সংসদীয় গণতন্ত্র, বা Parliamentary Democracy, আমাদের পূর্বতন শাসকদের থেকে ধার করা শাসনপদ্ধতি, স্বাধীনতার প্রায় ৭৩ বছর পর যা নানা ঝড়ঝাপটা সয়েও টিকে আছে, যা বিশ্বের কাছে এক বিস্ময় বটে। ১৯৫০ সালে ভারত Republic হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর, যা ভারতের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে এসেছে। ভারতের রাজনৈতিক চরিত্র নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। কিন্তু, ভারতের এক মাঝারি অঙ্গরাজ্যের চেয়েও ছোট দেশ ব্রিটেনে যে শাসন পদ্ধতি কাজ করে, ভারতের মতো বিশাল ও বহুমাত্রিক দেশে, তা কেমন করে খাটবে, সেটা একটা বড় প্রশ্ন। সেই কারণে, প্রত্যেক অঙ্গরাজ্যের নিজস্ব সংসদীয় কাঠামো তৈরি করা হয়, যা ‘বিধানসভা’ নামে পরিচিত।

এইখানে ভারতের Federal Structure নিয়ে প্রশ্ন আসবে। ভারত কি সেই অর্থে Federal বা যুক্তরাষ্ট্র?
ভারতের সংবিধানের পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, ভারত একটি যুক্তরাষ্ট্র with a Strong Central Government। অর্থাৎ, রাজ্যের নিজস্ব আইন প্রণয়নের ক্ষমতা থাকলেও কোষাগার, সেনাবাহিনী, বিদেশনীতি, ইত্যাদির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন্দ্রের অধীনেই।
কিন্তু, তারপরেও প্রশ্ন থেকে যায়, সেই বিধানসভা গুলির ক্ষমতা কতটা ? আজকে সংসদে কোনো আইন পাশ হলে, রাজ্যগুলির কি কোন এক্তিয়ার থাকে তা এড়িয়ে যাওয়ার বা তাতে কিছু সংশোধনী এনে তা রাজ্যে লাগু করার ? এককথায়, না। এবং ভারতের সংসদের এই ক্ষমতাকে কাজে লাগিয়েই আমরা দেখেছি কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় স্বার্থ কায়েম করার জন্য, এই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কে হাতিয়ার করে Centralization of Power এর মতো কাজ করে এসেছে। ইন্দিরা গান্ধী থেকে নরেন্দ্র মোদী সকলেই এই কাজে নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শন করে এসেছেন। উদাহরণ হিসেবে, ‘জরুরি অবস্থা’ বা বর্তমানের ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৯’ এর মতো উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। ইন্দিরা গান্ধী ঠিক যে পদ্ধতিতে দেশের বেশির ভাগ ‘’Key Instruments” কেন্দ্রিয় ক্ষমতায় এনেছিলেন। দ্বিতীয় মোদী সরকারও একই ভাবে রাজ্যের এক্তিয়ার গুলো কেন্দ্রের এক্তিয়ার করে নিচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ, ‘GST’, ‘এক দেশ এক রেশন কার্ড’, ‘জাতীয় শিক্ষা নীতি’ এগুলোর কথা বলা যায়।
তাহলে প্রশ্ন তুলতে হয়, সমস্যা কোথায় ? তাহলে বলতে হয় সমস্যা আমাদের সংবিধান। ভারতের সংবিধান পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এবং জটিল দলিল বলে স্বীকৃত। সংবিধানের Competency নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই কারুর ই, কিন্তু Application নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। যার যখন ক্ষমতা বেড়েছে, সে সেভাবেই সংসদকে দলীয় শক্তিবৃদ্ধির কাজে ব্যবহার করে এসেছে।

স্বাধীনতার পরের, যে যে সরকার আসুক না কেন, যে দলেরই সরকার, তারা দেশের উন্নতি এনং দেশের মূল সমস্যা (দারিদ্র, অশিক্ষা, স্বাস্থ্য) নিয়ে ভাবার থেকে নিজেদের ক্ষমতা কায়েমে বেশি নজর দিয়ে এসেছে। কিভাবে গদিতে টিকে থাকা যায়, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলির মূল ভাবনা সেটাই। দেশের প্রবীণ নেতারা নবীন নেতাদের কোনোভাবেই জায়গা ছেড়ে দিতে রাজি নন। এমন কোন দল নেই যেখানে এই নিদর্শন নেই। অবশ্য, বর্তমান বিজেপি কে নিয়ে এই কথা বলা যায় না, প্রায় সৃষ্টির সময় থেকে Second-in-Command এ থাকা লালকৃষ্ণ আডবাণী ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের আগে কেন্দ্রিয় রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ নরেন্দ্র মোদীকে প্রধানমন্ত্রির আসন ছেড়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেননি। বা মনে মনে করলেও, বাইরে কোনোভাবেই তা প্রকাশ করেননি। অপরদিকে, কংগ্রেস এখন ১০ জনপথের মুখাপেক্ষি হওয়া থেকে বেরোতে পারেনি। এখনো গান্ধী পরিবারের সদস্যরাই শেষ কথা বলেন সেখানে। যে কারনেই জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মতো নতুন প্রজন্মের নেতাদের দল ছেড়ে দিতে হয়, সচিন পাইলটকে, নিজের দলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে হয়।
স্বাধীনতার ৭৩ বছর পর তাহলে কি সময় এসেছে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বদল আনার ? ক্ষমতা প্রদর্শন থেকে সরে এসে মানুষের জন্য কিছু কাজ করার ?
৭৩ বছর পরও স্বাধীন দেশের নাগরিককে কেন এই প্রশ্ন তুলতে হয়, এটাই অবাক করার বিষয়।

Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.
বিশেষ ধন্যবাদ: রূপদত্তা চৌধুরী
ছবি: Deccan Herald, National Herald, RVCJ Media