আশার ‘আষাঢ়’ – সম্পাদকীয়

‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে মেঘমাশ্লিষ্ট সানুং’ –
আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে বিরহ কাতর যক্ষ মেঘ’কে দূত করে অলকায় পাঠিয়েছিলেন তার প্রিয়ার কাছে। যক্ষের সে বিরহ বারতা মেঘদূত যেন সঞ্চারিত করে চলেছে প্রতিটি বিরহ কাতর চিত্তে, যুগ হতে যুগান্তরে।
প্রাকৃতিক নিয়মে গ্রীষ্মের পর আষাঢ় আসার সাথে সাথেই বুক ফাটা ধরণী ভিজে ওঠে স্নিগ্ধতায়।নদীমাতৃক ভারতের নদী ভরে ওঠে, শ্যামল হয় বাংলার মাঠ। প্রকৃতি ফিরে পায় লাবণ্য। আমাদের মনে এই বর্ষা আনে নতুন প্রাণ, এক নতুন স্বচ্ছলতা। বৃষ্টির ফোঁটায় দীর্ঘদিনের জমে থাকা কলুষতা ধুয়ে যায়।
এই আষাঢ় সত্যিই বড়ো আশার। সারাবছর ধরে কৃষকেরা আকাশের মুখ চেয়ে অপেক্ষা করে এই আষাঢ়ের। বিশেষ করে ভারতবর্ষের মতন কৃষিপ্রধান দেশের জীবিকা এবং অর্থনৈতিক ভারসাম্যের অনেকটাই নির্ভর করে এই বর্ষার ওপর।
তবে আমাদের দেশে ঋতু বৈচিত্র থাকলেও, বিশ্ব উষ্ণয়নের প্রভাবে ঋতুর কোনো স্থিরতা নেই। খাতায়-কলমে দেশে বর্ষা এলেও বৃষ্টির পরিমাণ নিয়ে শঙ্কায় দিন কাটান কৃষকেরা। এই খামখেয়ালি বর্ষায় কোথাও যেমন ঝমঝমিয়ে বর্ষণ হয় ঠিক একইভাবে কোথাও আবার বর্ষা মুখ ঘুরিয়ে থাকায় মাঠঘাট খটখটে হয়ে থাকে।


প্রতি বছরেই ভারত তথা বাংলার চাষীরা এই দুশ্চিন্তাতেই থাকেন। তার মধ্যে এই বছর একদিকে অতিমারী অন্য দিকে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আমফনের দাপটে অভাবনীয় ক্ষতি হয়েছে বাংলার চাষীদের। এতে সারা দেশেই ধান ও সবজির সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরী হয়েছে, কারণ পশ্চিমবঙ্গেই ধান ও সবজি সর্বাধিক উৎপাদন হয়, রাজ্য ভিত্তিক সরকারি তথ্য অনুযায়ী। জেলাগুলির মধ্যে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দক্ষিণ ২৪ পরগনা। প্রচুর চাষের জমি তছনছ হয়ে গিয়েছে ঝড়ের তান্ডবে। বেশিরভাগ চাষীরাই ধার নিয়ে চাষ করেন, আবার অনেকে লিজ্-এ পাওয়া জমিতে চাষ করেন। এই বিধ্বংসী ঝড়ের কারণে তারা দিন কাটাচ্ছেন দুশ্চিন্তায় এবং মানসিক অশান্তিতে। সব মিলিয়ে প্রায় ১৭ লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে, যার মূল্য ১৫,৮০০ কোটি টাকা।


এই দূর্যোগের ফলে ক্ষয়ক্ষতির মেরামতই এখনও শেষ হয়নি তার উপর আষাঢ় এসে হাজির আমাদের রাজ্যে। তার সময় মতো প্রতিবছর সে চলে আসে, তবে এবার যেন সাথে নিয়ে এসেছে এক বিষন্নতার সুর। আমরা যা হারিয়ে ফেলেছি সেই স্মৃতি উস্কে দিয়ে মাঝে মাঝেই আমাদের মন কে বিহ্বল করে তুলছে। কিন্তু সেই পুরাতন হৃদয়ের যন্ত্রণা ভুলিয়ে আবার নতুন করে শুরু করার, নতুন করে বাঁচার আশা দিয়ে সে যাবে বলেই সে এসেছে এবার, আবারও।


সেই আশাতেই বুক বেঁধে বলতে ইচ্ছে করে, আজি বর্ষার রূপ হেরি মানবের মাঝে। বৃষ্টিকে ঘিরে বাঙালির মননে যে রোমান্টিসিজম তা যদিও আসে আমাদের প্রাণের কবির লেখনী ধরে, কিন্তু গ্রাম্য জীবনের যে বৃষ্টিস্নাত শস্য শ্যামলা রূপ তা অনেক সময়েই থেকে যায় কবির কল্পনাতেই, বাস্তব যে বড় বেশী রূঢ়, বড় কঠিন। শত আধুনিকতায় মোড়া জীবনযাত্রাও প্রভাবিত হয় বর্ষার ধারায়। তা বেশী হলেও রক্ষা নেই আর কম হলে তো সোজা টান পড়বে ভাঁড়ারে। অনাবৃষ্টিতে সব থেকে বেশী অনাসৃষ্টি ঘটে চাষাবাদে। পর্যাপ্ত জলের অভাবে ফসলের পরিমাণ ও মান দুই হ্রাস পায় বহুলাংশে, ১৩০ কোটি জনসংখ্যার দেশে যা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। অনাবৃষ্টি বা কম বৃষ্টি পাতের ফলে বৃষ্টির জলের উপর নির্ভরশীল খাদ্য শস্য যেমন চাল, সয়াবিন, বাদাম, কিছু প্রজাতির ডাল, বাজরা ইত্যাদির ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হয়, দেশের শস্যভাণ্ডার হয়ে পরে অপ্রতুল। ফলস্বরূপ দেখা দেয় খরা এবং সঙ্গে আসে অনাহারের মত অভিশাপ। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে ৭.৫৯% বৃষ্টির হেরফের হওয়ার জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদন বদল হয় ১৮.৬২%, অর্থাৎ বৃষ্টির অনুপাত কম হলে তা খাদ্যশস্যের ওপর কতটা খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে তা সহজেই অনুমেয়।


এই বছরটি এমনিতেই আমফান, পঙ্গপাল হানা ইত্যাদি নানান সঙ্কটে জর্জরিত, যার ফলে ফসলের ক্ষতিও হয়েছে প্রভূত। তাই অনাবৃষ্টির ধাক্কা সামলানো সত্যিই মুশকিল হবে ভারতবর্ষের পক্ষে। একদিকে লকডাউন চলছিল সেই মার্চ মাসের শেষ থেকে। এই লকডাউন থাকার ফলে আগে থেকেই অনেক ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে ফসল কাটা সম্ভব না হওয়ায় অনেক ফসল জমিতেই নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া এইসময় সুবিন্যস্ত ডিস্ট্রিবিউশনের অভাবেও চাষের বহু ক্ষতি হয়েছে। যোগান ও চাহিদার হিসাবের ভারসাম্য হারিয়ে গেছে। তার উপরে চলেছে ব্যাপক কালো বাজারী। এর ফলেই কৃত্রিম ভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে কিন্তু পাশাপাশি সাধারণ মানুষের আয় কমেছে। অনেক ক্ষেত্রে বহু মানুষের চাকরিও চলে গেছে। তাই, অর্থের যোগান কম থাকায়, বাজার অর্থনীতি স্তব্ধ হয়ে পড়েছে কারণ লোকের ক্রয় ক্ষমতা কমেছে কিন্তু চাহিদা কমেনি, বিপরীতে যোগানও পর্যাপ্ত নয়। এই সব কিছু একত্রিত হয়ে সাধারণ মানুষ এই পরিস্থিতিতে এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। এর পাশাপাশি পরবর্তীতে যদি এ বছর চাষাবাদ ভালো না হয়। তবে, আকাশ ছোঁয়া দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে দেশে অনাহার দুর্ভিক্ষ পর্যন্ত নেমে আসতে পারে।
সেই কারণেই এই আষাঢ় অর্থাৎ বর্ষা এবছরের কৃষি ব্যবস্থার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ ভারতীয় অর্থনীতি মূলত কৃষিভিত্তিক এবং সেই কৃষিব্যবস্থা যেহেতু বর্ষার ওপরে নির্ভরশীল তাই এর থেকে খুব সহজেই বোঝা যায় যে ভারতের অর্থিনীতির ওপরে এই বর্ষার প্রভাবও অপরিসীম। তাই এই বর্ষা কেবল কালিদাস বা রবীন্দ্রনাথেই আটকে নেই, বরং তা ভারতবাসীর এক প্রকার ভাগ্য নির্ধারক।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.