বাংলা সিনেমায় কমেডি – সৌরভ জানা

“সামালকে জাপানি স্যুটকেশ” টকটকে লাল রং তার। ফেলুদা’র সাথে প্রথম সাক্ষাতের দৃশ্যটা চোখ বুজে মনে করলেই পেট পেঁচিয়ে হাসি পায়না, এমন বাঙালি বিরল। কিংবা “মাসীমা মালপো খামু”- সাড়ে চুয়াত্তর, ভানুর যেচে আলাপ। কিংবা মলীনা দেবীর কত্তার পকেট থেকে পাওয়া প্রেমপত্র বা তুলসী চক্কত্তির গিন্নীর হঠাৎ মাখোমাখো ব্যবহারে অবাক হওয়া। বসন্ত বিলাপ সিনেমায় চিন্ময়ের কাকিমাকে দেখে প্রেমিকার সামনেই সটাং পুকুরে ঝাঁপ। বাংলা সিনেমায় কমেডি একটা সময়ে যে উচ্চতায় পৌঁছেছিল, সেটা ভাবলেই মনটা খিলখিল করে ওঠে। “আশিতে আসিওনা” একটা আস্ত সিনেমা তৈরি হয়েছিল পেট ফাটা হাসির রসদ দিয়ে। যেমন গল্প, তেমনি ডায়লগ আর সবচেয়ে বড় কথা বাঘা বাঘা হাসুরে দিয়ে তৈরি একটা সিনেমা। যতবারই দেখি ততবারই অবাক হই। আমেরিকায় হলে কবেই এই সিনেমা হয়ত অস্কার পেয়ে যেত।

বাংলা সিনেমায় কমেডি নিয়ে লিখতে শুরু করলে আরও একটা আরব্য রজনী হয়ে যাবে… যার শুরু আছে শেষ নেই। সংলাপ, অভিনেতাদের টাইমিং, পাঞ্চ লাইন সবই অনবদ্য। শুধুমাত্র বাংলা সিনেমায় যতজন গুণী কমেডিয়ান আজ পর্যন্ত কাজ করেছেন, পৃথিবীর আর কোনো প্রাদেশিক ভাষার সিনেমায় এর জুড়ি মেলে কিনা আমার জানা নেই। ‘রাতের রজনীগন্ধা’ সিনেমায় পার্ক হোটেল থেকে বেড়িয়ে গাড়ি স্টার্ট না নেওয়ায় মেজাজ বিগড়ে রাজা ব্যানার্জীর (উত্তম কুমার)। রাতের পার্ক ষ্ট্রীট। তাও পার্ক হোটেলের সামনে। খুবই চাপের। আর সেটা যদি হয় তখনকার বালিগঞ্জ। এমন অবস্থায় সিগারেট হাতে নিয়ে উদয় হলেন মোটা বিদঘুটে চেহারার স্যুট টাই পরিহিত দুর্গা দাস বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি মানিকবাবুর “গুপী গায়েন বাঘা বায়েন”-এ আমলকির রাজা ছিলেন আর গুপীর তানপুরা আছড়ে ভেঙে গ্রাম ছাড়া করেছিলেন বলেই ভূতের রাজার তিন বর পেয়েছিল। সেই অভিনেতা পাশে এসে ছোট্ট একটা সংলাপ – “ বালিগঞ্জ যাওগে”..?

ট্যাকসি ড্রাইভার ‘যায়গা’ বললে বলে ‘যাও’ বলে হি হি করে হেসে আবার হোটেল মুখী। “দুঃশালা মাতওয়ারা ক্যায়কা” বলে বিদায়। ছোট্ট একটা দৃশ্যে কী সাবলীল চমৎকার অভিনয়। এই দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কেই ‘মৌচাক’ সিনেমায় ঢপবাজ কণ্যাদায় পিতার চরিত্রে পাওয়া যায়। তরুণ কুমারের সাথে কথা কাটাকাটি ব্যাচেলার সিতেশ (রঞ্জিত মল্লিক) কার বাড়িতে রেস্ট নেবে সেই নিয়ে প্রায় হাতাহাতি। তরুণ কুমারের কথায় “আমার হাতির মত পাঁচটা মেয়ে থাকতে” অন্যের বাড়িতে কী ঠিকঠাক যত্ন হয়! কী সুন্দর নির্ভেজাল হাসির ঢেউ!

‘বসন্ত বিলাপ’ সিনেমাটার কথায় আসা যাক। হরিধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথমে আধুনিকা হোস্টিল তনয়াদের বাপাদ্য করা, পরে যখন সুন্দরী তনয়া রাধা (অপর্ণা সেন) তরুণ কুমারের (ডাক্তার) চেম্বারে এসে মেসের কাজের মহিলার পায়ে চোটের জন্য ওষুধ নিতে আসে তখন হুমরে পড়ে ‘ফাইন লেগ’ দেখতে উদ্যত হয়। কিংবা ‘ধন্যি মেয়ে’ তে জমিদারকে ভালোমন্দ খাবারের লোভে তোষামোদ। আর “হীরক রাজার দেশে” রাজ-জ্যোতিষীর একধারে তোষামোদ আর তারই মধ্যে বক্র চাহুনি আজও বাংলা সিনেমার সম্পদ।

আর বাংলা সিনেমায় কমেডিয়ান নিয়ে কথা হবে, আর উৎপল দত্ত থাকবে না, তা কি হয়! “বিকেলে ভোরের ফুল” – নায়ক উত্তম কুমার সাহিত্যিক। তার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জেলা শাসক নিঃসন্তান উৎপল দত্তকে কিছু বলতে হবে। মহিলা পরিবেষ্টিত সভায় মাঝবয়েসী সাহিত্যিক উত্তম কুমার, যার প্রেমে হাবুডুবু সুমিত্রা। সেইখানে বক্তৃতার শুরুটা হচ্ছে “আমি বেশ দেখতে পাচ্ছি আর কিছুদিনের মধ্যেই তোমরা মা হতে চলেছ।” অপ্রস্তুত সকলে একে অপরের দিকে চাওয়া-চাওয়ি। ভুল বুঝতে পেরে কারণ বর্ননা করে হেঁড়ে গলায় তালি বাজিয়ে গান – “মা হওয়া কি মুখের কথা…।” সবাই মুখ টিপে হাসছে। তারপর “আমিও একজন ইয়ে। অনেক ইয়ে লিখেছি। ইয়ে লিখতে আমার খুব ভালো লাগে…” একটি বারও কবিতা শব্দটা উচ্চারণ না করে, শুধুমাত্র ‘ইয়ে’ শব্দ ব্যবহার করে কী অসামান্য দক্ষতায় এক দমফাটা হাসির মূহুর্ত যে তৈরি করা যায়, সিনেমাটা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। একটা ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করে জাত চিনিয়ে গেছে। উৎপল দত্তর আর একটা সিনেমার কথা না বলে পারছি না… ‘গোলমাল’। সিনেমাটা যদিও হিন্দিতে কিন্তু শুধুমাত্র উৎপল দত্তের জন্য এটা বাংলায় রিমেক করা উচিৎ ছিল। এই সিনেমায় প্রমাণ করেছেন একা একটা উৎকৃষ্ট মানের হাসির সিনেমা তৈরি করা যায়।

বাংলা সিনেমায় একটা সময় কমেডিয়ান ছিল তুলসী চক্রবর্তী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, রবি ঘোষ, অনুপ কুমার, তরুণ কুমার, চিন্ময়, উৎপল দত্ত। পর্দা আলো করে গেছে। একটা দুটো ডায়লগ ঠিকঠাক পাঞ্চ লাইন বা টাইমিং এর জোড়ে নয়, পর্দায় এদের উপস্থিতিতেই দর্শকের হাসির উদ্বেগ হত। ‘মহাপুরুষ’ এ রবি ঘোষের অভিনয়টা মনে পড়লেই মনটা তাজা হয়ে যায়। আবার আসি ‘বসন্ত বিলাপ’ সিনেমায়। ডাক্তারের চেম্বারে এক বড় মই খোঁজার দৃশ্যটা মনে করুন। ভূগোলের দিদিমণি, যে লম্বায় রবি ঘোষের থেকে বড়, রাস্তায় আগ বাড়িয়ে আলাপ করার মূহুর্ত কিংবা আগে রিক্সায় লাফিয়ে ওঠা এবং রিক্সায় উঠতে অনুরোধ করার দৃশ্যটা। আর তরুণ কুমারের ডিসপেনসারিতে পোস্টার মারা আছে দেখে তরুণ কুমারের বিরক্তির প্রকাশ আর ডায়লগ থ্রোর টাইমিং। জাস্ট ভাবা যায় না। কিংবা ‘সপ্তপদী’ তে টুকলির দৃশ্য বা রাজার অভিনয়ের দৃশ্য। একটা অদ্ভুত হাসির ঘরানা ছিল সেই সময়কার সিনেমায়।

তা বলে এটা বলছি না যে এখনকার সিনেমায় ভালো কমেডিয়ান নেই। আছে। খরাজ মুখার্জী, রুদ্রনীল, কাঞ্চন মল্লিক, শুভাশিস, শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ, রজতাভ দত্ত, কৌশিক গাঙ্গুলি, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় – খুবই উচ্চমানের কমেডিয়ান। কিন্তু সমস্যা টা হচ্ছে, ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ কে বাদ দিলে, শুধুমাত্র কমেডির ওপর ভিত্তি করে সিনেমা তৈরি হচ্ছে না। আজকাল সিনেমায় যে সব কমেডি একটা উচ্চতায় উত্তীর্ণ হয়েছে, তা কিন্তু একটু অন্যধারার সিনেমাগুলোতেই হচ্ছে। আগেকার মত কমেডিকে যেমন সব সিনেমায় প্রবল গুরুত্ব দেওয়া হত সেটা এখন বলতে বাধা নেই, অনেকটাই কম। শুধুমাত্র বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ এবং তার টাইমিংই শুধু একজন কমেডিয়ানের থেকে কাম্য নয়, তার হাঁটা চলা, আঙ্গিক অভিনয়টাও হাস্যরসে টইটম্বুর হতে হবে। সেদিক থেকে খরাজ মুখার্জী অন্যদের থেকে অনেকটা এগিয়ে থাকবে। এই ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’- এ প্রমোদ প্রধানের ছোট্ট একটু পরিসরে ফাটিয়ে দিয়েছে।

শাশ্বত-র ডায়লগ থ্রোইংটা অত্যন্ত ভালো হলেও কমেডিয়ান চেহারা না হওয়ায় একজন পরিপূর্ণ কমেডিয়ান হতে পারেনি। সেদিক দিয়ে বিচার করলে কাঞ্চন বা শুভাশিস চেহারার এডভান্টেজ পেলেও টাইমিং বা ওভার একটিং এর একটা প্রবণতা দেখা যায়। আর পরান বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, কৌশিক গাঙ্গুলি… এদের চেহারা এবং অভিনয় ক্ষমতা থাকলেও কমেডিয়ান হিসেবে খুব বেশি পাওয়া যায় না। ‘কন্ঠ’, ‘হামি’- র মত সিনেমায় ভালো কমেডি হলেও, যেন মন বলে আরও যদি পাওয়া যায়…..!

‘প্রাক্তন’ – এ বিশ্বনাথের কমেডি ভালো লাগলেও ভানু-জহর-তুলসী চক্রবর্তীর মত দীর্ঘকালীন ছাপ তৈরি করতে ব্যর্থ। আসলে আমার মনে হয় আজকের আর্থসামাজিক পটভূমি পাল্টানোর সাথে সাথে মানুষের হাস্যরসের প্রকারটাও পাল্টে গেছে। তাই বুঝি মানুষের হাস্যরুচি আর বক্স অফিসের কথা মাথায় রেখে ‘আশিতে আসিও না’ বা ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ – এর মত আজগুবি নিপাট হাসির সিনেমা বানাতে ভরসা পাচ্ছে না প্রোডিউসাররা।

আর আধুনিক দর্শক বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপ প্রধান কমেডিই বোধহয় বেশি পছন্দ করে। অন্তত GenX কে স্টাডি করে আমার তাই মনে হয়। সিনেমা হল ‘Highest form of commercial art’. তাই ব্যবসার কথাটা ভাবতেই হবে। তবুও বাংলা সিনেমায় কমেডির যে একটা স্বর্ণময় অধ্যায় রয়েছে। আসুন না আবার বাংলা সিনেমায় কমেডিকে প্রাধান্য দিই..! জটিল কঠিন জীবনের ফাঁকে ফাঁকে নির্ভেজাল হাসির ফোয়ারা তুলে প্রেশার সুগার থাইরয়েড কমাই। চলুন আজ থেকে লাফিং ক্লাস নয়, রোজ পালা করে হাসির সিনেমা দেখি।

Image courtesy: http://oldfilmsgoingthreadbare.blogspot.com/2010/08/lot-like-life-golpo-holeo-shotti.html?m=1

© Kothabriksha 2020, All Rights Reserved

One Comment Add yours

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.