
তারিখটা ছিল গত মাসের ২০। পশ্চিমবঙ্গ ও উড়িষ্যার উপর আছড়ে পড়ল ঘূর্ণিঝড় আমফান।
এর আগে বহু ঘূর্ণিঝড়ের সতর্কতা জারি হলেও – সাম্প্রতিককালে আমাদের রাজ্যে আমফানের পূর্বে কোনো ঘূর্ণিঝড়ই বিশেষ থাবা বসাতে পারে নি। বেশ কিছু বছর আগে আয়লা’য় সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চল ভীষণভাবে বিপর্যস্ত হলেও সেই ঘূর্ণিঝড় তার বেশি অগ্রসর হয় নি। কিন্তু এই আমফান সুন্দরবনে বিপুল ধ্বংসলীলা চালিয়ে এবারে প্রবল শক্তিতে গ্রাস করেছে দক্ষিণবঙ্গের একাধিক জেলা, বিভিন্ন গ্রামগুলিকে। বাদ পড়ে নি আমাদের শহর কলকাতাও। বহু গাছ ঝড়ের তান্ডবে উপড়ে গেছে, ঘরের চাল উড়ে গেছে, ঘর বাড়ি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে বহু মানুষের। নদীর বাঁধ ভেঙে সমুদ্রের নোনা জলে ভেসে গেছে বহু চাষের জমি। এক জামা কাপড়ে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ। রাষ্ট্র ঘোষণা করেছে অনুদান, তবুও আজ এতগুলো দিন কেটে যাওয়ার পরেও বহু গ্রামেই পৌঁছায়নি যথেষ্ট পরিমাণ খাবার, ত্রিপল – এমনকি অনেক জায়গাতেই খাবার জল পর্যন্তও নেই। তাই এই সময় আমরাও এই অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াব বলে এগিয়ে গেছি। আমাদের সাধ্য সীমিত, তাই আপনাদের সাহায্যেই আজ আমরা এই কাজে এগিয়ে যেতে পেরেছি।


বেশি দিনের কথা নয়, এই দেড়-দু’ সপ্তাহ আগেই আমরা ঠিক করলাম, ‘কথাবৃক্ষ’ ও ‘সুরকাহন’ – এর পক্ষ থেকে আমরা বহু মানুষের পাশে থাকতে না পারলেও, যেকোনো একটি গ্রামের কিছু পরিবারের দিকেও যদি এই দুঃসময়ে কিছুটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি তবে অন্তত কিছু মানুষের তো উপকার হবে! এই ভেবেই, খোঁজ নেওয়ার কাজ শুরু হয়। খোঁজ পাওয়া যায় যে উত্তর চব্বিশ পরগণার বসিরহাট মহকুমার মিনাখা ব্লকের অন্তর্গত মোহনপুর গ্রাম আমফানের তান্ডবে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। গ্রামটির পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বিদ্যাধরী নদী। মাটির বাঁধ ভেঙে বিদ্যাধরী’র জলে ভেসে গেছে মোহনপুর সহ পার্শবর্তী আরও বেশ কয়েকটি গ্রাম। এই এলাকার বহু মানুষের বাড়ি ভেসে গেছে নদীর জলে। নোনা জলে নষ্ট হয়ে গেছে চাষের জমি। গ্রামবাসীদের বেরিয়ে আসতে হয়েছে রাস্তায়। এই গ্রামের খোঁজ পেয়েই, আমরা লেগে পরলাম অনুদান সংগ্রহের কাজে। পোস্টার তৈরি করে ফেসবুকের মাধ্যমে ও ব্যক্তিগত ভাবে অনুদান সংগ্রহের কাজ শুরু হল। অল্প দিনের মধ্যেই অনেকেই এগিয়ে এলেন। গ্রামের পক্ষ থেকে চন্দন পাত্র মহাশয় আমাদের সাথে সব সময়ই যোগাযোগ রেখেছিলেন। চন্দন বাবুর মাধ্যমেই মোহনপুরের সাথে আমারা যুক্ত হতে পেরেছি। ওনার পাঠানো ছবি ও ভিডিও’র মাধ্যমেই আমরা চাক্ষুষ করেছি মোহনপুর গ্রামের বিপর্যয়ের বাস্তব রূপ এবং সেই ছবি ও ভিডিও ব্যক্তিগত স্তরে আপনাদের সাথেও ভাগ করে নিয়েছিলাম আমরা। এই ভাবেই আমাদের স্বপ্নের সাথে আপনাদের সহযোগিতা মিশে গেল, আর আমরা দ্রুত এগিয়ে চললাম আমাদের লক্ষ্যের অভিমুখে। মানুষ হিসেবে মোহনপুর গ্রামের ওই অসহায় মানুষদের পাশে দাঁড়াব, এই ছিল নিজেদের কাছে আমাদের অঙ্গীকার।
এরপর আমরা ঠিক করলাম জুন মাসের ৭ তারিখে রওনা হব মোহনপুরের উদ্দেশ্যে। তার আগের দিন, অর্থাৎ ৬ তারিখ, দমদম ক্যান্টনমেন্ট অঞ্চল থেকে মালপত্র তুলে এবং বড়বাজার থেকে ত্রিপল সংগ্রহ করে আমরা রওনা হলাম মধ্যমগ্রামের উদ্দেশ্যে। সেই রাত্রে মধ্যমগ্রামের বাড়িতে সমস্ত মালপত্র প্যাকিং করে, নামের তালিকা মিলিয়ে তৈরি করে ফেলা হলো ২১০ টি পরিবারের কিট। প্রত্যেকটি কিটে ছিল সর্ষের তেল ৫০০ গ্রাম,
সয়াবিন ১ প্যাকেট, চিঁড়ে ৫০০ গ্রাম, ছাতু ৫০০ গ্রাম, চিনি ৫০০ গ্রাম, নুন ১ প্যাকেট, বিস্কুট ১ প্যাকেট, মুড়ি ১ প্যাকেট, আমূল দুধের প্যাকেট এবং ১ বাক্স মোমবাতি।



পরদিন ভোরবেলায় গাড়িতে মাল বোঝাই করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম মোহনপুরের উদ্দেশ্যে। বেশ ঘন্টা দুয়েকের পথ অতিক্রম করবার পর আমরা গ্রামের রাস্তা ধরে এগোতে লাগলাম। একটা অদ্ভূত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম যে, এই করোনা পরিস্থিতির জেরে শহরাঞ্চলে যেভাবে আমাদের মধ্যে সোশ্যাল ডিস্টেনসিং এবং মাস্ক ব্যবহারের সতর্কতা জারি করা হয়েছে, এর বিপরীতে গ্রামাঞ্চলে কোনো সোশ্যাল ডিস্টেনসিং বা মানুষের মুখে কোনো প্রকার মাস্ক নেই। এর থেকেই আমাদের কাছে এই ধারণা খুব স্পষ্ট হয় যে, আজকের দিনে দাঁড়িয়ে যাদের পেটের ভাত জোটানোই দায়, তাদের কাছে মাস্ক পড়া একটা বিলাসিতা মাত্র।
তারপর স্বরূপনগর, কচুয়ার মোরামের রাস্তা ধরে এগোতে এগোতে চোখে পড়ল চারিদিকের গাছপালা পড়ে এলাকার বহু বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্থ। এমনভাবেই খানিকদূর এগোবার পর, মোহনপুর পৌঁছতে যখন আরো ৬ কিলোমিটার বাকি, তখন দেখলাম যে সেই গ্রামের মানুষেরা পথ অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। বিস্তারিত জানতে চাইলে তারা বলে যে মে মাসের ২০ তারিখ অর্থাৎ আমফান ঝড় যেদিন আসে, সেদিন থেকেই তাদের এলাকায় বিদ্যুৎ নেই। তাদের অভিযোগ অনুযায়ী রাস্তায় পড়ে যাওয়া পোস্টগুলো তুলে নিয়ে গিয়ে অন্য জায়গায় লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং তারা বারবার আবেদন জানানো সত্ত্বেও সরকারি তরফে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। গ্রামের সদ্যোজাত শিশুসহ, বাচ্চাদের গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত। লকডাউনের ফলে এমনিতেই মানুষগুলোর পেটে ঠিকঠাক ভাত জোটেনি বহুদিন, তার ওপর আমফানের তান্ডব এবং এই বীভৎস গরম, সব মিলেমিশে সে এক বেদনাদায়ক দৃশ্য! গ্রামবাসীদের চোখের জল এবং প্রতিবাদের স্বর মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।

অবরোধ শেষ হওয়ার সময়ের আন্দাজ না পাওয়ায় আমরা গাড়ি ঘুরিয়ে অন্য পথ ধরলাম। তবে এবারের রাস্তা আরও অনেক বেশি, প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ আমাদের ঘুরে যেতে হবে মোহনপুর পৌঁছতে গেলে, যাতে সময় লাগবে আরো ঘন্টা দুয়েক। অগত্যা সেই পথ অবলম্বন করে শেষমেশ মালঞ্চ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত বাসারা খেয়া ঘাটে পৌঁছে গাড়ি থেকে মাল নামিয়ে নৌকায় মাল বোঝাই করা হল। স্থানীয় মানুষেরা এগিয়ে এসে তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন এই কাজে। ক্ষুধার জ্বালা যে কি সাংঘাতিক হতে পারে, তা এই মানুষগুলোর তৎপরতায় আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। গাড়িটা ঘাটে লাগানোর সাথে সাথেই স্থানীয় ছেলেরা পরপর দাঁড়িয়ে পড়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই হাতে হাতে কিটগুলো তুলে ফেলে নৌকায়। এরপর মাল বোঝাই নৌকা নিয়ে নদী পথে আমরা রওনা হলাম মোহনপুরের দিকে।
এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন গ্রামগুলির যে কী করুণ অবস্থা, তা কলকাতায় বসে অনুমান করাটা প্রায় অসম্ভব। নদী পেরিয়ে মোহনপুর গ্রামে পৌঁছতেই ছবিটা আমাদের সামনে পরিষ্কার হয়ে উঠল। মোহনপুরে পৌঁছে স্থানীয় লোকেদের কাছে শুনি যে গ্রামের অধিকাংশ জলের তলায় এবং আমরা যে এলাকায় ত্রাণ সামগ্রী দেওয়ার জন্যে এসেছি, সেখানে যেতে হলে প্রায় এক বুক সমান জল পেরিয়ে সাঁতার কেটে যেতে হবে। স্থানীয় ছেলেদের আমরা বলি যে গ্রামের পরিস্থিতি আমরা চাক্ষুষ করতে চাই। ওদের সাথে যে ম্যাটাডোর ছিল, তাতে করে আমরা আস্তে আস্তে গ্রামের মধ্যে ঢুকতে লাগলাম। যত গ্রামের ভিতর প্রবেশ করতে লাগলাম, তত দেখলাম যে অধিকাংশ জমিই জলমগ্ন। আমফান ঝড়ের সময় বিদ্যাধরীর প্রায় ৮৫০ ফুট এর বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় এই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে এলাকার মানুষদের। নদীর জল ঢুকে আজ প্রায় ২০ দিন ধরে তারা জলের মধ্যেই বাস করছে। অনেকের ঘরবাড়ি জলে ভেসে যাওয়ার ফলে এক কাপড়েই দিন কাটাতে হচ্ছে ওখানকার মানুষদের। চারিদিকে দেখলে মনে হবে যে দুধারে নদী এবং মাঝখান দিয়ে পিচের একটি রাস্তা কিন্তু আসলে তা নয়, চারিদিকের ঘাস জমি, ক্ষেত, গ্রাম – সব নদীর জলে ভেসে গেছে। স্থানীয় লোকেদের মুখে শুনলাম যে, ওই গ্রামে প্রায় এক মাসের উপর কারেন্ট নেই। তখন মনে হল যে কলকাতায় ৫-৭ দিন কারেন্ট না থাকায় কিরকম আমরা জীবন যন্ত্রণায় ছটফট করেছিলাম, আর এরা এটাকেই এদের ভবিতব্য বলে মেনে নিয়ে দিনের পর দিন কাটাচ্ছে। জীবন সংগ্রামের আসল ছবিটা ওই কয়েক ঘন্টায় আমাদের চাক্ষুষ হল।
সব দেখে যখন ফিরছি তখন আমাদের কারুর মুখেই আর কোনো কথা নেই। মনে আসতে লাগল অন্নদাশঙ্কর রায়ের একটি বইয়ের নাম ‘কাঁদো, প্রিয় দেশ’! সত্যি আমরা কতটা প্রিভিলেজড তাই বাড়ির চাল, ঘরের বেড়া, ধানের জমি, মাছচাষের পুকুর, রেশনে পাওয়া চাল-ডাল কোনো কিছুর কথাই আমাদের ভাবতে হয় না। আমরা গলা ফাটাই নেট আসবে কখন? নেটওয়ার্ক কেন খারাপ? এসি চলছে না কেন? এমনই আরও অনেক অনেক প্রশ্নের চিৎকারে। যে প্রশ্নগুলোর বিপরীতে এক অন্য ভারতবর্ষ নীরবে আমাদেরকেই উপহাস করে। তবে একটা গ্রামে এককালীন কিছু মুড়ি-চিড়ে-নুন-চিনি- ত্রিপল দিয়ে এসে নাম কেনার চেষ্টা আমরা করছি না। বিশ্বাস করুন, যা দেখে আসলাম তারপর বুঝেছি যতটুকু খবার ওদের হাতে তুলে দিয়ে আসতে পেরেছি, সেটা প্রয়োজনের তুলনায় কিচ্ছু নয়। তাই সকলের কাছে অনুরোধ করব অন্য সব ধরণের প্রলোভনকে একটু সরিয়ে রেখে আসুন না একটু মানুষের জন্য কাজ করি, যেখানে মানুষের কাজটাই মুখ্য হবে।
কবীর সুমন লিখে গেছেন,
“আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু”।
আমরা, আমাদের এই ধর্মপালনে ব্রতী হই জীবনের কিছুটা সময় বের করে। মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছাশক্তির চাইতে বড় আর কিছু হতে পারে কি? আমরা চেষ্টা করবো এই ভাবেই মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর। আমরা চাইবো ‘সব্বাই যেন দিনবদলের পদ্য বলে’। সোসাল ওয়ার্কার হয়ে নয়, মানুষ হয়েই মানুষের বন্ধু হতে চাই, যে স্বপ্নে আগামীদিনে আপনাদের সাহায্য এবং ভালোবাসা আমাদের পাথেয় হবে।