চারিদিকে লকডাউন। এখন যদিও অনেকটাই শিথিল, তবু মানুষের ভীতি ও আশঙ্কা এতো সহজে দূর হওয়ার নয়। অধিকাংশ মানুষই এখনও বাড়িতেই আছেন। তাই এই পরিস্থিতিতে বাইরের জগতের সাথে গৃহবন্দী মানুষের যোগাযোগের একমাত্র অবলম্বন হচ্ছে ইন্টারনেট আর ছোটো করে বললে হাতের মুঠোফোনটাই এখন আমাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সেখানেই চলছে কাজ, গল্পগুজব, আড্ডা আর এখন তো এই ডিজিটাল মাধ্যমই বিনোদনের একমাত্র প্ল্যাটফর্ম। তাই গান শোনা বা সিনেমা দেখা তো আছেই। ফেসবুকে কান পাতলেই গান ভেসে আসছে। আর এই গানই যেন কোথাও একটা আমাদের মনের দূরত্বটাকে বারবার কমিয়ে আনছে। ফেসবুকেই এমন অনেক অনুষ্ঠান হচ্ছে যেখানে ঢাকা লন্ডন নিউইয়র্ক আর কলকাতা মিশে যাচ্ছে সাত সুরের মোহনায়। সেই স্রোতে ভেসে চলা দুই বন্ধুর কারোরই ঘুম আসছিল না রাতে, মনের মধ্যে জমে ওঠা প্রশ্ন গুলো তাই বেরিয়ে এলো ওয়াটস অ্যাপের পাতায়….
– ‘একটা কথা ছিল! ‘
– ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। বল না। ‘
– ‘আচ্ছা, তোমার কি এটা হচ্ছে, গান শোনার ক্ষেত্রে কোনোকিছুই যেন ঠিক মনকে আশ্বস্ত করতে পারছে না?
মানে, এই অদ্ভুত সময়টার কথা বলে, এমন কোনো গান পাওয়া যাচ্ছে না আমাদের আগের Playlist থেকে?
আমার আজকাল কিছুই শুনতে ইচ্ছা করে না। এর মানে কি এরপর নতুন গান লেখা হবে? অন্য কথায় সুরে? আমরা কি একটা যুগের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে?’
– ‘খুব কঠিন প্রশ্ন। তবে এটা একদম সত্যি যে আমরা একটা নতুন যুগের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। এই যে একটা ক্লান্তি আসছে শোনার ক্ষেত্রে, এটার অনেক কারণ আছে। সামগ্রিক ভাবে আমরা বিপর্যস্ত, মানসিক দিক থেকে, অর্থনৈতিক দিক থেকে এবং রোজকার জীবন যাপন এর দিক থেকে। একজন সুরকার বা গীতিকার বা গায়ক বা একজন লেখক, কেউই এর বাইরে নয়। তাই এই যে নতুন যুগ তৈরি হবে সংগীতে সেটা কিন্তু আজকের সময় টাকে অবলম্বন করে। আজকের সমস্ত বিপর্যয় এবং হাহাকার প্রতিফলিত হবে আগামীর সংগীতে, বিষন্নতা আনার জন্য নয়, একটা সুন্দর পৃথিবী তৈরি করার জন্য। আর একটা বড় কারণ হলো, ‘Digital ক্লান্তি’, এই ক্লান্তির জন্যেই নতুন যুগ আসবে সংগীতে। থিয়েটার এর মতোই সংগীত একটা Interactive Immersive আর Imaginative ফর্ম শিল্পের। সেখানে মাধ্যম টা খুব গুরুত্বপূর্ণ, সামনাসামনি না এলে এই তিন টের মধ্যে কোনোটাই সম্ভব নয়। ইউরোপে যেটা অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে, ওরা সব ফর্ম কে ভেঙ্গে নতুন আঙ্গিক তৈরি করছে। আমাদের ও সেই জোয়ার আসছে, এমন দিন আসছে যখন পুরো সংগীত তৈরি করার এবং পরিবেশনার প্রক্রিয়া টাই নতুন রূপে মানুষের কাছে ধরা দেবে এবং সেই কাজের দায়িত্ব আমাদেরই নিতে হবে। তোর কি মনে হয়, নতুন সৃষ্টি হওয়া কতটা জরুরী আজকের দিনে?’
– ‘নতুন সৃষ্টি, এটা খুব ইম্পরট্যান্ট। শুধু তাই নয়, এই Artificial Intelligence এর যুগে, Deep Learning এর যুগে, শিল্প প্রভাবিত হতে বাধ্য। সংগীত, যার প্রকাশ অনেকটাই প্রযুক্তি নির্ভর। আর এখন, যেহেতু কনসার্টে গিয়ে গান শোনার থেকে সবাই মোবাইলে গান শোনার যুগে এসে পড়েছি আমরা, সেখানে যত দিন যাবে, তত নতুন দিক খুলবে।
আচ্ছা একটা অন্য দিকে যাচ্ছি, এটা নিয়ে আমার অনেকদিনের কৌতূহল ছিল, তুমি যখন গানে সুর করো, তুমি তো একটা নতুন জিনিস তৈরি করছ, এবার গানের কথা গুলো কিভাবে ভাগ করো, বা সুর টা কিভাবে বসাও? পেছনের অঙ্ক টা একবার বলেছিলে, আরেকবার একটু বলো তো?’
– ‘গানে তিনটে ব্যাপার খুব গুরুত্বপূর্ণ, সুর, কথা আর ছন্দ। ছন্দ আর তাল কিন্তু এক জিনিস নয়, অনেকে গুলিয়ে ফেলে। একটা তালেরই অনেক রকম ছন্দ হতে পারে। এই প্রক্রিয়া টা খুব সহজ নয়। সুর আগে হলে, সুর আর ছন্দ অনুযায়ী কথা লিখতে হয়, সেখানে অনেক সময় কথার ক্ষতি হয়, ছন্দের বাঁধনের জন্য একটা শব্দ পর পর দুবার বা তিন বার ব্যবহার করতে হয়। এবার যাঁরা বড় সংগীতকার তাঁরা ওই কথার ক্ষতি টা হতে দেবেন না বলে অর্থ মাথায় রেখে এই প্রয়োগ করেছেন। যেমন রবীন্দ্রনাথ এর অনেক গানে এই ব্যাপার টা দেখতে পাই, ‘মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ’, তিন বার ‘আরো’ ব্যবহারে তিনি বুঝিয়েছেন প্রাণশক্তি চাওয়ার কোনো শেষ নেই। ধ্বনি শব্দ বা ‘phonetics’ যা একটা প্ৰাকৃতিক বা অপ্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বোঝাতে ব্যবহার করা হয়, যেমন ‘তা তা থৈ থৈ’ বা ‘ঝর ঝর ঝরণা’ বা ‘ঠুংঠাং ঠুংঠাং চুড়ির তালে’ বা ‘টগবগ টগবগ টগবগ টগবগ ঘোড়া ছুটিয়ে’ এরম অনেক উদাহরণ আছে যেখানে শব্দ কে ছন্দের সাথে মেলানো হয়েছে । তারপরে যোগেশ জির লেখা সলিল চৌধুরীর সুরে, ‘গুজর যায়ে দিন দিন দিন’, এখানে ‘দিন’ শব্দ টা তিনবার এসেছে, কিন্তু এতে বোঝাচ্ছে পর পর দিন পেরিয়ে যাচ্ছে তাই একদম ছন্দ আর সুরের সাথে মিলেমিশে যাচ্ছে। আর যদি কথা আগে লেখা হয়, সেই কথাটা কীরকম ছন্দে আছে সেটা দেখতে হবে, তার পর সেই ছন্দে সুর করতে হবে, যদি অন্য ছন্দে সুর করতে হয় তাহলে কথার ছন্দ বা চলন এদিক ওদিক করতে হতে পারে। আবার যখন একজনই কথা সুর করছে, তখন অনেক সময় একসাথে কথা সুর ছন্দ আসে, বা কিছুটা সুর করে কথা লেখা হয়, বা কিছুটা লিখে সুর করা হয়, তারপর সেই কথা আর সুর এর চলন নিয়ে পরের অংশের সুর আর কথা তৈরি হয়, বহমান ধারার মতো গান সৃষ্টি হয় সেই ক্ষেত্রে।’
– ‘তুই বল, তুইতো অনেক বাজনা শুনিস, নিজেও বাজাস, একটা instrumental piece এর কোন aspect টা তোকে সবচেয়ে বেশি টানে, বা কেন টানে?’
– ‘হাহা, বাজনা শোনা টা বলতে পারো আমার একটু পক্ষপাতিত্ব। আমার যেহেতু রাগ শোনার একটা অভ্যাস আছে, আমার মনে হয় বাজনার মাধ্যমে আমি যেন যে কোনো একটা রাগ কে বেশি স্পষ্ট করে দেখতে পারি।
যদি জিগেস করো Instrumental এর কোন aspect টা আমাকে সবচেয়ে বেশি টানে, তাহলে বলব, রাগের আলাপ। আলাপ রাগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। শুধু কয়েকটা স্বর দিয়ে একটা সম্পূর্ণ রাগকে প্রতিষ্ঠা করা হয় আলাপের মাধ্যমে। মানে, যদি একটা তিন মিনিটের পিস ও হয়, এবং তাতে যদি আলাপ থাকে, তাহলেও ওই তিন মিনিটেই বোঝাতে হবে আমি ইমন শুরু করছি না ইমন কল্যাণ শুরু করছি। এটা আমার খুব fascinating লাগে। অনুষ্কা শংকর এর আমি এক বড় ভক্ত। ওঁর একটা ইমন কল্যাণ আছে, পাঁচ মিনিটের মনে হয়। সেটা একবার শুনলেই বুঝবে আমি কি বলছি।
– ‘আচ্ছা, তাহলে এটার একটা application নিয়ে একটা ব্যাপার বল, এই যে গানের সাথে instrument ব্যবহার করা হয় সেক্ষেত্রে বা interlude prelude এর Musical Perspective টা কেমন থাকে ?’
– ‘খুব শক্ত প্রশ্ন। আমি জানিনা আমি এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য enough qualified কিনা। কারণ, এই নিয়ে যুগে যুগে নানা সংগীতকার নানা মত রেখে এসেছেন, কিন্তু কেউই একটা কমন পয়েন্ট এ পৌঁছতে পারেননি। পৌঁছনো হয়তো সম্ভব না। কারণ, সংগীত এর মতো একটা বিমূর্ত শিল্পমাধ্যমে যে কোনো রকম কম্বিনেশন চলতে পারে তার বিভিন্ন কম্পনেন্টস এর মধ্যে।
কিন্তু, interlude prelude নিয়ে প্রশ্ন করো, তাহলে আমি বলতে পারি, সেটা গানের মেজাজ এর ওপর নির্ভরশীল।
একটা রামপ্রসাদি গানে যেমন interlude হবে, একটা হিন্দি সিনেমার গানে নিশ্চই সেরকম হবে না। আবার একটা Jazz গানে যেমন interlude হবে, রবীন্দ্রসংগীতে তেমন interlude হবে না।
আমার মনে হয়, যাঁরা গান তৈরি করেন, সুর দেন, তারা এই balance টা বুঝেই সেটা করেন।
সিনেমার গানে, যেটা একটা অমূল্য সংগীত ভান্ডার, সেখানের কিন্তু এই interlude prelude এর একটা বড় ভূমিকা আছে, সেই কারণে কিছু গান আমরা কথা ভুলে গেছি, কিন্তু prelude interlude মনে রেখেছি।
হঠাৎ মনে হল, আমরা এই তো কথা বলছি, আজকে তো World Music Day, সেই আশির দশকে প্যারিস এ World Music Day Concert শুরু হয়। CONCERT এর ভবিষ্যৎ কি গো? হল এ টিকিট কেটে গান শুনতে যাওয়ার কি দিন শেষ?’
– ‘ভবিষ্যৎ একদম অন্য রকম হবে। যেমন আগেও বললাম, এমন দিন আসবে যখন এই ‘Digital ক্লান্তি’ মানুষ কে গ্রাস করে নেবে, তখন মানুষ আবার একটু প্রানের আরামের জন্য Interactive ফর্মে ফিরতে বাধ্য হবে। নতুন যুগ আসবে, নতুন সময় আসবে। আর ইনশাল্লাহ, সেই সময় টা পৃথিবীর জন্য খুব সুন্দর হবে। মানুষ পারফরমেন্স এর নতুন সংজ্ঞা তৈরি করবে। যেমন তুই বললি, Artificial Intelligence, Machine Learning, এগুলোর প্রভাবেই নতুন এবং অন্য ধারার ‘creative space’ তৈরি হবে। ঠিক যেমন প্যারিস শহরে একদম অন্য ধারায় ভ্যান গগ এর ছবির প্রদর্শনী হয়েছে। ‘360 degree immersive experience’ তাক লাগিয়ে দেবার মতো অভিজ্ঞতা হয়েছে মানুষের। সঙ্গীতেও সেই ধারা আসবে।’
এই কথা বলতে বলতেই ওরাও কেমন যেন সুর আর সঙ্গীতের সেতু বেয়ে ধীরে ধীরে দেশ কাল সমাজ পেরিয়ে পৌঁছে যেতে থাকলো নতুন এক বিশ্বের নতুন যুগে, যেখানে সুরে সুরে লেখা হবে মানুষের ইতিহাস।