেলার বন্ধু, সাংসারিক ঝড়ঝাপটা যথাসম্ভব কাটিয়ে এখন মধ্যগগনে বিরাজ করছি। অবশ্য সবসময় যে সগৌরবে বিরাজ করি তা নয়, মাঝে মাঝেই শুয়ে পড়ি, কাটা সৈনিকের মত। তখন কি হয়? আর সেকথা নাই বা শুনলেন, শুধু জেনে রাখুন, ব্যাপারটা পুরো মেফিস্টোফিলিস হয়ে যায়।

তা, সত্যি বলতে কি, গত কয়েকমাস ধরেই আমাদের মন উড়ুউড়ু। তবে আমাদের বেড়ানোর কিন্তু বিরাম নেই, আজ মধুপুর, তো কাল শান্তিনিকেতন, পরশু কেরালা তো তার পরেই ভুবনেশ্বর, আবার ফিরে এসেই গৌহাটি। কিন্তু, ওই যে ওপরওয়ালা একটা খোঁচা দিয়ে রেখেছিলেন না, সবশেষ করেও মনে হতে লাগল, তবু ভরিল না চিত্ত।

এইরকম সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে আর অদৃশ্য গোঁফে তা দিতে দিতে হঠাৎই একদিন বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে গেল। আমাদের মনে আঁচড় কাটলো তাডোবা নামটা। তো, আমায় আর পায় কে! ওই তাডোবার বেড়ানোর সময়টা নিরবচ্ছিন্ন ছুটি।
যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। সবাইকে জানিয়ে দিলাম সশরীরে নরকগুলজার করতে আমি যথাসময়ে হাজির হয়ে যাবো। ঝপ করে ট্রেনে নাগপুর যাবার টিকিটটা কেটে নিলাম। বন্ধুদের জ্বালাতন করে ফেরার টিকিটও কাটা হয়ে গেল। পুরো আটজনের টিম।

এরপর শুরু হল দিন গোনা। এতক্ষণে নিশ্চয়ই আপনারা আমার সম্পর্কে একটা ধারণা খাড়া করে ফেলেছেন। আমি বেকার মানুষ, মাঝে মাঝে চারপাশের লোকজনকে কলমের খোঁচা দিই। কি বললেন? পড়াশোনা? না তার বাইরের কিছু? সে যাই হোক না কেন, আমি হলাম গিয়ে successful failure … তাহলে আজকের মত থাক, আবার হাওড়া স্টেশনে দেখা হবে।

১২ তারিখে গুটিগুটি ব্যাগপত্র, রাতের খাবার নিয়ে আমরা হাওড়া স্টেশনে পৌঁছলাম। ট্রেনের দুলুনি শুরু হতে না হতেই দুনিয়ার ক্ষুধা এক হয়ে খাবারের বাক্সের দিকে আকৃষ্ট হল। এখন এটা, এক ঘন্টা পরে ওটা, তারপরে কিছুমিছু, করতে করতে সন্ধ্যে সাড়ে সাতটার মধ্যে রাতের খাবারের পালা শেষ।  নাগপুর পৌঁছতে তখনও বারো ঘন্টা দেরী। গড়িমসি করতে করতে সবাই শুয়ে পড়লাম। আমাদের নাগপুর পৌঁছানোর কথা ছিল ভোর সাড়ে সাতটা নাগাদ। কিন্তু তার প্রায় চল্লিশ মিনিট আগেই পৌঁছে গেলাম।

স্টেশন থেকে বেরুলেই কমলালেবুর বাজার। কমলালেবুর হাতছানি উপেক্ষা করে, জিভ থেকে টসটসিয়ে পড়োপড়ো জলটাকে কোনোমতে ঠেসেঠুসে পেটে চালান করেই ট্যাক্সিতে উঠে পড়লাম। গন্তব্য বিমানবন্দরের কাছে একটা ছোট হোটেল।

নাগপুর থেকে তাডোবা পৌঁছতে ঘন্টাচারেক লাগে। প্রথমের দিকের রাস্তা বেশ ভালো, সন্ধ্যের মুখে ভাঙাচোরা রাস্তায় পড়লাম। এদিক ওদিক বেঁকে হাতে পায়ে ব্যথা বাড়িয়ে হঠাৎ আমাদের ড্রাইভার আবিষ্কার করল যে সে ভুল রাস্তায় এসেছে। কথায় বলে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখান সন্ধ্যে হয়। আমার কিন্তু সেই ভুল রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে বাঘের ভয় ছাপিয়ে আরও একপ্রস্থ অজানা ভাঙা রাস্তার বিভীষিকা মনে উঁকি দিতে লাগল।

একটু দূরে গিয়েই পাওয়া গেল একটা নিঃসঙ্গ পেট্রোল পাম্প। গোধূলির ধুলোমাখা মরা আলোয় সেই জনশূন্য রাস্তার পাশে একাকী পেট্রল পাম্পের সামনে দাঁড়িয়ে ছোটবেলার বীরভূমের আদিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তরের কথা মনে পড়ে গেল। একটু পরে পাওয়া গেল অভিপ্রেত রাস্তার হদিশ।  আবার শুরু হল চলা। আবার সেই ভাঙা রাস্তা, আর প্রচুর ধুলো।  লালমাটির দেশ বিদর্ভ তো এমনিতেই রুক্ষ। গাড়ির আলোয় দেখছিলাম রাস্তার ধারের গাছগুলোও আপাদমস্তক ধুলোর আস্তরণে ঢাকা পড়ে আছে।
রাস্তার পাশে জঙ্গলের সাইনবোর্ড দেখে দেখে রাত আটটা নাগাদ পৌঁছানো গেল তাডোবায়। হাতমুখ ধুয়ে ডাইনিং হলে রাতের খাওয়া সেরেই ঘুম। পরের দিন সকালেই সাফারি। সাফারির উত্তেজনায় ভোর ভোর ঘুম ভেঙে গেল।

জঙ্গলের জীপ, চালকসহ হাজিরা দিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। আমরা ছজন টপাটপ উঠে পড়লাম। জীপ স্টার্ট নিল। আগের দিনের ধুলোমাখা রুক্ষ হালকা ঠাণ্ডার জায়গায় জাঁকিয়ে বসেছে ঘন কুয়াশা, আর চাবুকের মত ঠাণ্ডা হাওয়া। প্রায় ঝড়ের গতিতে পৌঁছে গেলাম চেকপোষ্টে। এরপর গাড়ি জঙ্গলের রাস্তায় নামলো।

আমরা জঙ্গলে ঢুকলাম মোহারলি রেঞ্জ দিয়ে। একটু এগিয়েই একটা বড় জলা, সেটাকে বেড় দিয়ে রাস্তা। জলার ধারে আমরা বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, কারণ ভোরে জীবজন্তু জলায় জল খেতে আসে। জলার গা ঘেঁষে একটা ছোট পায়ে চলার পথ, শেষ হয়েছে একটা  watch tower এ। গাইড আস্তে আস্তে বলে যেতে লাগল তাডোবার বাঘেদের পরিসংখ্যান, ইতিবৃত্ত, হালহকিকত, সঙ্গে অন্য জীবজন্তুর সাকিনঠিকানা। জলের দিকে তাকিয়ে সেসব শুনতে শুনতেই মনটা সেখান থেকে দূরে চলে গেল।

জলের একটা মোহ আছে। জলের দিকে তাকিয়ে শীতের হাওয়ায় ছোট ছোট আলিম্পন দেখতে সময় কোথা দিয়ে কেটে যায়। একই ভাবে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে হয়। জলার ধারে ছোটবড় বোল্ডার, বড় বড় বিবর্ণ ঘাস দেখা যাচ্ছে চারপাশ দিয়ে। মাঝে দু একটা ছোটখাট গাছ। শীতের আঘাতে নিঃস্বপ্রায়। তারই একটা ডালে বসে একদৃষ্টে জলের দিকে তাকিয়ে আছে একটা ছোট্ট মাছরাঙা পাখি। কি অসম্ভব শান্ত চারদিক। মনে হল মানুষের লোলুপ দৃষ্টি থেকে আড়াল করে রাখতে প্রকৃতি যেন কুয়াশার এক অস্বচ্ছ ওড়নায় তার একান্ত আপন সৃষ্টিকে আদর করে জড়িয়ে নিয়েছে। এই বয়সে জঙ্গলে এসে আমার মনে হল এখানে যেন আমাদের প্রবেশাধিকার না থাকলেই ভাল ছিল। কিন্তু আমরা মানুষ, সব কিছু গুনে গেঁথে মেপে বুঝে নিতে চাই। যাতে কোথাও কিছু ফাঁকি না পড়ে যায়। এই আবেদন শোনার কান আমাদের কোথায়?

গাড়ি আবার জঙ্গলের বুক চিরে চলতে শুরু করল। পুরো জলাটা বৃত্তাকারে ঘুরে আমরা পৌঁছলাম জলার পেছনের রাস্তায়। একটু এগোতেই দেখলাম আরও অনেকগুলো জীপ জড়ো হয়েছে, সেই যেখানে আমরা প্রথমে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দুড়দাড় করে সেখানে পৌঁছনো গেল। তখনও চারদিক হালকা কুয়াশায় মোড়া। সেই কুয়াশার চাদরের মধ্যে দিয়ে একটু দূরে দেখলাম জঙ্গলের রাজাকে। জলা থেকে একটু ডানদিকে সরে জঙ্গলের দিকে। গাইড বলল, উনি বাঘিনী। নাম সোনম। কিন্তু এত দূর থেকে একঝলক দেখেই বাঘ আর বাঘিনীর পার্থক্য বোঝার মত অন্তর্দৃষ্টি এই নিরীহ বঙ্গললনার নেই। গাইডের তথ্যেই সন্তুষ্ট থাকতে হল।

এরপর গাড়ি চলছে ঠাণ্ডা হাওয়া কেটে কেটে, চারদিক আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে। সেই ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় সুনিবিড় অরণ্যানী তার সমস্ত সৌন্দর্যের ভরা আমাদের সামনে উপুড় করে দিল।
কে বলে জঙ্গলের রঙ শুধুই সবুজ? কে বলে বসুমতী কৃপণা? আমরা অত্যন্ত স্থূল। আমাদের দেখার চোখ নেই, শোনার কান নেই, অপেক্ষা করার ধৈর্য্য নেই, অনুভব করার হৃদয় নেই। ইঁট, কাঠ, পাথরের জঙ্গলে আমরা আমাদের সব ইন্দ্রিয় খালি কিছু মৃতবস্তু জমিয়ে তোলার কাজে নিয়োজিত করে রাখছি। অমৃতের আস্বাদ আমরা বুঝব কি করে? বিভিন্ন রঙের লালমাটি, মেঘহীন নীল আকাশের সঙ্গে পরতে পরতে খুলতে থাকা নানা রকমের সবুজের পোঁচ আমায় বাক্যহারা করে দিল। জঙ্গলে ঢোকার মুখে একটা signboard দেখেছিলাম। তাতে লেখা ছিল আপনি যদি শুধু বাঘ দেখবেন বলে মনস্থ করে আসেন, তাহলে দিনের শেষে না দেখতে পেলে অসম্ভব হতাশ হবেন। তার চেয়ে জঙ্গল দেখতে আসুন। আপনি নিরাশ হবেন না।

মোহারলি রেঞ্জের জঙ্গল মূলতঃ বাঁশগাছের জঙ্গল। প্রধানতঃ দুই প্রজাতির বাঁশগাছ এখানে দেখতে পাওয়া যায় বলে গাইড জানালো। তবে অধিকাংশ পরিণত বাঁশঝাড়ই নীচু ঝোপ ধরনের। অনেকটা সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভের মত। অনেকটা জায়গা জুড়ে বিশাল হৃষ্টপুষ্ট চেহারার বাঁশঝাড় এখানে বিরল। এখানকার বাঁশ অনেকটা আমাদের দেশের মূলীবাঁশ বা তলতাবাঁশের মত। নীচু ঝোপ হওয়ায় বাঘ বা চিতাবাঘের আত্মগোপনের  জন্য বিশেষ সুবিধেজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আর আছে সেগুনগাছ। দেখে মনে হল এই সেগুনের fibre খুব dry…  বাংলার সেগুনের মত moist নয়। আরও একটি গাছ দেখলাম, যেটা সম্পূর্ণ মাখনের রঙের। ওরা বলে ghost tree বছরে তিনবার এই গাছ রঙ বদলায়। শীতে মাখন রঙ, গরমে হালকা বাদামী ও গোলাপীর মিশ্রণ আর বর্ষায় হালকা সবুজ। বলাই বাহুল্য, এই গাছ কয়েক মুহূর্তের জন্য আমাদের সমস্ত মনযোগ আকর্ষণ করে নিয়েছিল।

হঠাৎ এক জায়গায় এসে গাড়ি থেমে গেল। দেখলাম বেশ বড়সড় একটা নীলগাই। সঙ্গীসাথীদের ডাকতে ডাকতে রাস্তা পার হচ্ছে। সে চলে যেতে আবার পথ চলা, একটা ফাঁকা জায়গায় দেখতে পেলাম বেশ বড় একপাল হরিণ, বাচ্চাসমেত। সঙ্গে গাছের ডালে একপাল হনুমান, তারাও সপরিবারে। একটু এগিয়ে দেখলাম এক ভাল্লুক বাবাজীকে। দেখলাম বললে ভুল হবে, পুরো দেখিনি। দূর থেকে আমাদের গাড়ির শব্দ পেয়েই সে জঙ্গলে ঢুকে গেল। আমরা বাঁশঝাড়ের ফাঁক দিয়ে তার পেছনের পা দুটো দেখতে পেলাম শুধু। আমাদের ড্রাইভার গাড়ি এগিয়ে নিয়ে গিয়ে ঘুরিয়ে ওই ঝোপের প্রায় পাশে নিয়ে এল। এখন আমাদের বাঁদিকে দীর্ঘ বাঁশঝোপ, ডানদিকে একটু খোলা ঘাসবন তারপরে আবার বড় গাছের জঙ্গল।

দু তিন মিনিট এভাবেই কাটল। এবারে আমি আস্তে আস্তে ঝোপের মধ্যে দেখার চেষ্টা করতে লাগলাম। ঘনসন্নিবদ্ধ বাঁশবন। গোড়ার দিকটা প্রায় নীলাভ হয়ে আছে। একদৃষ্টে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর দেখতে পেলাম জঙ্গলের রাজাকে। থাবা পেতে আধশোয়া অবস্থায় বসে আছে। চুপ করে ঝোপের দিকে তাকিয়ে বসে আছি, কখন মহারাজ বেরিয়ে এসে দয়া করে দর্শন দেবেন। কি একটা পাখি জোরে টিঁউ টিঁউ করে ডেকে উড়ে গেল। সব নিস্তব্ধ, হঠাৎ দেখলাম মহারাজ আড়মোড়া ভাঙার মত করে পেছনের পা ছড়ালেন। কয়েক মুহূর্ত, তারপরেই মহারাজ উঠে একটু পেছন দিকে চললেন, আমাদের দৃষ্টির বাইরে, ওখানে আর চোখ চলে না। গাইড বলল, বাঘ আসছে দেখুন। বলতে না বলতেই মহারাজ ওই ঝোপ থেকে বেরুলেন, তাডোবার মাইলফলকের পাশ দিয়ে। রাস্তার ওপরে এসে দাঁড়ালেন রাজসিক মহিমায়, আমাদের যথেষ্টরও বেশী সুযোগ দিলেন ভাল করে দেখার এবং ছবি তোলার। দিনের নরম অথচ পরিপূর্ণ আলোয় দেখলাম মহারাজের বীরোচিত চেহারা ঝকঝক করছে। গোটা জঙ্গলটা যেন ঝলমল করে হেসে উঠে আভূমি নত হয়ে তাদের রাজাকে অভিবাদন জানাল। মনে পড়ে গেল William Blake এর কবিতার কথা, “Tyger, Tyger burning bright …”  আমরা পরিপূর্ণ, পরিতৃপ্ত। আমাদের মন ভরে গেছে। রাজসন্দর্শনে এসেছিলাম, রাজানুগ্রহ লাভ হয়েছে। আর কি চাই? গাইড বলল, এটি বাঘ, নাম T7, পুরুষ বাঘের কোনো আলাদা নাম দেওয়া হয় না।

সকালের সাফারি শেষ করে ফেরা গেল। দুপুরে আবার দুয়ারে দাঁড়িয়ে জীপগাড়ি। মোটামুটি একটা মধ্যাহ্নভোজ সেরেই গাড়িতে ওঠা গেল। সমগ্র অরণ্যানী যেন সপরিবারে বিশ্রাম নিচ্ছে। কোথাও একটা গৌর (Indian Bison) ছায়ায় বসে জাবর কাটছে, কোথাও ইতস্ততঃ হরিণগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর কোথাও জলার ধারে পাড়ের ওপর দুই পক্ষীদম্পতি বসে বিশ্রম্ভালাপ করছে আর তিরতির করে কাঁপা জলে নিজেদের ছায়া দেখছে। জঙ্গলের শুধুমাত্র ২০ শতাংশ এই সাফারির জন্য উন্মুক্ত, বোঝা গেল দিনের কাজকর্মের পরে জঙ্গলবাসিরাও আরও গহীন অঞ্চলে পাড়ি দিয়েছে। একটু অন্য দিকে যাওয়াও হল, শেষে ফেরার সময় পাওয়া গেল একদল ঢোলকে (বুনো কুকুর)। এরা এখন  IUCN list এ endangered species এর মধ্যে পড়ে।

বনদপ্তরের একটা অত্যন্ত দৃঢ় পদক্ষেপ দেখে প্রশংসা না করে থাকা গেল না। জঙ্গল লাগোয়া বনবস্তিকে জঙ্গলের সীমানার বাইরে পুনর্বাসন দেওয়া হয়েছে। এটা যেমন মানুষের পক্ষে তেমনই জঙ্গলের পক্ষে মঙ্গলজনক। কারণ এইসব অঞ্চলে শিল্প বা ব্যবসা বাণিজ্য হওয়া অসম্ভব। মানুষকে পশুপালন এবং ছোটখাট কুটির শিল্পের ওপরই নির্ভর করে থাকতে হবে। আর জঙ্গল এলাকায় পশুপালন মানেই গবাদি পশুরা সহজলভ্য খাদ্যের জন্য জঙ্গলের সীমানার মধ্যে তাদের চারণভূমিকে বিস্তৃত করবে। ফলে মাংসাশী প্রাণীরাও আস্তে আস্তে এই সহজ শিকারের দিকে আকৃষ্ট হবে। অনায়াসে শিকার পেলে কেই বা কষ্ট করতে চায়। শেষে মানুষকেই তাদের শিকার হতে হবে। আর তখন এক লহমায় মানুষখেকো বলে তাদের হত্যাও করা হবে। অথচ যার কিছুই এই মাংসাশী প্রাণীরা শুরু করেনি।

পরেরদিন সকালে আমাদের গন্তব্যস্থল আগরজরি অঞ্চল। গেটের নামও আগরজরি, মোহারলি থেকে ৬/৭ কিলোমিটার দূরে। এই দিককার জঙ্গলের চরিত্র একেবারেই আলাদা। আগরজরি রেঞ্জের জঙ্গল মূলতঃ সেগুন গাছের জঙ্গল। এই জঙ্গল অনেক বেশী সবুজ। কিন্তু রাস্তা বড্ডো উঁচুনিচু। আপনি এই ওপরে আছেন তো পরমূহুর্তেই একধাক্কায় নীচে চলে গেলেন। এই জঙ্গলে একটা গাছ দেখলাম যার কাণ্ডের রঙ সম্পূর্ণ কালো। চারদিকে সবুজ পাতার মধ্যে একটা কুচকুচে  কালো ডাল সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই গাছের নাম জানা হয়নি। ছবিও নেই হয়ত।

এই অঞ্চলে জায়গায় জায়গায় মাদী বাঘের এবং শাবকের পায়ের ছাপ পাওয়া গেল। কিন্তু চিতল হরিণ, সম্বর হরিণ এবং কিছু পাখি ছাড়া সম্ভবতঃ আর কিছু আমাদের চোখে পড়ে নি। আরও খানিকক্ষণ ইতস্ততঃ জঙ্গল ভ্রমণ। তারপরে তাডোবার জঙ্গলকে পাকাপাকিভাবে বিদায় জানিয়ে রিসর্টে ফিরলাম আমরা।

সব শুরুরই শেষ আছে, কোথাও না কোথাও তো থামতেই হয়। সকাল সাড়ে সাতটায় তাডোবা থেকে রওনা হওয়ার কথা, গাড়িকে সেইরকমই নির্দেশ দেওয়া ছিল। সকাল আটটার একটু আগেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম, পেছনে পড়ে রইল দিন দুই-আড়াইয়ের ভাললাগা, ভালবাসা এবং হয়ত কোথাও একটু কম ভালবাসার স্মৃতি। যা সম্বল করে চলতে হবে আবার কয়েক মাস। এবারে বাড়ি, আর আমাদের দৈনন্দিন কাজের জগত।

ছবি: তিস্তা নাগ

আমরা হাওড়া স্টেশন থেকে HWH-SNSI EXP    ধরেছিলাম। প্রতি বৃহস্পতিবার দুপুর ২:৩৫ এ হাওড়া থেকে ছাড়ে। কলকাতা নাগপুর flight এও যাওয়া যায়। স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে হোটেল Majestic Manor…   কয়েকঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে 8 seater গাড়িতে তাডোবা। তাডোবায় মহারাষ্ট্র সরকারের রিসর্টে ছিলাম আমরা। বুকিং এর link; http://mtdcrrs.maharashtratourism.gov.in

সাফারি বুকিং এর link;  http://www.mahaecotourism.gov.in
(খরচ শনি রবিবার সাফারি নিলে বেশী)
ওই 8 seater এই ফিরেছিলাম নাগপুরে। যাওয়া আসার খরচ INR: 10000.

নাগপুর থেকে কলকাতা flight এ আসি আমরা। সন্ধ্যে সাড়ে ছটার flight ছিল আমাদের।

বিদিশা ভট্টাচার্য্য একজন বেসরকারি সংস্থায় কর্মরতা। ভ্রমণপিপাসু এবং ধ্রুপদী সংগীতের একজন একনিষ্ঠ গবেষক।

One Comment Add yours

  1. arya chatterjee says:

    বেশ সুন্দর লেখা…সঙ্গে দেওয়া ছবিগুলো লেখাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে…তবে কিছু কিছু জায়গায় কেমন যেন অবাঞ্ছিত jump cut…যেখানে আরো পাঠকের ক্ষিদে, সেখানে সামনে খাবার দিয়ে তারপর খাবার মাঝপথে কেড়ে নেওয়ার মত…

    Like

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.