সপ্তসজ্জা_পাহাড়ের_গায়ে_মন_বেঁধেছে_বাস…
“দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া,
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপর একটি শিশির বিন্দু।”
পাহাড়ী মোড়কে মুড়ে থাকতে দিব্য লাগে। এইতো কদিন আগেই বরফে শরীর ভিজিয়ে ফিরেছিলাম উত্তরাখন্ড থেকে। ফেরার স্বপ্ন কাটতে না কাটতেই আবার গিয়েছিলাম ছোটোনাগপুর মালভূমীয় সপ্তশয্যা পাহাড়ে। দিনটা ছিলো ২০১৯ সালের ৩১শে ডিসেম্বর।
উড়িষ্যার ধেনকানাল জেলায় অবস্থিত সপ্তশয্যা।
সপ্তশয্যার পথে যেতে লাল মাটির মোরাম পেরিয়ে, শীতকালীন ধানী মাটির ধূসর রঙে রাঙালাম নিজেকে। পাহাড়ের গায়ে শাল এবং ওক গাছের সারি, মাটির স্তুপ কেমন চুপটি করে বসে হাতছানি দেয়। নির্জনতা এখানে বিষন্নতা নয় বরং পাগলামোকে উসকে দেয়। পাহাড়ের পথে পায়ে হেঁটে চলতে চলতে দু-দিক জুড়ে হরেক গাছের সবুজ চাঁদোয়া। শিকড় বাকড়ের মাটি আঁকড়ে থাকারও নিজস্ব একটা ভঙ্গিমা চোখে পড়ে। মাটিতে ভাস্কর্য নিপুণভাবে যেন খোদাই করেছে বৃক্ষরাশি। লাল মাটির সরানে উইয়ের দক্ষতা তার বাসা গড়ার ছন্দ প্রকাশ পেয়েছে। সপ্ত পাহাড়ের কোলে, ঝিঁঝিঁর ডাকে, জংলা ফুলের বাঁকে, হঠাৎ একটা পাখির নিস্তব্ধতা ভেদী চিৎকারে অলৌকিকতার তীব্র নেশায় বুঁদ হয়েছিলাম।

সাতটি পাহাড় হাতে হাত ধরে সাতটি শয্যা তৈরি করেছে বলে হয়তো জায়গাটার এমন নাম। তবে পৌরানিক কাহিনীও এর আনাচে কানাচে ঘুরছে। কেউ বলে রামচন্দ্র বনবাসে সাতদিন এখানে কাটিয়ে গেছেন আবার কেউ বলেন এখানে সাতজন ঋষির আশ্রম ছিলো। পান্ডবরাও অজ্ঞাতবাসকালে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অনেকের ধারণা।পায়ে হেঁটে ১০০০ ফুট পাহাড়ে উঠে তাঁবু খাটিয়ে একটা রাত বাস করেছিলাম সেখানে। কিভাবে যে সেই রাতটা কেটে গেল, বুঝতেই পারিনি। সপ্তশয্যা পাহাড়ের জঙ্গল মনকে বিস্ময়ে ভরিয়ে দিয়েছিলো। পাহাড়ের গায়ে লাল সন্ধ্যা বেয়ে রাত নামলে চাঁদের আলোয় আকাশ ভরে যায়। রাতের তাপমাত্রা ছিলো ৫ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড। এই জঙ্গলটা এখনও একেবারেই কুমারী কারণ বেআইনি কাঠুরেরা প্রবেশের সুযোগ পায়নি। পাহাড়ের গা বেয়ে ছোট ছোট ঝরণা বয়ে চলেছে। সারা রাত কান পেতে তার পদধ্বণি শুনেছি।

কোনো কোনো গাছের বাকল স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে এক একটি নকসা তৈরি করেছে। হয়তো অনেকদিন সূর্যের আলোর স্পর্শ পায়নি। জঙ্গল মনের ঘরে নেশা ধরায়। শুনেছিলাম, ওখানে চিতা আর ভাল্লুক অনেক আছে। তবে তাদের সাক্ষাৎ পাইনি। রাতের অন্ধকার চিরে খালি ঝিঁঝিঁ পোকার গান। এমন দেশ কোথাও আর খুঁজে পেতাম কিনা জানিনা; তবে শীতল, ভেজা অন্ধকারে নিজের মনকে সঁপে দিয়ে গুনগুনিয়ে গাইছিলাম….
“অন্ধকার সরণি ধরে শেষ হবে এ পথ চলা”…….
বছরের শেষদিন এমন নির্জনের কোলে কাটাবো একথা ভাবিনি কখনও। সারা দেশ যেখানে আলোয়-আলোয়, গানে-গানে সরব হয়ে নতুন বছরের অভ্যর্থনায় ডুব দিয়েছে সেখানে আমি নাহয় নীরবের কোলে, আঁধারে অবগাহন করে ঝিল্লি-মুখর রাতে, গা ছমছমে নিঝুম ঢালে, কনকনে শীতের চাদর জড়িয়ে নতুন বছরকে আহ্বান জানিয়ে বলি,
“এলো সময় রাজার মতো,
হলো কাজের হিসেব সারা….
…….বলে আয়রে ছুটে আয়রে ত্বরা,
হেথা নাইকো মৃত্যু নাইকো জরা”…..।
কাল ভোরে উঠলেই ঘরে ফেরার পালা। তবে মনে মনে এই পাহাড়ী সৌন্দর্য কে কুর্নিশ না জানিয়ে পারিনি।
লেখক পরিচিতি :- সুকন্যা দত্ত ব্যারাকপুরের নিবাসী, পেশায় স্কুল শিক্ষিকা।
চিত্র ঋণ :- সুকন্যা দত্ত।
© Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.