কাঁধে স্কুলব্যাগ ঝুলিয়ে, গলায় জলের বোতল ঝুলিয়ে কাঁদতে কাঁদতে প্রথম দিনের স্কুল। ভয়ে ভয়ে বেঞ্চিতে বসা। অচেনা সবাই আশেপাশে। তারপর দিদিমণি এলে, প্রেয়ার শুরু করে স্কুল। মোটামুটি আমাদের সবার স্কুলজীবনের শুরু খানিকটা এভাবেই।
কাট টু ২০২০।
“বাবু, আজ তো প্রথম স্কুল, ওঠো ওঠো, জামা পরে নাও, আমি ল্যাপটপ টা চালিয়ে দিচ্ছি। লক্ষ্মী হয়ে বোসো।”
এর উত্তরে ‘ও মা, আজকে স্কুলে যাবো না’ ২০২০ তে কাউকে বলতে শোনা গেছে বলে হয়না। জামা পরে ল্যাপটপ বা ফোনের সামনে বসা আর ক্লাসে সমবয়সীদের সাথে একসাথে ক্লাস করা, এই দুটো অভিজ্ঞতা কোনোদিনই এক হতে পারে না।
আর যাদের মাঠ-বন-পাহাড় পেরিয়ে স্কুল যেতে হত, তাদের কোথায় অনলাইন ক্লাস আর কোথায় কি! যে দেশের এখনো মানুষ অভুক্ত, অনলাইন ক্লাস সেখানে বিলাসিতা নয় কি ? ভারতের মতো দেশ কি কোনোদিন পারবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অনলাইন করতে ? এই উত্তরটা পেতে হয়তো খুব বেশি সময় লাগবে না।
২০২০ তে যারা শিক্ষা জগতে প্রবেশ করল, বা যাদের প্রবেশ করার কথা, তারা যে শুধু শৈশব এর বড় অধ্যায় থেকে বঞ্চিত হল তা নয়, সিংহভাগ বাচ্চাদের থেকে আমরা তাদের শিক্ষার অধিকারটাও কেড়ে নিলাম। যাদের বাবা-মা- রা সমর্থ কেবল তারাই পারছে অনলাইন ক্লাস করতে। আর যারা পারবেনা, তারা বাদ! কলকাতার অনেক বড় বড় স্কুলে অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের ছেলেমেয়েদের নির্খরচায় পড়ানোর একটা রেওয়াজ ছিল এক সময়। কিন্তু এখন তাহলে, সেই স্কুলে তারাই পড়তে পারবে, যারা অনলাইন ক্লাস ( ল্যাপটপ/স্মার্টফোন, সবল ইন্টারনেট কানেকশন, পড়াশুনার আলাদা ঘর) “afford” করতে পারবে।
করোনা কী তাহলে একটা জেনারেশন কে তাদের শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চলেছে তাহলে ?

এর মধ্যেই জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দুটি পরীক্ষার ফল ঘোষণা হয়েছে। ক্লাস টেন ও টুয়েলভের বোর্ড এর ফল। ছাত্রজীবন কেন পুরো পেশাগত জীবনেই সম্ভবত যে দুটি পরীক্ষার ফলাফল সবচেয়ে বেশি গণ্য হয় তা হল এই দুটি। কি অদ্ভুত পরিস্থিতি! সমস্ত বিষয়ের পরীক্ষা শেষ হওয়ার আগেই ঘোষণা হয়েছিল লকডাউন। বিভিন্ন সময় নানান তারিখ জানিয়েও শেষ পর্যন্ত্য সম্পূর্ণ করা যায়নি পরীক্ষা গুলি। এদিকে ফল না বেরোলে পরের শিক্ষা বর্ষের সময় সংকুলান করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে। তাই বাকি পরীক্ষা না নিয়ে আগের পরীক্ষা গুলির ভিত্তিতে গড় নম্বর দিয়েই ফল ঘোষিত হল। কিন্তু এবার? ক্লাস টেন বা টুয়েলভের পর বিষয় এবং অতঃপর পেশাগত দিশা বেছে নেওয়ার ব্যাপার থাকে ছাত্র ছাত্রীদের। কিসের ভিত্তিতে বা ভরসায় তারা সেই বাছাই করবে? আর স্কুল কলেজ কর্তৃপক্ষই বা কিসের বিচারে কাকে কোন শাখায় নেবেন ? এই গড় নম্বরের ভিত্তিতেই ? এতজন ছাত্র ছাত্রীর ভবিষ্যৎ, যারা একটা গোটা দেশের ভবিষ্যৎ ও বটে – এর ফলে কোথাও দুর্বল হয়ে গেল না তো?
শুধু ফল বা বিষয় নির্বাচন তো নয়। এরপর রয়েছে ভর্তি ও পড়াশোনার পদ্ধতি। ভর্তি বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনলাইন। যতদিন সব স্বাভাবিক না হয়, পড়াশোনা, ক্লাস ও তাই। ছাত্রজীবনের ছন্দটা কোথাও যেন কেটে যায় না তাতে? আমাদের গরিব দেশের লক্ষাধিক ছাত্রের মধ্যে সবার সামর্থ্য কি এই ভার বহন করার ? ভয় হয়। হাজার, হাজার মেধাবী ছাত্রের সামনে উচ্চশিক্ষার দরজাটুকু বন্ধ হয়ে যাবে না তো? এই অতিআধুনিকতা ও প্রযুক্তি নির্ভরশীলতার যুগেও ভারতবর্ষে এরকম বহু প্রত্যন্ত গ্রাম রয়েছে এখনও যেখানে দুবেলা খাবার জোটে না, বিদ্যুৎ যেখানে বিলাসিতা। সেখানে অনলাইন ক্লাস একটি প্রহসন মাত্র হয়ে রয়ে যাবে তো। কি অসম্ভব এক অনিশ্চয়তার মুখে দাঁড়িয়ে এই সদ্য কিশোর – যুবা প্রজন্ম।
এ এক আশ্চর্য সন্ধিক্ষণে রয়েছি আমরা। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে জানা নেই। কবে আবার কচি কাঁচা কিশোর কিশোরীর কলরবে মুখরিত হবে স্কুল কলেজের ক্লাসরুম সেও এখন শুধুমাত্র জল্পনার বিষয়। এই মারণ মহামারি আমাদের এক ঝাঁক প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যার উত্তর খুঁজে চলেছি প্রতিনিয়ত, নিজেদের জন্য, আরও বেশী করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও বটে। খুব শিগগিরি সব ঠিক হয়ে যাবে, ছোটরা অচিরেই মুক্তি পাবে এই করোনা নামক সেলফিস জায়েন্টের থেকে। প্যান্ডোরার বাক্সে তালাবন্দি রয়ে যাওয়া সেই আশাটুকু সম্বল করেই এখন শুধু সামনে তাকিয়ে থাকা। আর যতদিন তা না হয়? আসুন না সবাই মিলে সাধ্যমত হাত বাড়িয়ে দিই, চেষ্টা করি আমাদের আশেপাশের মেধাবী শিশু বা কিশোরটির পড়াশোনা যাতে বন্ধ না হয়ে যায়। সবাই মিলে পাশে দাঁড়ালে হয়ত এই দেশ আর কোনও জামলো মাকদামকে অকালে হারাবে না।
Image Reference:
1.https://images.app.goo.gl/efqB4jYb17nQBBui8. 2. https://images.app.goo.gl/KyHRYaUhLgzc8421A
3. https://images.app.goo.gl/LRnQ3tmzF4EPMsKb9
Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.
One Comment Add yours