প্রসঙ্গে মৌমাছি ও মধু – পর্ব ১ – সুকন্যা দত্ত

মৌমাছি ও মধু শব্দদুটি একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মৌমাছি ও মধুর কথা নানানভাবে বারবার উঠে এসেছে পুরাণে, ধর্মীয় পুস্তকে, রূপকথায়, লোককথায়, বিজ্ঞানে ও চিকিৎসা শাস্ত্রে।

প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রায় ৯০০০ বছর আগে মৃৎ শিল্পে যে সকল পাত্রের সন্ধান পান, তার থেকে অনুমিত হয়, সে সময় মৌমাছি প্রতিপালন, মৌচাকের অস্তিত্ব ছিলো। ১৯১৯ সালে স্পেনের ভেলেনিকার কাছে বাইকর্পে আরানা গুহার গায়ে একটি গুহাচিত্র আবিষ্কৃত হয়। কারও কারও মতে আনুমানিক ১৫০০০ বছর আগে, আবার কারও মতে প্রায় ৮০০০ বছর আগের এই চিত্রটিতে দেখা যায়, একটি মানুষ ঘাসের দড়ি বেয়ে উপরে উঠছে মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহের জন্য এবং আশেপাশে অনেক মৌমাছি ঘুরে বেড়ালেও দংশন করছে না তাকে। এই ছবি থেকে মধু সংগ্রহের বিষয় ধারণা করা যায়। আনুমানিক ৭৭৩ খ্রিঃ পূর্বাব্দে চীন দেশে মৌমাছি প্রতিপালনের কথা জানা যায়। সেই দেশের মানুষ পৃথিবীর নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়াতো মৌচাকের সন্ধানে এবং মধু সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতো।
৩৪৪ খ্রিঃ পূর্বাব্দ থেকে ৩৪২ খ্রিঃ পূর্বাব্দের মধ্যে
অ্যারিস্টটলের সাধারণ ইতিহাস থেকে মধু এবং মৌমাছি পর্যবেক্ষনের কথা জানা যায়। ২১০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে সুমেরীয় ও ব্যাবিলনীয় কীলক লিপিতে এবং হেট্টিটি ভাষায়, ভারত ও মিশরীয় লিপিতে ও উঠে এসেছে মধুর বর্ণনা। ইংরেজি “হুনিগ” থেকে “হানি “বা “মধু ” শব্দটি এসেছে বলে মনে করা হয়।

এবার আসি, পৌরাণিক কাহিনীতে বর্নিত মধুর বিষয়ে। গ্রীক পুরাণ থেকে জানা যায়, মৌমাছি দেবতার দূত ছিলো এবং সে ছিলো জ্ঞান ও কাব্যের উৎস। হোমারের ইলিয়াড ও ওডিসিতে উল্লেখ রয়েছে, অলিম্পাসের দেবতারা মধু (অমৃত) ও মধু ওয়াইন (এমব্রাসিয়া) এ বাস করতো। “এমব্রাসিয়ার” অর্থ হলো অমরত্ব। গ্রীক ভাষায় মধুর অর্থ হলো “মৃত্যুর উপরে বিজয়”।

পুরাণ মতে, আকাশ, বিদ্যুৎ ও ঝড়ের দেবতা জিউসের জন্মের পর তার পিতা দেবতা ক্রুনস তাকে মেরে ফেলতে চাইলে জিউসের মা ডিক্টে পাহাড়ের গুহায় তাকে লুকিয়ে রাখেন। সেই গুহায় যে পবিত্র মৌমাছিরা বাস করতো, তাদের সঞ্চিত মধু খেয়ে বহু বছর জিউস জীবিত ছিলেন। 

গ্রীক সৌন্দর্যের দেবী অ্যাফ্রোডাইট তার সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য মধু ও মোম ব্যবহার করতো।প্রাচীন গ্রীসে চিকিৎসায় মধু একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নানান ব্যাধি নিরাময়ের জন্য, জ্বর, ক্ষতস্থান নিরাময়ের জন্য মধুর ব্যবহার লক্ষিত হয়। মধুচক্র বিষয়ক তত্ত্ব অধ্যয়ন করানো হতো প্রাচীন গ্রীসে। সেই সময় অলিম্পিকে মধু প্রাকৃতিক ডোপিং হিসেবে ব্যবহৃত হতো, খেলোয়াড়েরা খেলার পর তাদের শক্তি ফিরে পেতো মধু মিশ্রিত জল পান করে। 

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে প্রাচীনকালে বর্ণিত মধু ও মৌমাছির তথ্যগুলি বর্তমান যুগেও যুক্তিযুক্ত। মধুতে যে গ্লুকোজ রয়েছে তা শরীরে তাড়াতাড়ি মিশে যায় এবং ফ্রুকটোজ শক্তি বর্ধন করে। রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে ও মধুর অসীম ভূমিকা রয়েছে। মধুতে ব্যাকটেরিয়া বিনাশের ক্ষমতা থাকায় এটি পান করলে বা ক্ষত স্থানে লাগালে ব্যাকটেরিয়া বিনষ্ট হয়। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলতেও মধু উল্লেখযোগ্য। মধুর আর্দ্রতা মুখশ্রীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। 

প্রাচীন গ্রীসের মহান মাতা ছিলন রানী মৌমাছি এবং তার পূজারিণীরা ছিলো মৌমাছি যারা মেলিসাই নামে পরিচিত ছিলো। শিকার, বন্য প্রানী, গাছপালা, সতীত্বের দেবী আর্টেমিসের প্রতীক চিহ্ন হলো মৌমাছি।আনুমানিক ৬০০ খ্রিঃ পূর্বাব্দে এফেসিনীয় মুদ্রায় মৌমাছির ছবি খোদিত ছিলো। দেবতা অ্যাপোলো ছিলেন মৌমাছির রক্ষক। কথিত আছে শিল্প, কবিতা, বিজ্ঞানের দেবী মিউস একবার মৌমাছির ছদ্মবেশে প্রাচীন গ্রীসের এক উপজাতির কিছু মানুষদের পথপ্রদর্শক হয়ে সমুদ্র পথে তাদের জাহাজ কে এথেন্স থেকে তাদের ঘরের পথে ফেরান। বাস্তব দিকটি লক্ষ্য করলে দেখা যাবে,  কিছু প্রাণী, পতঙ্গের মতো মৌমাছির অপটিক্যাল ফ্লো ক্ষমতাটি রয়েছে। এর দ্বারা তারা কোনো গাছের কোটর বা নালী পথের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময়  পরিবেশের মধ্য থেকে তাদের গতি, দূরত্বের অনুমান করতে এই শক্তিটিকে কাজে লাগায় এবং তাছাড়া পৃথিবীর চৌম্বক শক্তি বা ম্যাগনেটিক ফ্লো সাহায্য করে মৌমাছিকে সঠিক পথ চলতে। পরীক্ষায় দেখা গেছে মৌমাছির  মস্তিস্কের গ্যাংলিয়া যাত্রা পথের চিত্র অঙ্কিত করে রাখতে পারে। সাধারণত মধু সংগ্রহের ১ কিলোমিটারের মধ্যেই তারা মৌচাক নির্মাণ করে।

প্রাচীন গ্রীসে মৌমাছিদের মৃত আত্মার সংযোগ রক্ষাকারী বলে মনে করা হতো। অ্যারিস্টটল, ভারো, ভার্জিল, প্লিনির লেখায় বর্ণিত আছে মৌমাছি হলো আবহাওয়ার ভবিষ্যৎ বক্তা। তারা বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস দিতে পারতো। বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, মৌমাছি বৃষ্টির পূর্বে বৃষ্টিপাতের আগমন ও ঘনত্বের অনুমান করতে পারে। সূর্যালোক বিকিরণ,  বায়ুচাপের পরিবর্তন, বাতাসে তাপমাত্রার তারতম্য থেকে হয়তো মৌমাছি এই ধারণা তৈরি করে তাই বর্ষাকালের আগে তারা বেশী করে মধু সঞ্চয় করে।

লেখক পরিচিতি :- সুকন্যা দত্ত ব্যারাকপুরের নিবাসী, পেশায় হাই স্কুলের শিক্ষিকা।

Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.