১৩ই জুন, ১৯৪০। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। গরমে আর অজানা ভবিতব্যের আতঙ্কে থমকে আছে ফরাসীদের প্রাণবিন্দু প্যারিস । খাঁ খাঁ করছে রাস্তা-ঘাট, সদ্য নতুন পাতায় ভরা বাগানগুলি একেবারে একা, জনমানবহীন প্রাসাদোপম বাড়িগুলিও থমথমে আঁধারে ঢাকা। তবুও এরকমই একটি বাড়িতে লোকজনের চলাচল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। হঠাৎই সেই বাড়ির ডোমেস্টিক টেলিফোন বেজে উঠল।
‘রাডিও পারী?’
‘হ্যাঁ বলুন?’
‘আমি ফিলিপ পেতোঁ কথা বলছি।..’
চমকে উঠলেন রাডিও পারীর পরিচালক ও ব্যবস্থাপক জর্জ দুহামেল! কিসের জন্য এই অশীতিপর ৮৪ বছর বয়স্ক প্রধানমন্ত্রী ফোন করেছেন তাঁকে?
অসুস্থ ও মানসিকভাব ভেঙে পড়া পেতোঁ বেশিক্ষণ কথা বলতে পারছেন না, ভেঙে ভেঙে যেটুকু বললেন তার মর্ম হল এই- জার্মানদের অনুপ্রবেশের আগে, রেডিও তে এমনকিছু বাজবে যা ব্যক্ত করবে আমাদের মনের বাণী। বারবার বলছেন আমরা যেন রুচিবোধ বিসর্জন না দিই! কোনো সঙ্গীত কি? নাহ্। দুহামেল মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন কি বাজবে। সেদিন রাত্রে, মুক্তির শেষ আস্বাদ পাওয়া, পারী শহরে বেজেছিল, দুহামেলের প্রিয় বন্ধু আন্দ্রে জিদের অনুবাদ করা বিশ্ববরণ্য কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ডাকঘর’- অমলের গলার রণন, ‘না, কিছু কষ্ট হচ্ছে না, সব তোমাদের দিলুম..’
এর ঠিক সাত বছর পর, জিদ নোবেল পেলেন সাহিত্যে। অনেক দূরে, সুদূর টুনিশিয়ায় বসে সে খবর এল তাঁর কাছে। রবীন্দ্রনাথের থেকেও দূরে সরে গেছেন ততদিনে। প্রথম প্রথম যেভাবে ভূয়সী প্রশংসায় লিখেছেন এবং অনুবাদ করেছেন গীতাঞ্জলি, তা ধীরে ধীরে তখন মিলিয়ে গেছে।
জিদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের লেখার আলাপ করান, ১৯১২র অক্টবর মাসে ২৬ বছর বয়স্ক দিকপাল ফরাসী কবি অ্যালেক্সিস লেজার। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় এমনই সম্মোহনী শক্তি খুঁজে পেয়েছেন তরুণ লেজার যে ইংলণ্ডে কবির সঙ্গে দেখা হওয়ার পরই জিদকে চিঠিতে লিখেছেন:
‘আমার মনে হয়, এই কবিতাগুলির মত আর কিছু আমরা দেখিনি…এ এক অন্যকিছুর উদ্ভব। …..আপনি ‘ন্যুভেল রিভ্যু ফ্রঁসেজ্(দ্য নিউ ফ্রেঞ্চ রিভিউ) থেকে গীতাঞ্জলির ফরাসী অনুবাদের সংস্করণ প্রকাশ করুন, শীঘ্রই.. নাহলে বড্ড দেরী হয়ে যাবে..’ এরপরই ব্যস্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন, অনুবাদের স্বতাধিকার প্রদানের জন্য এবং অনুবাদক ‘ন্যুভেল রিভ্যু ফ্রঁসেজ্’-এর তরুণ সম্পাদক জিদের পরিচয় করাচ্ছেন এইভাবে:
‘আমাদের আন্দ্রে জিদে হল ফরাসী তরুণদের শ্রদ্ধা পাওয়া এক অতীন্দ্র ক্ষমতার লেখক..’ এর পরবর্তী ইতিহাস আমরা জানি- ১৯১৩’র ডিসেম্বরে, ফরাসী গীতাঞ্জলি ‘ল্য অফ্রান্দ লিরিক’ প্রকাশিত হয় ন্যুভেল রিভ্যু ফ্রঁসেজ্ থেকে, জিদের ভূমিকাসহ।
কিন্তু এখানেও রবীন্দ্রনাথকে ব্যবহার করার প্রসঙ্গ তুলেছেন গবেষক গ্যিওম ব্রিদেত ওঁর বই, ‘ল্য ইভেনমো আন্দিয়াঁ দো ল্য লিট্রেচ্যুর ফ্রঁসেজ্’এর(দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান ইভেন্ট অফ ফ্রেঞ্চ লিট্রেচর)এ।
তিনি বলছেন, রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলির ফরাসী অনুবাদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েন তিনটি পত্রিকা – ল্য রিভ্যু, মেরকিউর দো ফ্রান্স এবং ন্যুভেল রিভ্যু ফ্রঁসেজ্। রবীন্দ্রনাথকে চিঠি লিখেও উত্তর পাননি, ল্য রিভ্যুর জঁ রোসেন এবং মেরকিউর দো ফ্রান্সর ঠিক করে দেওয়া অনুবাদক হেনরি দাভিদের বিরুদ্ধে অসভ্যতার নালিশ জানান জিদ স্বয়ং। অবশেষে ন্যুভেল রিভ্যু ফ্রঁসেজ্ই পায় গীতাঞ্জলি অনুবাদের স্বতাধিকার।
কিন্তু ১৯২০র পূর্ববর্তী সময়ে, মেরকিউর দো ফ্রান্স ই ছিল ফরাসী সাহিত্য মহলের এক প্রভাবশালী কন্ঠবাহক। আন্তর্জাতিক মানের, আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গের লেখা প্রকাশিত হত সেখানে। তুলনামূলকভাবে, ন্যুভেল রিভ্যু ফ্রঁসেজ্ নবীণ পত্রিকা- জিদ এর স্থাপন করেন মাত্র ১৯০৮’এ।
তবে কি এর মধ্যে কোনো নিগূঢ় সম্পাদনার অভিসন্ধি ছিল? রবীন্দ্রনাথও কি না জেনে রাজি হয়ে গেলেন?

ব্রিদেত বলছেন লেজার ও জিদ্ ইংরেজ মহলে রবীন্দ্রনাথের এমন সমাদর দেখে তাঁর ক্ষমতাকে ব্যবহার করলেও করতে পারেন। তার কারণ এর পরের বছরই রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাপ্তির পর ন্যুভেল রিভ্যু ফ্রঁসেজ্ এর সম্ভ্রম বেড়ে বেড়ে ১৯২০ তে হয়ে ওঠে গগনচুম্বী। ততদিনে থিয়েটর দু ভিউ কোলোম্বিয়ের-এ একটি গুরুত্বপূর্ণ সভায় জিদ কবির লেখাকে সম্বর্ধিত করে ফেলেছেন। উল্টোদিকে এই পত্রিকায় তাঁর লেখা ছাপা হয়েছে বলে কবি অবলীলায় এক যুগ থেকে আরেক যুগে চলে এলেন- আন্ত:যুদ্ধ চলা কালীন সময়ে তাঁর লেখা পুনরাবিষ্কৃত হতে লাগল অন্যভাবে।
ফরাসী সাহিত্যমহলে সবাই যে খুব খুশি হলেন ভারতীয় কবির নোবেলপ্রাপ্তিতে তা একেবারেই না।গুনার আলস্ত্রোম ‘আ ক্যাত্র ক্যাত্র’ তে লিখলেন বেশ শ্লেষ সহকারে যে ‘তাহলে আমাদের গনক্যুর অ্যাকাদেমীও তো এরকম কিছু চাপিয়ে দিতে পারে, নাকি? কস্যাক কবি, একজন দাহোমিয়ান ঔপন্যাসিক,তাহিতির দার্শনিক – সবাইকেই তাহলে সাধুবাদ জানাতে হয়, নাকি?’
জাতিবিদ্বেষের ঘ্রাণ তখনও যায়নি ফরাসী দেশ থেকে।
কিন্তু কবি তো আর কেবল কবি নন,তার নানা প্রকার সৃজনশীল উপস্থিতি। এইটাই ফরাসীদের মনে ধরল বেশি। তাই তাঁর কবিতা নিয়ে, পিয়ানোর জন্য সুর দিয়ে ফেললেন দারিয়াস মিলহদ, জঁ ক্র্যাস, আন্দ্রে কাপলে, এলসা বারেন প্রমুখেরা। ১৯২৮’এর মে মাসে জিদ প্রথমবার মঞ্চস্থ করলেন ‘ডাকঘর’, তার নাম পাল্টে দিলেন – ‘অমল এ ল্য লেত্র দো রোয়া’(অমল ও রাজার চিঠি)। এই প্রোডাকশন হল দারিয়াস মিলহদের সঙ্গীত পরিচালনায়, থিয়েটর দো ল্য পেতিত সিন্ -এ। ল্য মন্দে বেরোলো – ‘টেগোরের এই নাটক যুগোত্তীর্ণ।‘ ১৯৩৭ এ জর্জ পিয়তোওফ, করলেন থিয়েটর দো মাথুরিন্সএ। পরে ডায়েরিতে লিখলেন- ‘এমন আনন্দ আমি পাইনি বহুকাল..’ ।
আশ্চর্যের ব্যাপার এটাই যে সীমিত সংস্করণ কিছুদিনের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর, ১৯১৩-১৯১৯ এ ন্যুভেল রিভ্যু ফ্রঁসেজ্ আরও ৬৬,০০০ কপি গীতাঞ্জলি বিক্রি করে। ১৯১৩ এ ফ্রান্সের বেস্ট সেলার তালিকায়, গীতাঞ্জলি ছিল একমাত্র বৈদেশিক ও একমাত্র কবিতার বই। তারপর ‘ডাকঘর’ ও ‘চিত্রা’র ফরাসী অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর, তারাই হয়ে ওঠে পরবর্তীকালের বেস্টসেলার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথই একমাত্র বিদেশী লেখক যিনি ১৯১৩ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত, ফ্রান্সের বেস্টসেলার লিস্ট দাপিয়ে বেরিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনরাদ ছিলেন ১৬ টি বইয়ের প্রকাশক, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পেলেন ২৫টি টাইটেল। এই মরশুমেই কবি এলি গব্যার্ত রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করে বই লেখেন আর মরিস চাবাস্ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কবিতা লেখেন এবং সঙ্গে পারিস থেকে একটি চিঠি পাঠান, তাতে লেখেন- ‘আপনাকে আমি পাগলের মতো ভালোবাসি..’
কিন্তু ফ্রান্স কি কবিকে সত্যিই ভালোবাসে আর এখন? প্যারিসে জোয়ান মিরোর বাগানে তাঁর মূর্তি ও তাঁর নামে একটি রাস্তা ছাড়া, তাঁর বড় একটা উপস্থিতি নেই। বইয়ের দোকানে, প্রদর্শনীশালায় খানিক। আমি কেবল ভাবি, সেই রাতটার কথা – যে রাত্রে প্যারিস তাঁর বীর বাসনার অঞ্জলি পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথে।
তথ্য সূত্র: ‘ল্য ইভেনমো আন্দিয়াঁ দো ল্য লিট্রেচ্যুর ফ্রঁসেজ’, গিওম ব্রিদেত,পঞ্চম অধ্যায়
‘লেটারস অফ জর্জ দুহামিল’,ফিলিপ মিচালাক
‘জিদ এ টাগোর’, অ্যান মারি মুলেনেস
‘রবীন্দ্রনাথ টেগোর, নোবেল লরিয়েট’, মঁ ভিগারো
‘লেটারস অফ মরিস চাবাস/ আ ক্রিটিকাল রিডিং..’, লরোঁ বেনে
ছবি: 1. https://shortstorymagictricks.com/2018/03/19/my-mother-by-andre-gide/amp/ https://www.blackswanbooks.com/pages/books/287372/rabindranath-tagore-andre-gide/l-offrande-lyrique-gitanjali
2. https://media.routard.com/image/23/5/photo.1466235.w430.jpg https://www.outlookindia.com/outlooktraveller/travelnews/amp/45508/rabindranath-tagore-in-paris-1921