‘ঠাকুর যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন’ – বিশেষ সংখ্যা – শুভ্রদীপ ও নীলিমেশ

তখন লকডাউন সবে শুরু হয়েছে। প্রথম শনিবার।পাড়ায় যে শনি-কালী মন্দিরটা ছিল কাঁসর ঘন্টা বাজলো না। করোনা আর লকডাউনের কারণে মন্দির বন্ধ, শুধু মন্দির নয় পৃথিবীতে সব ধর্মীয় স্থানই ভক্তদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলো। সেই সময় মনে একটা অদ্ভূত অনুভূতি জেগেছিল। মনে হয়েছিল, তবে কি প্রকৃতি ঈশ্বরের চাইতেও বড়ো!ভাবতে গিয়ে দেখলাম আসলে প্রকৃতি’ই হলো ঈশ্বর।প্রাচীন কালে যখন মানুষ আসেনি; তখন শুধু প্রকৃতি’ই ছিল। তারপর মানুষই সেই প্রকৃতির নানা শক্তি কে ঈশ্বর হিসেবে পুজো করেছে। একে একে দেব দেবীর ধারণা গড়ে উঠেছে। কিন্তু সেই অসীম শক্তিশালী অনন্ত অজ্ঞেয় প্রকৃতির সামনে শুধু মানুষ নয়, আজ মন্দির মসজিদ গির্জা গুরুরদ্বুয়ারাকেও নতি স্বীকার করতে হয়েছে।

শুধু যদি ভারত তথা বাংলার নিরিখে বলা যায় তবে, এই করোনা-লকডাউনের কারণেই পয়লা বৈশাখ-অক্ষয় তৃতীয়াতেও বহু দোকান-পাট বন্ধ থেকেছে।মহাদেবও এবার চৈত্রমাসের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে ভিক্ষা পান নি। গুডফ্রাইডেতে বন্ধ থেকেছে চার্চ।ঈদের পরবের দিন কেটেছে ঘরে বসেই। আর আজ স্বয়ং দারুব্রহ্ম’ও বহু কোর্ট কাছারির পর অবশেষে কার্ফু জারি করে ভক্তদের দূরে সরিয়ে রেখেই রথে চড়লেন, গেলেন মাসির বাড়ি।

হ্যাঁ! প্রতি বারের মতো রথের পবিত্র রশি স্পর্শ করা হলো না আমাদের। ওনলাইন ক্লাস, ওয়ার্ক ফ্রম হোম আর ভিডিও কনফারেন্সের মতোই ঘরে বসেই ডিজিটাল প্রণাম জানাতে হলো। মনে মনে একটা খেদ থেকেই গেলো। পুরীর জগন্নাথকেও শর্ত মেনেই রথে চড়তে হলো। কিন্তু, একটু যদি অন্যভাবে ভাবা যায় – যে পাপ আমরা জমিয়ে তুলেছি সেই সঞ্চিত পাপেই আজ পৃথিবীর সর্ব শ্রেষ্ঠ জীবের এই পরিণতি। ঈশ্বরও আমাদের থেকে মুখ ফিরিয়েছেন।আমরা তো কথায় কথায় বলেই থাকি যে,’ঈশ্বর যা করেন, মঙ্গলের জন্যই করেন।’ এটা যদি মেনে নিই, তবে পুরীতে যে আজ বলরাম, সুভদ্রা ও জগন্নাথ তাঁদের সাধারণ ভক্তদের বাদ দিয়েই রথে চড়েলেন, সেটাও হয়তো কোথাও একটা তাঁদেরই ইচ্ছা। তাঁরা হয়তো চান নি; আমাদের সাথে মিলিত হতে। এ কথা শুনে অনেকে হয়তো তর্ক করে বলবেন, ঈশ্বর কখনও ভক্তদের সাথে এমন প্রভেদমূলক আচরণ করতেই পারেন না, তাই তো অবশেষে রথ চলার অনুমতি মিলেছে।কিন্তু, সেক্ষেত্রেও যুক্ত হয়েছে শর্ত। প্রকৃতির সামনে কেউই যে চূড়ান্ত নয় আজ তা আবারও প্রমাণিত হলো। আসলে, ভক্ত যদি দিনের পর দিন তার পরম আরাধ্য ঈশ্বরের বড়ো সাধের পৃথিবীর উপর অত্যাচার করে, পৃথিবীকে ধর্ষণ করে; তবে কি সেই ভক্ত কে ক্ষমা করে আপন করে বুকে জড়িয়ে ধরা যায়? কিছুটা শাস্তি তো সেই ভক্তকে পেতেই হবে।

একটু ভাবুন তো। আমরাই তো হলাম সেই রকম ভক্ত – যারা পুরী তে যাই। জগন্নাথ দর্শণ করি। ভোগ খাই। খাজা কিনি। তারপর! তারপর – বিয়ারের বোতল নিয়ে বসে পড়ি সিবীচে। না যদি মেনেও নিই সেটা অপরাধ নয় কিন্তু, সেই বিয়ারের বোতল বা চিপসের প্যাকেট গুলো কিন্তু ফেলে আসি সেই সমুদ্র সৈকতেই। শোনা যায় যে সমুদ্রেই নাকি প্রথম জগন্নাথ দেবের মূর্তির কাঠ ভেসে এসেছিল। আবার ইসকনের রথ যখন ময়দানে এসে থাকে, প্রতিদিন যখন আমরা যাই, প্রসাদের ঠোঙা গুলো কিন্তু ময়দানেই পরে থাকে। এগুলো কে কি বলবেন? পাপ নয়? প্রাচীন মন্দিরের গায়ে কদর্য ভাবে নিজেদের নাম লিখে আসা! এটাই বা কি? পাপ নয়। আর আমাদের মধ্য থেকেই যারা সেই ঈশ্বর কে ভাগ করেছি! বলেছি পুরীর মন্দিরে বিধর্মী বা দলিতদের স্থান নেই। তখন সেটাও কি পাপ নয়!একটু ভাবুন আমরা ঈশ্বরের নামে যা যা করছি সত্যিই সব কি তিনি বলেছেন? না কি আমরা আমাদের সুবিধা মতো আমাদের কথা তাঁর মুখে বসিয়ে দিচ্ছি।

এই এতো এতো পাপের পরেও আমরা এক্সপেক্ট করছি যে আমাদেরকেও তিনি আপন করে ডেকে নেবেন ওঁনার উৎসবে! কিন্তু ভুলে যাচ্ছি আমাদের ডাকেই যে খামতি থেকে গেছে। তাই, সত্যিই আর কোনো কিছু ঈশ্বর ভালোর জন্য করেন কিনা জানি না, তবে তাঁর এইভাবে দূরত্ব বাড়িয়ে রথ নিয়ে বেরোনোর সিদ্ধান্তটা এবার সত্যিই ভালোর জন্যই হয়েছে। কারণ, সন্তান যখন অন্ধ হয়, বাবা মা’দের দিক থেকে তখন চোখ কান খোলা রাখাটাই বাঞ্ছনীয় – আর ঈশ্বর তো আমাদের সবার অভিভাবক, তাই তাঁর এই সিদ্ধান্ত একজন যথার্থ জগতের ‘নাথ’-এর মতোই হয়েছে, যেখানে তিনি আমাদের দীর্ঘ দিন ধরে তাঁর পৃথিবীর উপর করা বহু অনাচারের জন্য অনুতপ্ত হওয়ার একটা সুযোগ দিলেন। সেখানে তর্ক না করে সেটা কে নত হয়ে মেনে নেওয়াই বোধহয় ভালো। আর এর থেকে আমাদের এই শিক্ষাও নেওয়া উচিৎ যে, সবার উপরে প্রকৃতি সত্য, তাঁর উপরে সত্যিই আর কিছু নেই। তাই আসুন সেই প্রকৃতির কাছে আমরা হাত জোর কে মাথা নিচু করে ক্ষমা চাই। তবেই আজকের এই রথযাত্রা সার্থক হবে – দূর থেকেই ঈশ্বরের রথের চাকার গতিতে আমাদের আগামীও এগিয়ে যাবে এক নতুন দিনে, এক নতুন যুগের অভিমুখে।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.