বন্ধু রাষ্ট্র বলে পাসপোর্ট ভিসার এত কড়াকড়ি নেই । তাও ভ্রমণ কোম্পানির নির্দেশ মেনে আমরা বেশ সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম বিমান বন্দরে । শেষ মুহূর্তে জানা গেছিলো আমাদের এক বন্ধুর পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়েছিল বেশ কয়েক মাস আগেই। কিন্তু কাজের চাপে তাকে আর পুনর্নবীকরণ করা হয়নি । সে কিন্তু বেশ একটা আশঙ্কার মধ্যে রয়েছে । একবার জিজ্ঞেস করলো ” আচ্ছা ও দেশে কি ঢুকতে নাও দিতে পারে বিনা পাসপোর্ট / ভিসা তে ?” এর উত্তর আমাদের কারোরই জানা নেই । অতএব অনিশ্চিতের কথা শিকেয় তুলে আমরা এগিয়ে পড়লাম উড়োজাহাজের দিকে ।
শুরু হলো আমাদের ভুটান সফর ।
পূর্ব হিমালয়ের কোলে প্রায় ৩৯০০০ বর্গ কিলোমিটারের ছোট্ট দেশ ভুটান । উওরে চীন ( বিশেষ অধিকার প্রাপ্ত তিব্বত অংশ ),পশ্চিমে সিকিম, তিব্বতের চুম্বি উপত্যকা, পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ, দক্ষিণে পশ্চিমবঙ্গ আর অসমের মাঝে, এর অবস্থান । পর্বত ঘেরা এই দেশ সবুজ গাছগাছালি, নদী , ঝর্ণার এক অপূর্ব সমাহার । ভুটানের দক্ষিণ দুয়ারের কাছে আমাদের উত্তর বঙ্গের ডুয়ার্স অঞ্চল । সেও এক অপূর্ব জায়গা !!
ছোটবেলায় যেন কোথায় পড়েছিলাম “ভুটান” নাম টা এসেছে ” ভূতের স্থান ” থেকে । এই কথা আমাদের গাইড বাবু কে বলায় তিনি তো হেসেই খুন । অবশ্য পরের মুহূর্তেই বোঝালেন “ভুটান ” বা “ড্রুক” নাম হওয়ার কারণ । দক্ষিণ দিক থেকে দেখলে ভূ -উত্থান অর্থাৎ ” উঁচু ভূমি ” – তার থেকে “ভুটান” । অন্য মতে অবশ্য তিব্বতি শব্দ “বড ” থেকে নাকি “ভুটান” এসেছে । ” বড-অন্ত -স্থান ” অর্থাৎ তিব্বত যেখানে শেষ হয়েছে সেই জায়গা !!! এই সব শুনতে শুনতে আমরা পটাপট কয়েকটা পাহাড়ী নদী পেরিয়ে গেলাম । পারো তে বিমান নামার আধঘন্টা পরে আমরা রওনা দিয়েছি প্রায় ৭০ কিমি দূরে রাজধানী, থিম্পুর পথে । ১৯৬১ সালে থিম্পু রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হয় । জলপাইগুড়ি আর কোচবিহার জেলার মধ্যে দিয়ে বয়ে যাওয়া রায়ডাক নদীর আদিভাগ থিম্পু চু ( নদী ) র পশ্চিম পাড়ে এই শহর ।
ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি নেমেছে অনেক আগেই । হোটেলের কার্পেট মোরা লবি তে বসে ড্রাগন আঁকা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে প্রাণ জুড়োলো । হোটেল টাও বেশ । বিশাল কাঁচের জানালার ওপাশে পাহাড় ঘেরা শহরে মেঘ, কুয়াশা, বৃষ্টি আর রোদের আঁকি বুকি সময়ে সময়ে । বঙ্গ সন্তান আরো অনেকেই এসেছেন । এদের সাথে আলাপ হলো রাতে খাবার টেবিলে ।
পরের দিন ঘুম ভাঙলো ভোর চারটে । মোবাইল ফোনে আগের দিন অ্যালার্ম দিয়েছিলাম সকাল সকাল উঠে প্লেন ধরতে যেতে হবে বলে । সেটা আর বন্ধ করা হয় নি । ঘুম এলোনা আর । হোটেলের লবি থেকে ভুটানের ওপর একটা বই নিয়ে এসেছিলাম । ওটা খুলে বসা গেলো এক কাপ চা বানিয়ে ।
ভুটান হলো এরকম একটি দেশ যা কখনো সে অর্থে পরাধীন ছিলোনা । তবে বিভিন্ন সময় কামরূপ রাজ বা কুচবিহার রাজের হাতে ছিল এর শাসন । ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়েও ভুটান খুব গুরুত্বপূর্ণ । প্রাচীন সিল্ক রুট , যা মধ্য প্রাচ্য , এশিয়ার একটা বড় অংশ , ভারত হয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া অবধি বিস্তৃত ছিল , তার মাঝেই ভুটান একটু একটু করে গড়ে উঠেছিল সেই ২০০০ খ্রীস্টপূর্ব থেকে । তবে বৌদ্ধ ধর্মের বিশেষ ভূমিকা ছিল এই দেশ গঠনের পিছনে এবং সেই অর্থে নাগাঙ নামগয়াল নামে এক বৌদ্ধ সাধুকেই ভুটানের স্থপতি বলে মানা হয় । ১৯০৭ এর পর থেকে রাজশাসনের অধীনে আসে ভুটান । কিন্তু কোথাও একটা ধর্মীয় অনুশাসন, নির্ভরতা থেকেই যায় । মনে পড়লো , আমাদের গাইড বাবু বলছিলেন, ভুটানে যে দূর্গ ( Dzong ) গুলো আছে সেখানে প্রশাসনিক এবং ধর্মীয় আচার ও পঠন পাঠনের ব্যবস্থা দুটোই থাকে । অর্থাৎ এই দুটো দিক সমান ভাবে গুরুত্ব পায় ।
রোদ ঝলমলে আরেকটা দিন শুরু হলো । আমরা বেরিয়ে পড়লাম প্রাত:রাশ সেরে।প্রথমে পৌঁছনো গেলো Simtokha Dzong । নাগাঙ নামগয়ালের তৈরী এই দূর্গ একটা ছোট পাহাড়ের ওপর । কি সুন্দর কাঠের কাজ বিভিন্ন জায়গায় । আর সবচেয়ে সুন্দর হলো খোর লো অর্থাৎ প্রার্থনা চক্র । প্রচুর বয়স্ক লোকজন দেখলাম এদিক ওদিক বসে । সবার হাতেই একখানা করে কাঠের তৈরী জপযন্ত্র । ফেলুদার গপ্পো ” যত কান্ড কাঠমান্ডু” তে এই যন্ত্রের মধ্যে ভেজাল ওষুধ পাচার হতো আর লালমোহন বাবু LSD’র নেশায় এটাই ঘোরাতে ঘোরাতে বলেছিলেন ” ওম মানি পদ্মে হুম… .হুমকি”!!!! নিজের মনেই একবার সাধুবাদ দিলাম!

আবার গাড়ির পথ । এবার Thimphu Chorten বা বৌদ্ধ স্তুপ | সাঁচি সারনাথের স্তুপ দেখে থাকলে বোঝা যায় স্থাপত্য রীতি তে অনেক মিল । কিন্তু এই স্তুপ তৈরী হয়েছে ৭০ এর দশকে ভুটানের তৃতীয় রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুক এর স্মৃতিতে । থিম্পু শহরের মোটামুটি দক্ষিণ ঘেঁষে এই জায়গা । সারাদিন ভিড় লেগেই আছে। প্রার্থনা চলেছে ভাব গম্ভীর পরিবেশে ।
এর পরে যেখানে যাওয়া হবে সেটা হলো Buddha Point । এখানে রয়েছে বুদ্ধদেবের প্রায় ১৭০ ফুট উঁচু মূর্তি । ছোট,বড় প্রায় ১২৫,০০০ বুদ্ধ মূর্তির উপরে উপবিষ্ট বড় মূর্তি টি । সামনে একটা বিশাল আঙিনা যেখান থেকে দেখা যায় প্রায় গোটা থিম্পু শহর টাকে । ছবি তোলার সময় এখানেই আলাপ হলো কলকাতার বালীগঞ্জ প্লেসের বাসিন্দা চ্যাটার্জি দা আর বৌদির সাথে ।হায়দ্রাবাদের হুসেনসাগরে বসানো বুদ্ধ মূর্তির প্রায় তিন গুন আকারের দর্দেনমার এই মূর্তি দেখে চ্যাটার্জি দা’র মাথায় প্ল্যান ঢুকেছে পরের বার পাড়ার পুজোয় এটা থিম বানানো যায় কিনা । ব্যাস ! কাছে, দূরে, শুয়ে , বসে , উপরে উঠে , নীচে নেমে ছবি তোলা চলতে লাগলো । বৌদি ব্যাজার মুখে ছাতা মাথায় এক কোনায় দাঁড়িয়ে । আমাদের সাথে আলাপ হওয়াতে স্বস্তি পেলেন খানিক ।
পাহাড়ের গা বেয়ে গাড়ি নীচে নামতে শুরু করলো । প্রতি বাঁকের মুখে একবার পিছন ফিরে তাকাই । একটু একটু করে অদৃশ্য হতে লাগলেন ধ্যানস্থ শাক্যমুনি । এবার যাত্রা Motithang এর চিড়িয়াখানার দিকে; কিন্তু তার আগে খাওয়া দাওয়া সারবার জন্য আমাদের গাড়ি এসে দাঁড়ালো থিম্পু শহরের মাঝে যেখানে প্রচুর দোকান, অফিস এসব আছে । এতো এতো গাড়ি, কিন্তু রাস্তা পরিষ্কার, ঝকঝকে । পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে সিঁড়ি তৈরী হয়েছে ওপর থেকে নীচে নেমে আসবার জন্য। আসে পাশে প্রচুর ফুল গাছ আর পাহাড়ী লতা । একটা বিশাল সিমেন্ট বাঁধানো বেদি রয়েছে সেখানে প্রতিদিনই কিছু না কিছু অনুষ্ঠান হয় । গান- বাজনা -নাচ এই সব । লোকজন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে , পাঁচিলের ওপরে পা ঝুলিয়ে বা সিঁড়ি তে বসে সেসব শোনে বা দেখে ।
ভুটানি খাবার দাবার ও বেশ লোভনীয় । কলকাতায় বসে আমরা সাধারণত যে চীনে বা নেপালি খাবার খাই অর্থাৎ চাউমিন, মোমো, ডিমসুম, টোফু, নানা ধরণের সুপ্ এসব তো আছেই এছাড়া আছে Ema Datshi যা কিনা পাহাড়ী চিজ , নানারকম সবজি আর লঙ্কা দিয়ে বানানো হয় আর খেতে হয় লাল চালের ভাত দিয়ে। আমার ভাই অনিন্দ্য, খাদ্য রসিক। সাধারণত কোনো নতুন খাবার মুখে পোরার আগে অনিন্দ্য প্রথম সেটা চেখে দেখে । এক্ষেত্রেও তাই হলো । আমরা সব্বাই চেয়ে আছি ওর মুখের দিকে ! মুখ নাড়ে, কোনো কথা বলে না । কি রে বাবা, হলো কি! পরের মুহূর্তেই একটা স্বর্গীয় হাসি ।আসলে ভুটানি খাবারের মধ্যে লঙ্কা আর চিজ এই দুটো থাকবেই থাকবে; আর এই দুটোর মিলনে তৈরী হয় একটা “কেয়া বাত” ধরণের স্বাদ! এছাড়া Jasha Maroo( খুব ঝাল মুরগির কারি ) আর Goen Hogay ( শশা দিয়ে তৈরী সালাদ ) বাঙালি জিভে ভালো লাগবার মতো খাবার । কেক , পেস্ট্রি , চকলেট এর খুব ভালো দোকান আছে এবং তার স্বাদ ও অপূর্ব ।
এবার গাইড বাবু আমাদের গাড়িতে চড়েছেন । চলেছি সেই অভয়ারণ্যে যেখানে ভুটানের জাতীয় পশু তাকিন (Takin) দের বসবাস । মজার গপ্পো শোনাচ্ছিলেন তাকিন দের সম্পর্কে আমাদের গাইড বাবু । সেই কবে নাকি এক তিব্বতি সাধু গরুর কঙ্কালে ছাগলের মাথা জুড়ে বানিয়েছিলো এই প্রাণীকে । তাদের বংশ বৃদ্ধি হয়। একটা জায়গায় আটকে রাখা হতো তাকিনদের । কিন্তু রাজামশাইয়ের মনে হলো এই নিরীহ তাকিন দের ঘর বন্দি করা ঠিক নয় । হুকুম হলো ছেড়ে দাও ওদের । এবার অন্য বিপদ । তাকিনরা থিম্পুর রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে খাবারের খোঁজে । ভয় পায় মানুষ গুলো কে । আক্রান্ত হয় থেকে থেকে । আবার রাজাদেশ – অভয়ারণ্য তৈরী করো ওদের জন্য । এভাবেই তৈরী হয়েছিল এই জায়গা । চারদিকে কুয়াশা ঢাকা সবুজের মধ্যে তাকিন , বন্য শুয়োর , হরিণ আর প্রচুর পাখিদের বাস । তাকিনের দিকে তাকিয়ে চ্যাটার্জিদা হঠাৎ বলে উঠলেন “হাঁস ছিল, শজারুও, (ব্যাকরণ মানি না), হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না”
দুটো তাকিন ছানা বেড়ার ধারে এসেছিলো বৌদির হাতে ধরা চীনাবাদাম এর লোভে । চ্যাটার্জি দা’র গলা শুনে থমকে গেলো তারা!
বিকেল বেলায় হোটেল পৌঁছে সেই ভয়ঙ্কর খবর টা পাওয়া গেলো কলকাতা থেকে আসা একটা ফোনে।
নেপাল, ভারত, চীন ও বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হয়েছে। আমার যে আত্মীয় ফোন করেছিলেন তিনি এতক্ষন ধরে আমাদের ফোন না পেয়ে বেশ দুর্ভাবনায় ছিলেন । আর সেটা হওয়া স্বাভাবিক । যেখানে আসে পাশে সব দেশ দুলছে, সেখানে কি আর ভুটান বাদ পড়েছে ….. !!! অনিন্দ্য কলকাতার প্রথম সারির খবরের কাগজে কাজ করে । কানে ফোন আর ল্যাপটপে চোখ লটকে পড়ে রইলো সারা সন্ধ্যে । রাতের খাবার টেবিলেও একই আলোচনা । চ্যাটার্জি দা এক ভুটানি ওয়েটার কে প্রশ্নবানে জর্জরিত করে তুললেন ।
“ইহা পে ভূকম্প হোতা হ্যায়? কবে শেষ বার হুয়া থা? “
ওয়েটারের মুখে শিশুসুলভ হাসি!!
পরের দিন সকালটা বেশ মেঘলা! কেমন যেন দুঃখী দুঃখী । দু’চার খানা ধার করা ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা । প্রথমেই পৌঁছলাম ভুটান রাজের প্রাসাদ Tashichho Dzong এ | ১৯৫২ সাল থেকে পাকাপাকি ভাবে এখানে রাজার দপ্তর খানা , বাস ভবন । ঢোকার মুখে রাজা বা রানী’মা খান ১০ গাড়ি নিয়ে কোথায় বেরোলেন । তার সম্মানে আমাদের গাড়ি রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়লো । সব দেশেরই এক অবস্থা । এঁরা ভি আই পি — ভগবান ইন পারসন ! গাইড বাবু বললেন ভুটানে নাকি জাতীয় সুখ সূচক ( Happiness Index) প্রবর্তন করেছেন রাজামশাই, মানুষের সুখ, আনন্দ মাপবার জন্য । অর্থনীতিবিদরা বলেন দেশের সমৃদ্ধি পরিমাপের অন্যতম সূচক হলো জাতীয় উৎপাদন ( Gross National Product) । রাজা সে কথা মানতে নারাজ । এর জন্য নাকি আলাদা সুখ সমৃদ্ধি দপ্তর রয়েছে । সত্যি এভাবেও যে ভাবা যায় সেটা এই ছোট্ট দেশ দেখিয়ে দিয়েছে । সাম্প্রতিক কালে রাষ্ট্রপুঞ্জ এই ভাবধারা কে সমর্থন করে বলেছে ” recognizing that the gross domestic product does not adequately reflect the happiness and well-being of people, and that the pursuit of happiness is a fundamental human goal” |
এর পরের জায়গা দুটো আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হলো । প্রথমটা হলো জাতীয় আর্ট স্কুল । এখানে শেখানো হয় ১৩ টি দেশজ হস্ত শিল্পের কাজ । তার মধ্যে ছবি আঁকা, ভাস্কর্য্য তো আছেই সঙ্গে আছে কাঠ খোদাই , সেলাই এরম আরো আরো অনেক কিছু যা না দেখলে ভুটান যাওয়া অসমাপ্ত থেকে যায় । সঙ্গে ক্যামেরা নিয়ে যাওয়া খুব দরকার । স্মৃতিবন্দি করার মতো জিনিস এদিক ওদিকে অসংখ্য। আর যেটা ভালো লাগবে , তা হলো কোনো শব্দদূষণ নেই ।
একই রকম অনুভূতি হলো টেক্সটাইল মিউজিয়াম এ গিয়ে । এখানে রয়েছে ভুটানের বস্ত্র সম্ভারের এক বিপুল সচিত্র ইতিহাস । পুরুষদের পোশাক হলো gho আর তার সঙ্গে kabney ।এই kabney’র রং দেখে বোঝা যায় কার পদমর্যাদা কি বা তিনি কি কাজ করেন ।মেয়েদের পোশাক অনেক ধরণের যার মধ্যে প্রধান হলো Kira আর Toego |
ভুটান এসেছি তিন দিন হয়ে গেলো । আজ চতুর্থ দিন সকালে থিম্পু কে গুডবাই বলে আমরা বেরিয়ে পড়েছি পুনাখার উদ্দেশ্যে । একসময় এই পুনাখা ছিল দেশের রাজধানী ।প্রায় তিন ঘন্টার রাস্তা । কুয়াশা আর মেঘ পালা করে ঢেকে রেখেছে চারিদিক ।মাঝপথে দোচুলা (Dochula) তে গাড়ি থামলো | দোচুলা থেকে হিমালয় পরিষ্কার দৃশ্যমান হয় । এখানে রয়েছে ১০৮ ছোটো বড় স্তুপ । এক অদ্ভুত নৈঃশব্দ ঘিরে রেখেছে চারপাশ । গুটি গুটি ঢুকে পড়া গেলো কাঁচে মোর| রেস্টুরেন্ট এ । বিশাল চিমনির গা ঘেঁষে টেবিল সাজানো । গরম গরম চা আর তার সাথে নানা খাবার ।চিকেন মোমো খেয়ে আমরা সবাই বেশ পুলকিত ।
আবার পাহাড়ী পথে এঁকে বেঁকে যাত্রা শুরু । বেলা ১১ টা নাগাদ পৌঁছনো গেলো Chimi Lhakhang | কথিত আছে ১৪৯৯ খ্রীষ্টাব্দে লামা দ্রুকপা কুনলেই এর স্মৃতি তে তাঁর এক ভাই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন যেখানে সবাই যায় উর্বরতার প্রার্থনায় । রাস্তা থেকে এই মন্দির প্রায় আধ ঘন্টার হাঁটা পথ । ধান ক্ষেত পেরিয়ে, পুকুর পার ঘেঁষে, কারো বাড়ির উঠোন ডিঙিয়ে, দাওয়া ছুঁয়ে তার পর পাহাড়ের গায়ে ধাপ কাটা সিঁড়ি বেয়ে ওঠা । অনেকেই বসে পড়লো ধান ক্ষেতের আলে । ” আপনারা ঘুরে আসুন মশাই। আমরা একটু জিরিয়ে নি”।
হলুদ রঙা মন্দিরের ছাদ অনেক দূর থেকেই চোখে পড়ে । ভিতরে লামা’র কাঠের মূর্তি । বেশ মন্ত্র পড়া চলছে । সবে ভেতর থেকে বাইরে এসেছি , ব্যাঙ্ক চাকুরে তাপস বাবু প্রায় লাফ দিয়ে উঠলেন ” ওরে বাবা মাটি কাপঁছে যে – ভূ – ভূ ভূমি ভূমিকম্প – বুঝতে পারলেন কিছু ?? ” আমারও যে মনে হয়নি তা নয় । ভাবলাম বুঝি এতো হাঁটাহাঁটি করাতে পা কেঁপেছে । তড়িঘড়ি নিচে নেমে এলেম । আমাদের দল কে তখনো দেখা যাচ্ছে না ; কিন্তু একটা পরিচিত গলা পাচ্ছি । সে গলা সুরে বলছে । পৌঁছে দেখি চাটার্জিদা গান ধরেছেন ” আজ ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায় ..”
“আপনি এদিকে রৌদ্র ছায়ার খেলা দেখছেন ওদিকে তো ভূমিকম্প।..টের পেয়েছেন তো? “
চ্যাটার্জিদা উদাশমুখে বৌদিকে দেখিয়ে বললেন ” উনি আসে পাশে থাকলে এমনিতেই আমার পায়ের তলার মাটি কাঁপে – ভারত , ভুটান যেখানেই হোক ” !!!
ভাগ্যিস খুব খিদে পেয়েছিলো । কথা না বাড়িয়ে আমরা গুটি গুটি পায়ে খাবার জায়গার দিকে এগোলাম ।
গাড়িতে বসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম । হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতে দেখি আকাশে বেশ মোলায়েম রোদ । একটা নদীর পার ঘেঁষে চলেছি আমরা । পাহাড়ী নদী যেমন হয়। পাথরের গা ঘেঁষে , কখনো ঝর্ণার মতো হয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চলেছে সে । দূরে দেখা যাচ্ছে একটা প্রকান্ড প্রাসাদ । ওটাই Punakha Dzong | পু চু আর মু চু – আদতে বাংলায় যার মানে সঙ্গী আর তার সঙ্গিনী নদী – তাদের সঙ্গম স্থলে দাঁড়িয়ে এই বিশাল ঐতিহাসিক সৌধ । ১৬৩৭ থেকে ১৯০৭ এখানেই ছিল রাজধানী। ২০১১ সালে ভুটান রাজ জিগমে খেসার নামগিয়েল ওয়াংচুকের বিবাহ অনুষ্ঠান এই Dzong এই হয়ে ছিল মহা ধুম ধাম করে ।
আমাদের থাকার জায়গাটিও খুব সুন্দর । একপাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদী । লন এর দেয়াল ডিঙোলেই নুড়ি পাথরে মোড়া নদীর পার। বর্ষা কালে এ সবই থাকে জলের তলায় । সেদিন সন্ধ্যেবেলা নামলো বৃষ্টি । নিঝুম রাত্তিরে ঝোড়ো বাতাসের শব্দ শুনতে শুনতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানিনা ।
পরের দিন সকালে উঠে দেখি “বাদল গেছে টুটি ” । প্রাত:রাশ খেয়ে বেরিয়ে পড়া গেলো । গাড়ি যেখানে থামলো সেখান থেকে একটা কাঠের সাঁকো পেরিয়ে ঢুকতে হলো দূর্গের ভিতরে । নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে নদীধারা । কাঠের বিশাল তোরণ পেরিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম দুর্গের ঠিক সামনে । শান্ত পরিবেশে মিঠে হাওয়ায় উড়ছে বৌদ্ধ বাণী লেখা নিশান Lung Ta বা Darchog । ধর্মীয় বিশ্বাস যে হাওয়ায় ভেসে গৌতম বুদ্ধের বাণী দিক থেকে দিগন্তে ছড়িয়ে যায় । Dzong র পিছনে জায়গাটা আরো সুন্দর । একটা দীঘি ঘিরে রয়েছে, তাতে কাকচক্ষু জল । ধারে ধারে ফুটেছে বহু ফুল । হাওয়া এসে তাতে স্রোত – তরঙ্গের আঁকি বুঁকি কেটে যাচ্ছে। বৌদ্ধ প্রার্থনার একটা অদ্ভুত সুর আছে । গত কয়েকদিনে বিভিন্ন জায়গায় এই সুর কানে বেজেছে । এখানেও তাই । ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকা যায় । নিজেকে অনুভব করা যায় নিজের মতো করে !! কিন্তু সময়ের অনুশাসন মানতেই হয় । প্রায় দু’ঘন্টা সময় কাটাবার পরও মনে হচ্ছিলো যদি থেকে যাওয়া যেত আরো খানিক ।
আমরা সফরের পঞ্চম দিন শুরু করেছি । গাড়ি ছুটে চলেছে পারোর দিকে । পেরোতে হবে প্রায় ১৪৩ কিলোমিটার রাস্তা, সময় লাগবে সাড়ে তিন ঘন্টার কাছা কাছি ।
গাইড বাবুর সাথে কথা বার্তায় বোঝা গেলো, ফুন্টশোলিং দিয়ে আসা যাওয়া আজকাল আরো সহজ হয়ে গ্যাছে । সেক্ষেত্রে কলকাতা বা শিলিগুড়ি থেকে সড়ক পথে পৌঁছনো যায় সীমানা সংলগ্ন এই শহর হয়ে ভুটানে । আর যেহেতু ভারতীয় মুদ্রা এখানেও চলে অতএব দোকান বাজারেও অসুবিধে হয় না ।
পারো তে পৌঁছে দুপুরের খাওয়া দাওয়া সেরে আমরা পৌঁছে গেলাম Kyichu Lhakhang | সপ্তম শতাব্দী তে তিব্বত রাজ Songtsen Gampo বানানো এই মন্দির হলো দেশের সীমানা সুরক্ষিত রাখবার জন্য বানানো ১০৮ মন্দিরের অন্যতম । এরপরের জায়গাটা খুব আকর্ষণীয় । ভুটানি হস্ত শিল্ম্পের বাজার । অনেক জিনিসের মধ্যে যেটা আমি খুঁজে পেলাম সেটা হলো বৌদ্ধ প্রার্থনার একটি সিডি । আগেই বলেছি এই সুর কয়েকদিন ধরেই শুনেছি; এবার হাতে পাওয়া গেলো।
সন্ধ্যা হয় হয়, আমরা এসে পৌঁছলাম আমাদের থাকার জায়গা Hotel Olathang এ। ১৯৭০ সালে তৈরী হয়েছিল এই হোটেল রাজ অতিথিদের আবাস স্থল হিসেবে।জায়গাটা পারো শহরের একটু উঁচুতে – সবুজের কোলে । ভেতরে ছোট ছোট এক কামরা দুই কামরার কাঠের তৈরী কটেজ । একটু পুরোনো দিনের ছাপ ; কিন্তু সব মিলিয়ে একটা অসাধারণ পরিবেশ । সারাদিনে পরিশ্রম গেছে । রাতে খাওয়া দাওয়া সেরে অনেকে মিলে বেশ খানিক্ষন আড্ডা দেওয়া গেলো । প্রাধান্য পেলো ভূতেরা । কারণ এইরকম একটা গা ছম ছম করা পরিবেশে তাঁদের উপস্থিতি একেবারেই অস্বীকার করা যায় না , উচিত ও নয় !!
ভুটানে রাজা মশাইয়ের ছবি ছাড়া আর যে ছবি বেশী দেখা যায় তা হলো Taksang Monastery (Tiger’s Nest Temple) | কথিত আছে তিব্বতি গুরু Rinpoche বাঘিনীর পিঠে চেপে পৌঁছেছিলেন এই মন্দিরে এবং ধ্যান মগ্ন হয়েছিলেন ।প্রায় ৩,১২০ মিটার উঁচুতে এক পাহাড়ের চূড়োয় দাঁড়িয়ে Tiger’s Nest। পাহাড়ের নীচ থেকে দুঘন্টা লাগে হেঁটে ওপরে পৌঁছতে । হেঁটে চলা পথের আশে পাশে সবুজের মহা সমারোহ ; মাঝে মাঝে পাহাড়ী ঝর্ণার এঁকে বেঁকে চলা । বিশ্রামের জায়গা রয়েছে । বসে জিরিয়ে একটু কফি খেয়ে আবার এগুনো । আস্তে আস্তে পৃথিবীর সব শব্দ যেন হারিয়ে যায় । শুধু শোঁ শোঁ বাতাসের সঙ্গে লাল, সবুজ, হলুদ, সাদা নিশানের ওড়াউড়ি ।রাস্তার শেষ অংশ বেশ খাড়াই । প্রায় ৬০০ সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে আবার ২০০ সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠা । পাহাড়ের গায়ে ধাপ কেটে কেটে তৈরী হয়েছে এগুলো । ফিরতি পথে এটাই উল্টো হবে এবং সে পরিশ্রম আরো বেশি !!!
মন্দিরের ভেতরে সব থেকে সুন্দর লাগে কাঁচে মোড়া সেই ঘরটা । ভেতরে সারি সারি প্রদীপ জ্বলছে । প্রয়াত প্রিয়জনের কথা মনে করা আর তার উদ্দেশ্যে জ্বালানো প্রদীপের আগুন । সুগন্ধ ভরে রেখেছে ঘরের ভেতর ।দরজা খুললে বাইরের ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পরে এক ঝলক আর ফিরে আসে মন কেমন করা সেই গন্ধ। এবার ফেরার পালা ।
দূরে পাহাড়ে বৃষ্টি নেমেছে । পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণার পাশে সেই কাঠের সাঁকো টা পেরিয়ে গেলাম । ভুটান যাত্রা শেষ হবে এবার।রাতে নামলো মুসল ধারায় বৃষ্টি । ডাইনিং হল সংলগ্ন লাউঞ্জে জড়ো হয়েছি সব্বাই আমরা ।নিজেদের মধ্যে গপ্পো আড্ডায় জমে গেলো বেশ । তাপস বাবুর মন খারাপ, আর দু’দিন পর আবার অফিস যেতে হবে। চ্যাটার্জি দা দরাজ গলায় রবীন্দ্রসংগীত শোনালেন।
সুখী সূচকের পরিমাপ কি জানিনা।তবে ভুটানের ওই কয়েকটা দিন আজও মনের মাঝে উজ্জ্বল স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেছে।
লেখক পরিচিতি: কলকাতাতেই জন্ম ও বেড়ে ওঠা। পড়াশোনা শুরু পাঠভবন স্কুলে।তারপর কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ , ও পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। চাকরি সূত্রে এই মুহূর্তে Peerless Group এ । Finance নিয়ে পড়াশোনা, চাকরি। কিন্তু সাহিত্য ও সংগীতের প্রতি প্রবল অনুরাগ ছোট থেকেই। আর সুযোগ পেলেই বেড়াতে যাওয়া আরো একটি নেশা। Finance নিয়ে লেখার সঙ্গে কখনও, ছোট গল্প,কবিতা,পুরনো কলকাতাকে নিয়ে লেখা বা ভ্রমণ বিষয়ক লেখাও লিখে থাকেন। এছাড়া আরো একটি পছন্দের বিষয় হল রম্যরচনা।

© Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.
Image Courtesies : 1. https://images.app.goo.gl/macAf3E2CjTMPnUf8