জনগণ পথপরিচায়ক জয় হে
আমাদের জাতীয় সংগীত, আমাদের এক অমূল্য সম্পদ। এই কারণে নয়, যে কোনো এক Whatsapp Forward এ বলা হয়েছে যে আমাদের জাতীয় সংগীত পৃথিবীতে শ্রেষ্ঠ জাতীয় সংগীতের সম্মান পেয়েছে, তা এই কারণে, আমাদের সংবিধানের পর এই আরেকটি গ্রন্থনা, যেখানে ভারতবর্ষের রূপ বা ” The Idea of India” প্রতিফলিত হয়। সেটা ঠিক কি ?

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ প্রবন্ধে বলছেন,
“ভারতবর্ষের প্রধান সার্থকতা কী, এ কথার স্পষ্ট উত্তর যদি কেহ জিজ্ঞাসা করেন সে উত্তর আছে; ভারতবর্ষের ইতিহাস সেই উত্তরকেই সমর্থন করিবে। ভারতবর্ষের চিরদিনই একমাত্র চেষ্টা দেখিতেছি প্রভেদের মধ্যে ঐক্যস্থাপন করা, নানা পথকে একই লক্ষ্যের অভিমুখীন করিয়া দেওয়া এবং বহুর মধ্যে এককে নিঃসংশয়রূপে অন্তরতররূপে উপলব্ধি করা–বাহিরে যে-সকল পার্থক্য প্রতীয়মান হয় তাহাকে নষ্ট না করিয়া তাহার ভিতরকার নিগূঢ় যোগকে অধিকার করা।”
গানটির পাণ্ডুলিপি পাওয়া যায়নি। যদিও গানটি প্রথম ‘ভারত-বিধাতা’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল আদি ব্রাহ্মসমাজের মুখপত্র ‘তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা’র ১৯১২সালের জানুয়ারি মাসের মাঘ সংখ্যায়। সেই বছর গানটি মাঘোৎসবেও গাওয়া হয়েছিল। যদিও গানটি ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হওয়ার আগেই ২৭ ডিসেম্বর ১৯১১ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ২৬তম বার্ষিক অধিবেশনে প্রথম গাওয়া হয়েছিল। এই তথ্য প্রকাশিত হয় ‘দ্য বেঙ্গলি’ পত্রিকায়। যেখানে গানটির ইংরেজি অনুবাদ যুক্ত করা হয়েছিল।পরে রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই গানটি ইংরেজি তে অনুবাদ করেছিলেন। এরপর রবীন্দ্রনাথ বহুবার এই গানটি নানা স্থানে গেয়েছেন।
তিনি আরো বলেছেন, “ভারতবর্ষ বিসদৃশকেও সম্বন্ধবন্ধনে বাঁধিবার চেষ্টা করিয়াছে। যেখানে যথার্থ পার্থক্য আছে সেখানে সেই পার্থক্যকে যথাযোগ্য স্থানে বিন্যস্ত করিয়া, সংযত করিয়া, তবে তাহাকে ঐক্যদান করা সম্ভব। সকলেই এক হইল বলিয়া আইন করিলেই এক হয় না। যাহারা এক হইবার নহে তাহাদের মধ্যে সম্বন্ধস্থাপনের উপায়-তাহাদিগকে পৃথক অধিকারের মধ্যে বিভক্ত করিয়া দেওয়া। পৃথককে বলপূর্বক এক করিলে তাহারা একদিন বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন হইয়া যায়, সেই বিচ্ছেদের সময় প্রলয় ঘটে।”
এই আমাদের ভারতবর্ষ। আমাদের ভারতবর্ষের মূল কথা। যুগে যুগে, কালে কালে, নানা ভাষা, নানা মতের লোক এই ভূখণ্ডে মিলে একে মহামানবের সাগরতীর বানিয়ে তুলেছেন। এটাই ভারত।
‘জনগণমন অধিনায়ক’ ভারতের এই জাতীয় সংগীতটি গাওয়ার সময় উচ্চারণ নিয়ে কেউ কেউ এমন মত প্রকাশ করেছেন যে, সর্বভারতীয় স্তরে এটির তৎসম উচ্চারণ করা হয় কেন? লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে গানটিতে যে শব্দগুলি ব্যবহৃত হয়েছে সেগুলি রবীন্দ্রনাথ নিজেই তৎসম শব্দ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে অবাঙালিরা গানটি গাওয়ার সময় যে তৎসম উচ্চারণ করেন তা কিন্তু ভ্রান্ত নয়।
প্রথমে স্বরবিতান ১৬ তে গানটির একটি স্বরলিপি প্রকাশিত হয় সেখানে গানের সুরের মূল রাগ ছিল ইমন ও তাল কাহারবা। এই স্বরলিপি করেছিলেন দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু পরবর্তীকালে ভারত সরকার এই গানটির যে সুরটিকে জাতীয় সংগীত হিসেবে অনুমোদন দেন সেটি বিশ্বভারতী থেকেই ‘রাষ্ট্র সংগীত’ নামক পৃথক একটি গ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
‘গীতবিতান’-এ গানটি ‘স্বদেশ’ পর্যায়ের১৪ নম্বর গান হিসাবে স্থান পেয়েছে। আবার ‘সঞ্চয়িতা’ কবিতা সংকলনেও ‘ভারত বিধাতা’ নামে গানটি প্রকাশিত।

১৯৩৭ সালে এই গানটি জাতীয় সংগীত হিসেবে নির্বাচন করেন সুভাষচন্দ্র বসু। আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রথম দিনেই গানটি গাওয়া হয়েছিল। পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র এই গানটির হিন্দি অনুবাদ করিয়েছিলেন আনন্দমোহন সহায়কে দিয়ে। এই অনুবাদে মূল গানের বাণীর সাথে, কিছু পার্থক্য ঘটে ছিল। এরপর আজাদ হিন্দ বাহিনী ইম্ফল দখল করলে, সেখানে এই গানটি কে প্রথম জাতীয় সংগীত হিসেবে গাওয়া হয়েছিল।
পরবর্তীকালে ‘৪৭ সালে যখন নিশ্চিত হয় যে ভারত স্বাধীন হতে চলেছে তখন কিন্তু ঘোষিত ভাবে ভারতের কোন জাতীয় সংগীত ছিলনা। এর কিছু পরে জাতিসংঘ ভারতের জাতীয় সংগীতের রেকর্ড চাইলে তখন সেখানে এই গানটির একটি রেকর্ডকেই জাতীয় সংগীত হিসেবে পাঠানো হয়। পরে স্বয়ং জওহরলাল নেহেরু’ই এই গানটি কে জাতীয় সংগীত হিসাবে গ্রহণ করার প্রস্তাব করেন। পরবর্তীকালে গাওয়ার দিক থেকে ‘বন্দেমাতারাম’-এর থেকে ‘জনগণমন’-এর সারল্যের কারণেই এই গানটি কেই জাতীয় সংগীত হিসাবে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। এছাড়াও অনেকের মতে ‘জনগণমন’গানটি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সকলের কাছেই বেশি গ্রহণযোগ্য হবে তাই ১৯৫০ সালের ২৪ জানুয়ারি তারিখে সংবিধান সভায় এই গানটি কে জাতীয় সংগীত হিসেবে গ্রহণ করা হয় ।
তবে সে ক্ষেত্রে একটি বিতর্ক উঠেছিল যে, এই গানটি নাকি রচিত হয়েছিল ১৯১১ সালে ইংল্যান্ডের রাজা পঞ্চম জর্জের বন্দনা হিসাবে। তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর সময়েই পুলিনবিহারী সেনকে লেখা এক চিঠিতে এই বিতর্কে উত্তর নিজেই দিয়ে গিয়েছিলেন সেখানে তিনি বলেছিলেন যে, সত্যি সত্যি তাঁকে পঞ্চম জর্জের আহ্বান সঙ্গীত রচনার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল, কিন্তু তিনি সেই ভারতভাগ্যবিধাতার জয়গানই লিখেছিলেন যিনি পতন-অভ্যুদয়-বন্ধুর পন্থায় যুগ যুগ ধাবিত যাত্রীর চিরসারথী, যিনি জনগণের অন্তর্যামী পথপরিচায়ক – সেই পরম রাজাধিরাজ-এর সামনে যেকোনো সম্রাট ম্লান হয়ে যায়। তাই একথা স্পষ্টতই বলা যায় যে এ গান সেই রাজেশ্বর-এরই যিনি এই ভারতের যথার্থ ভাগ্যবিধাতা।
Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.