ঐতিহাসিক কারনেই রবীন্দ্রনাথকে একজন দ্বিভাষিক লেখক হয়ে উঠতে হয়েছিল। আমরা জানি যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর তিনি প্রায় বিশ্বপথিক- ইউরোপ, আমেরিকা এবং এশিয়ার নানাদেশে তাঁকে অনবরত লেকচার ট্যুর করতে হয়েছে এবং ইংরেজিতে বক্তৃতা দিতে হয়েছে।যদিও রবীন্দ্রনাথ সবসময় মনে করতেন স্বাভাবিক প্রকাশের প্রবাহই হল মাতৃভাষা।
সমগ্র বিশ্বের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের অন্যতম ভাষা হল ইংরেজি , তা সেযুগ হোক আর এইযুগ। কিন্তু এই ক্ষমতার ভাষার কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করেন নি , বরং বলিষ্ঠ মনোভাব নিয়ে সরাসরি ইংরেজিতেই রচনা করেছেন বহু প্রবন্ধ। কিন্তু বিশ্বমানুষের দরবারে তাঁর বাংলা সাহিত্যকে পৌঁছানোরও তাগিদ অনুভব করেছেন বারবার। বলাই বাহুল্য তার জন্য একমাত্র অবলম্বনই ছিল- ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ। রবীন্দ্রনাথ যখন ‘গীতাঞ্জলি’ অনুবাদ করছেন তখন তিনি শিলাইদহে। শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। ইন্দিরা দেবীকে তিনি লিখছেন-“যদি বলিস কাহিল শরীরে এমনতরো দুঃসাহসের কথা মনে জন্মায় কেন-কিন্তু আমি বাহাদুরী করবার দুরাশায় একাজে লাগিলুম।আরকেদিন যে ভাবের হাওয়ায় মনের মধ্যে রসের উৎস জেগে উঠেছিল , সেইটিকে আরেকবার আরেক ভাষার ভিতর দিয়ে মনের মধ্যে উদ্ভাবিত করে নেওয়ার জন্য কেমন একটা তাগিদ এলো।” রবীন্দ্রনাথ দুটি ভাষাতেই লিখে গেছেন এবং গীতাঞ্জলির কবিতাগুলি পাশ্চাত্যে তাঁকে একজন “প্রফেট” বা সন্তের জায়গায় তুলে ধরেছিল। যুদ্ধরত এবং যুদ্ধক্লান্ত ইউরোপ তাঁর কবিতার মধ্যে শান্তি খুঁজে পেয়েছিল। আমরা দেখেছি কবিতা রচনা বা নিজেকে বারবার “কবি” হিসেবে পরিচয় দিলেও বহু ক্ষেত্রে , বিশেষত বিদেশের কথা যদি বলি , সেখানে তিনি- ধর্ম , মানুষ , প্রাচীন সভ্যতার আদর্শ ইত্যাদি। আমরা জানি যে আমেরিকাতে উপস্থিত থেকে তাঁর দেওয়া এই সংক্রান্ত বক্তব্য “সাধনা” নামে প্রকাশিত হয়েছে।

রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি লেখাকে খুব সাধারনভাবে দুটি ধারায় ভাগ করতে পারি। এক কবিতা নাটকের অনুবাদ, দুই ইংরেজি প্রবন্ধ , বিতর্ক ইত্যাদি। নোবেল প্রাপ্তির পর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণ , এবং দ্বিতীয় স্তরে সরাসরি ইংরেজি লেখা একটা প্রবল চাপ সৃষ্টি করলো। তাঁর জীবৎকালেই অন্তত দশটি ইংরেজি প্রবন্ধ বেরিয়েছে এবং এর মধ্যে অনেকগুলি বিষয়বস্তু ও গদ্যের সৌন্দর্যে অতুলনীয়। অন্যদিকে কবিতা নাটকের ক্ষেত্রে দেখা গেল যে তাঁর যে খ্যাতি, তাতে গ্রহণ লাগার প্রধান কারণই হয়ে উঠল “দুর্বল” অনুবাদ এবং অমনোযোগের সাথে করার ফলে, তা হয়েছে অনুজ্জ্বল। এগুলি অনেকগুলি তিনি করেছেন নিজে আবার অনেকে তাঁর অনুমোদন নিয়ে করেছেন। এডওয়ার্ড থমসন ১৯২৬ সালে লিখছেন যে – “His real reputation began to decline almost as as soon as it reached its height. Rabindranath’s loss of reputation to me is a distressing thing. Yet I think the poet himself and his publisher’s are almost entirely to blame . Very great mistakes were made. Gitanjali was a selling proportion as it deserve to be. So Book after book was hurried out and flung at the public. After Gitanjali came The Gardener . This great pleasure to many, but the word had gone round that he was a mystic. The Crescent Moon followed and then the English SADHANA his fate was sealed.”

এর ৫০ বছর পরে মেরি লাগো একই ব্যাপারে অভিযোগ তুলেছেন অনুবাদের মান নিয়ে। তিনিও বলেছেন যে দ্রুত তৈরি করা অনুবাদগুলিতে কল্পনাশক্তির ও আগ্রহের অভাব। যারা রবীন্দ্র অনুবাদের সমালোচক হলেন পাশ্চাত্যে তারা মধুর মধুর শব্দ অতিমাত্রায় ব্যবহারের বিরুদ্ধে আপত্তি তুললেন- এভাবে ধীরে ধীরে অনুবাদের ক্ষেত্রে একটা মস্ত ফাঁক তৈরি হল।রবীন্দ্রনাথ নিজেও মনে করতেন যে পাশ্চাত্যের পাঠকরা তাঁর কবিতা পুরোটা ধরতে পারবেন না। তাই তিনি অনেক সময়ই কবিতার সারসংক্ষেপ করে ফেলতেন এবং খুব সরল , মধুর অংশটুকু রাখতেন। তার ফলে, কবিতাটি হয়ে উঠত প্রাণহীন। অন্যতম রবীন্দ্র অনুরাগী ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো আর্জেন্টিনা থাকাকালীন একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন – রবীন্দ্রনাথ একটি কবিতা তাঁকে মুখে মুখে অনুবাদ করে শুনিয়েছিলেন কিন্তু ভিক্টোরিয়া বলেন অনুবাদটি লিখে দিতে। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যে লিখিত রূপটি উপস্থিত করলেন তাতে অনেক কিছুই বাদ থেকে গেল। ওকাম্পোর মতে সেই অংশগুলিই ছিল কবিতার মূলকেন্দ্র। কেন তিনি বাদ দিয়েছেন এর উওরে রবীন্দ্রনাথ বলেন যে তাঁর মনে হয়েছে পাশ্চাত্যের মানুষ ওকাম্পো ওই অংশগুলোতে আগ্রহী হবেন না, এবং এই কথা শুনে ওকাম্পো অপমানিত বোধ করেছেন। যদিও রবীন্দ্রনাথ অপমান করতে চান নি, এটা ছিল তাঁর বিশ্বাসের ব্যাপার এবং এটাই তাঁর ভুল।
তাঁর অনুবাদের একটা উদাহরণ দিলে হয়ট বিষয়টা আরেকটু স্পষ্ট হবে। “খেয়া” কাব্যগ্রন্থের “ কৃপণ” কবিতা।
“ যবে পাত্রখানি ঘরে এনে
উজার করি, একি
ভিক্ষামাঝে একটি ছোট সোনার কণা দেখি!
দিলেম যা রাজ ভিখারীরে স্বর্ণ হোয়ে এলো ফিরে
তখন কাঁদি চোখের জলে দুটি নয়ন ভরে
তোমায় কেন দিইনি আমি সকল শূন্য করে”
এর অনুবাদ হল-
“ But how great my surprise
When at the day’s end
I emptied my bag on the floor
To find the least
Little grain of gold among the poor heap
I bitterly wept and wished that
I had had
The heart to give thee my all”
এখানে “পাত্রখানি”, “উজার করি” , “ভিক্ষামাঝে” , “দুটি নয়ন ভরে” শব্দগুলো কোথায় স্থান পেল অনুবাদ? আবেগ আর দুঃখের মূল ভিত্তিগুলোই যেন মুছে গেল অনুবাদে।
কবি হ্যারিয়েটকে ১৯১৩, ৬মার্চ কবি ইংরেজি গীতাঞ্জলি কবিতা সম্পর্কে বলেন- “ আমি এগুলোকে অনুবাদ বলব না”। রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে তিনি জানিয়েছিলেন যে তাঁর অনুবাদ করতে সমস্যা হচ্ছে, তিনি অনুবাদ ঠিক করতে পারেন না-তাঁকে প্রায় নতুন করেই লিখতে হয়। অনুবাদ করতে গেলে আত্মভোলা হলে চলে না , অথচ নিজেকে না ভুললে শব্দগুণ বা শৈলী সবই হারিয়ে ফেলেন।
অনুবাদের ক্ষেত্রে যে তাঁর ভুল হচ্ছে সেটা তিনি একটু দেরীতে হলেও বুঝেছিলেন, তখন তিনি সংশোধনের চেষ্টাও করেছেন, কিন্তু তখন আর সময় ছিল না। এই ইংরেজি অনুবাদ নিয়ে তিনি যে কতটা উৎকণ্ঠা ও যন্ত্রণা ভোগ করেছেন তা অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা চিঠিতে ধরা পড়ে। ২৩শে অক্টোবর,১৯৩৪ তে তিনি বলেন অনুবাদের তিনি এতটা অবিচার করেছেন, এতটা অমনোযোগের সঙ্গে অনুবাদ করছেন তার কারণ এগুলো তাঁর নিজের রচনা বলেই।অন্য আরেকটি চিঠিতে তিনি “ FRUIT GATHERING” আর “ LOVER’S GIFT” সম্মন্ধে স্পষ্ট বিরক্তি প্রকাশ করেছেন এবং এগুলিকে অচল বলেছেন। যিনি একসময়, রবার্ট ব্রিজেস ১৯১৫ সালে তাঁর একটি কবিতা সংকলনে রবীন্দ্রনাথের কবিতা গ্রহণের সময় সামান্য পরিবর্তন করতে চাইলে তার কঠোর আপত্তি করেছিলেন, ১৯৩৫ এ সেই রবীন্দ্রনাথই লিখছেন যে তাঁর লেশমাত্র আপত্তি নেই যদি তাঁর কোনো ইংরেজি কবিবন্ধু এগুলো সম্পাদনা করেন।
রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদ- GITANJANI(1912), THE GARDENAR (1913), SADHANA, THE CRECENT MOON, CHITRA, ONE HUBNDRED POEMS OF KABIR(1914), FRUIT GATHERING (1916), STRAY BIRDS, SACRIFICE AND OTHER PLAYS, PERSONALITY , NATIONALISM , LOVER’S GIFT (1918), THE FUGITIVE (1921), CREATIVE UNITY (1922), RED OLEANDERS (1925), FAR FLIES (1928), THE CHILD (1931) , THE RELIGION OF MAN।
লক্ষ্য করা যায় যে যেভাবে অনুবাদ করা হয়েছে তাতে নির্বাচন ও বিন্যাসও খুব তাড়াহুড়ো করে করা। গীতাঞ্জলিতে তিনি ১০টি বই থেকে কবিতা নিয়েছিলেন , কিন্তু তাদের মধ্যে একটা যোগাযোগ ছিল। কিন্তু গার্ডেনার এ যে কবিতাগুলো অনুবাদ করলেন ২৬টি তাতে ‘ক্ষণিকা’র ১০টি , ‘সোনার তরী’র ১০টি আরও অন্য জায়গা থেকে নিয়ে। ফলে কোনো ঐক্যবোধ নেই সেই দিক থেকে। আসলে তিনি গীতাঞ্জলি থেকে গার্ডেনারকে খুব সচেতনভাবে হয়ত আলাদা করতে চেয়েছেন , প্রেমের কবিতাগুলি বেছে নিয়েছেন। কিন্তু অনুবাদ অমনোযোগে অনেকসময়ই অতিসংক্ষিপ্তকরণ বা প্যারাফ্রেসড হয়ে গেছে । এই মারাত্বক অভ্যাস তাঁর ছিল, আগেও উল্লেখ করেছি অসাধারণ কবিতার উল্লেখযোগ্য অংশ কেটে বাড দিয়ে দিতেন। ফ্রুট গ্যাদারিং এ বলাকা , গীতাঞ্জলী , গীতালি , গীতিমাল্য , কথা থেকে কবিতা নিলেন। এখানেও সেই ভাবের ঐক্যের অভাব। সময়ের ধারাবাহিকতাও বজায় রইল না, পরেরগুলোতেও এই রকম ধারা বয়ে গেল।
তিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন অনেক কবিতা তুলে নিতে চেয়েছিলেন –ক্রনোলজি রাখতে উদ্যত হয়েছিলেন। ম্যাকমিলান এর – Collected poems and phrases of Rabindranath Tagore” এটিও খুব দুর্ভাগ্যজনক প্রকাশনা যদিও খুব নামকরা প্রকাশকের কাছ থেকে বেরিয়েছে। এটির সম্পাদনার কাজ অত্যন্ত এলোমেলো এবং অমনোযোগের সঙ্গে করা। এমনকি এতটাই যে The Post Office , The Cycle of Spring যেগুলো এই সংকলনে নেওয়া হয়েছে তা যে রবীন্দ্রনাথের করা অনুবাদই নয় – তা জানানো হল না, কবিতার রচনার তারিখ জানানো হল না, প্রকাশনার তারিখও না। সবশেষে এটাই বলা যায় রবীন্দ্রনাথ নিজের ভুল বুঝতে পারলেও কার্যত তার কোনো সংশোধন আর হল না…

কৃতজ্ঞতা- বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।
Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.