‘হাসি চাই গো হাসি? হরেক রকম হাসি…. হাহা হাসি, হোহো হাসি, হিহি হাসি, মিচকে হাসি, মুখ টিপে হাসি, ব্যাঁকা হাসি, ফিচেল হাসি…. সবরকম হাসি পাবে গো আমার ঝুলিতে … কি গো বাবু, ও মাসিমা দেবো নাকি এট্টুখান হাসি?’
‘ও বাবা এ যে দেখি মালতী! তুই যে দেখছি পসরা সাজিয়ে ফেলেছিস! রঙ বেরঙ-এর ঝুলি.. তাতে আবার দামের স্টিকার… করেছিস কি?’
‘কি করব গো সরকার দিদি.. লকডাউনের বাজার.. খেয়ে পড়ে তো বাঁচতে হবে বল.. তো দেখলুম এইটিই এখন কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না কো .. তা দেবো নাকি গো এক ঝুলি? নাকি এও তোমাদের অনলাইন না কি যেন তাতে কিনবে?’
‘বড় বাজে বকিস তুই। দে দেখি অল্প করে দে …’
না এই কথোপকথন নিতান্তই কাল্পনিক হলেও মনে হয় না আমরা সত্যিই হাসতে ভুলে গেছি? কি অসম্ভব বিষণ্ণতা চারদিকে, অসুখী, অতৃপ্ত মুখের সারি, আক্ষেপ, অবসাদ এখন প্রায় শতকরা আশি শতাংশ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী। অনাবিল হাসি, অকারণ আনন্দ আজ খুঁজে পাওয়া ভার। আমরা স্বার্থ ছাড়া আনন্দ পাই না, শৈশবও আজ মাপা হাসি, মাপা কথার ডিসিপ্লিনে আটকে। হাসার সময় কোথায়? কি বললে? হাসি মন ভালো করে? শরীর সুস্থ রাখে? ঠিক আছে তাহলে কর্নার পার্কের নতুন লাফিং ক্লাবটায় জয়েন করি নাহয়?
ভাবলে অবাক লাগে, ভারতবর্ষ আজকে পৃথিবীর সবচেয়ে অসুখী দেশগুলির মধ্যে একটি। ২০২০ সালে ইউনাইটেড নেশনস্ এর র্যাংকিংএ ১৫৬ টি দেশের মধ্যে ভারত আছে ১৪৪ নম্বরে। ২০১৮ সালের WHO এর সমীক্ষায় সবথেকে বেশী মানসিক অবসাদগ্রস্ত দেশটির নামও ভারতবর্ষ যেখানে জনসংখ্যার ৬.৫% মানুষ এই রোগের বশবর্তী। সবথেকে যা আশ্চর্যের তা হল এই বাংলা, যাকে বিশ্বমানের হাস্যরসাত্মক সাহিত্য, গান, সিনেমা, কবিতার পীঠস্থান বলা যেতে পারে, সেইখানে এই শিল্প আজ অবনমিত হয়ে কিছু চটুল জোক ও মিম এ কুক্ষিগত হয়েছে। আমরা এখন এক দল ‘হুঁকো মুখো হ্যাংলা, বাড়ী তার বাংলা, মুখে তার হাসি নেই, দেখেছ?’
বাংলা সাহিত্যে হাসির ইতিহাস বহু পুরোনো। এই স্বল্প পরিসরে তা সম্যক ব্যক্ত করাও অসম্ভব। তবে তার ব্যপ্তি ও গভীরতা অপরিসীম ও কালজয়ী। তাই ১৮৬৯ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের লেখা ‘ভ্রান্তিবিলাস’ নাটক অনায়াসে সিনেমায় রূপান্তর পায় ১৯৬৩ সালে এবং যা আজও সমান ভাবে হাসির উদ্রেক করবেই। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়এর ব্যাঙ্গাত্মক সত্যি ঘটনার অবলম্বনে রচনা ‘মুচিরাম গুড়ের জীবন চরিত’ ও সহজেই জায়গা করে নেয় লঘু চালে সমাজের গুরু বিষয় গুলি পরিবেশন করার জোড়ে। কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের হাস্যগীতি বা ব্যঙ্গগীতিগুলিও যথেষ্ট জনপ্রিয় কবির অন্যান্য সিরিয়াস বা দেশাত্মবোধক রচনার সাথে।
আর আমাদের বিশ্বকবি? হাস্যরসে উনিও কম যান নাকি? নির্মল কৌতুক ও ব্যঙ্গাত্মক রচনাতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তাঁর হাস্যকৌতুক গ্রন্থে সংকলিত গদ্য হোক বা নাটক, উপন্যাসে ব্যবহৃত হাস্যরস তাঁর ব্যপ্তি চিনিয়ে দেয় বারবার – তাসের দেশের চ্ছক্কা পঞ্জা, বাল্মিকী প্রতিভার প্রথম দস্যু অথবা চিরকুমার সভার সেই গান–
‘কতকাল রবে বল ভারত রে
শুধু ডাল ভাত জল পথ্য করে
দেশে অন্ন জলের হল ঘর অনটন
ধরো হুইস্কি সোডা আর মুর্গী মটন’।।
আর ইওরোপ যাত্রীর ডায়েরিতে পাঠকের সামনে নিজেকে নিয়ে নিরন্তর মজা করার যে অনায়াস দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন তা একমাত্র তাঁর পক্ষেই সম্ভব।
পরবর্তীকালে আমরা এমন একজন লেখককে পাই যিনি হাসির সাহিত্য-জগতে এনে দিয়েছিলেন এক অন্য মাত্রা। ঠিক ধরেছেন, শিবরাম চক্রবর্তীর কথাই বলছি। মানুষটি ব্যক্তিগত জীবনে শত কষ্টের মধ্যেও হাস্যরসকে ছাড়েননি। নিজের নামটিও লিখতে ভালবাসতেন অদ্ভুত বানানে – ‘শিব্রাম চকরবরতি’। তাঁর অমর সৃষ্টি হর্ষবর্ধন ও গোবর্ধন চরিত্র দুটি যেকোনো মানুষের মন খারাপের ব্যামো অচিরেই সাড়িয়ে দেবে গ্যারান্টি সহকারে।
তারাপদ রায়ের রম্যরচনা বা ব্যঙ্গাত্মক হাস্যরচনাগুলির কথাও বলতে হয় এই সময়। কান্ডজ্ঞান, মাতালসমগ্র এর মত বই যেকোনো সাহিত্য ভাণ্ডারের সম্পদ।
বড়মামা, মেজমামার স্রষ্টা সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের কথাও কি না বললে চলে? তাঁদের কান্ডকারখানা পড়ে হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরেনি এমন বাঙ্গালীর সংখ্যা খুব কমই আছে।
বাংলা শিশু ও কিশোর সাহিত্যে অনাবিল হাসির যেরকম উপস্থিতি আমরা দেখতে পাই তা বিশ্ব সাহিত্যের সাথে তুলনীয়। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের পটলডাঙ্গার টেনিদা। চারমূর্তির লিডার। যার দাবি সে নাকি জুডোর এক প্যাঁচে ধরাসায়ী করে ১১২ কে.জি. ওজনের ভিলেনকে, মৈনাক পর্বতের মত লম্বা যার নাক আর যার বানানো বীরত্বের গল্পের ভারে খাবি খায় হাবুল, প্যালা, ক্যাবলার সাথে সাথে পাঠকেরাও।
সত্যজিত রায়ও তাঁর গল্পের বিভিন্ন আঙ্গিকে হিউমারের ছোঁওয়া এনেছেন বারবার। সবুজ আম্বাসাডারে চড়া, প্রখর রূদ্র ও সাহারায় শিহরণ এর লালমোহন গাঙ্গুলী বা মগনলাল মেঘরাজের নিষ্ঠুর খেলার বারবার শিকার হওয়া লালমোহন গাঙ্গুলী ওরফে আমাদের প্রিয় জটায়ুর কথা কি ভোলা যায়?
কমিক্সকে অনেকে সাহিত্যের অন্তর্গত করতে নারাজ। কিন্তু সে যদি হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট বা নন্টে-ফন্টের হয়? গত ছয় দশক ধরে বেশ কিছু প্রজন্ম জুড়ে যাদের বিচরণ, জনপ্রিয়তা? আবালবৃদ্ধবনিতা, বয়স নির্বিশেষে যাদের নানাবিধ উৎপাতে মশগুল তা শুধু সাহিত্য নয়, তার থেকেও বেশি কিছু, আমাদের মনের দোসর, হারিয়ে যাওয়া শৈশবের পরশ।
যাঁর কথা বলব বলে এতক্ষণের অপেক্ষা তাঁর কথা দিয়ে শেষ করব আজকের নিবেদন। তিনি সুকুমার রায়। বাংলা সাহিত্যের প্রথম ননসেন্স ভাবনার উদ্ভাবক। শুধু কিছু শব্দ জুড়ে যে একটা ছড়া হতে পারে বা কতগুলো অবচেতন মনের খেয়াল, ইচ্ছে বা কল্পনাজুড়ে একটা ‘হ য ব ড় ল’ হতে পারে এ একমাত্র উনিই দেখিয়েছিলেন যার আজ অবধি কোনও জুড়ি মেলা ভার। ওঁর কথায়, ‘ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল’! পান্ত ভুতের জ্যান্ত ছানাকে আদর করার ঘটা এমন ভেবেছিল কেউ?
‘ওরে আমার বাঁদর নাচন আদর গেলা কোঁতকা রে
অন্ধ বনের গন্ধ গোকুল ওরে আমার হোঁতকা রে..’
কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব। অদ্ভুত কিছু জীব সৃষ্ট তাঁরই কল্পনা থেকে – কুমড়োপটাশ, হাসজারু, ট্যাঁশগরু, প্রফেসর হিজিবিজবিজ..। বারবার এই হাসির রাজার লেখায় এসেছে হাসির জয়গান। সে পাগলা দাশুর ভরপুর দুষ্টুমিতেই হোক বা তাঁর অসংখ্য ছড়া ও কবিতায় – কাতুকুতু বুড়ো, রামগরুড়ের ছানা, আহ্লাদীর মত লেখায়। এর মধ্যেই আবার মজার ছলে ব্যঙ্গ করেছেন দেশের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে ‘একুশে আইন’ এ। গোঁফচুরির বড় বাবুর সাথে মিল পাননা কেউ কেউ আপনাদের অফিসের বড় বাবু থুরি বসটির সাথে?
আজকের এই অস্থির দিনে, মাপা হাসি, মেকি হাসির দিনে আরও বেশি করে যেন মনে পড়ছে এইসব কালোত্তীর্ণ মন ভালো করা লেখাগুলির কথা। সত্যি, এগুলির থেকে বড় অবসাদের ওষুধ আর হতে পারে নাকি? তাই খারাপ ভালোর দ্বন্দ পেড়িয়ে, অশান্তি, আতঙ্কের বদ্ধ গণ্ডি ডিঙ্গিয়ে আসুন না সবাই যাই সেই খেয়াল খুশির আবোল তাবোলের দেশে, যেখানে আমরা অনায়াসে বলে উঠতে পারি, ‘হাসছি কেন কেউ জানেনা, পাচ্ছে হাসি হাসছি তাই..’
আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে
নাইকো মানে নাইকো সুর,
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন্ সুদূর৷
আয় ক্ষ্যাপা–মন ঘুচিয়ে বাঁধন
জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
নিয়মহারা হিসাব–হীন ৷
আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল
মাতবি মাতাল রঙ্গেতে,
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে৷৷
Image reference:
i. https://en.wikipedia.org/wiki/Abol_Tabol
ii. http://www.bangalinet.com/sukumar_roy_abol_tabol5.htm
iii. https://en.wikipedia.org/wiki/Tenida
iv. https://www.hummingbirdstrail.com/tag/sukumar-ray/
v. https://www.arisumu.com/2018/08/hada-voda-3-bengali-pdf.html
© Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.
অসাধারণ একটা লেখা সকালটা সুন্দর করে দিল। কোষ্ঠকাঠিন্যের সাথে লড়াই করে মুখটা অহেন্দ্র চৌধুরী মার্কা করে ঠাকুর ঘর থেকে বেড়িয়ে মোবাইল এর নেট অন করতেই পেয়ে গেলাম ইসবগুলের ভুসি।
রাজনৈতিক হানাহানি, আর্থিক অস্বচ্ছতা, সম্পর্কের টানাপোড়েন, পেশায় প্রেসার সব কমে যায় যখন তারাপদ, শিব্রাম পড়ি। কিংবা “আবোল তাবোল ” খুলে একটু পড়ার সময় না থাকলেও ইলাসষ্টেসন গুলোর ওপর নজর যায়।
ধন্যবাদ কথবৃক্ষ… এমন একটা উদ্যোগ নেওয়ায়।
LikeLike