কলমঞ্জিররঞ্জিনী – সম্পাদকীয়


যাও যাও গিরি আনিতে গৌরী, ঊমা বড় দুখে রয়েছে
দেখেছি স্বপন নারদ বচন, ঊমা মা মা বলে কেঁদেছে..

সবাইকে বা সবকিছুকে নিজের মনের মত করে সাজিয়ে গুছিয়ে নেওয়া বাঙালীর চিরাচরিত স্বভাব। তার সবচেয়ে বড় নিদর্শন বোধহয় এই দেবী দুর্গাকে ঘরের মেয়ে করে নেওয়া। ত্রিনয়নী, দশভূজা, অসুর বিনাশিনী কোনও পূজ্য দেবী মূর্তিকে কাছে টেনে একেবারে অন্দরের সুখদুঃখের ভিতর দিয়ে আপন করে নেওয়া, এ শুধু এই রাজ্যেই সম্ভব। তাই তো গিরিরাজের কাছে মায়ের আবেদন হয় মেয়েকে বাপের বাড়ি নিয়ে আসার। আর সংসারী মেয়ে ঊমা, সে কি আর একা আসে? তাই তো বছরে একবার বাপের বাড়ি আগমন একেবারে পুত্রকন্যা সমেত। এই অবসরেই তার আদর, যত্ন, পূজা, আরাধনায় মেতে ওঠেন আপামর বাঙালী।

দুর্গাপূজা অবশ্যই একটি শাস্ত্রীয় বিধি কিন্তু তার সাথে মিশে গেছে বাঙালির লোকজীবন এবং লোকসংস্কৃতি। প্রথমেই আসি দুর্গার অসুর বধের প্রসঙ্গে। যে দেবী দুর্গা মহিষাসুরকে বধ করেছেন তিনি হলেন মহামায়া আদ্যাশক্তি, যার উৎপত্তি হয়েছিল সমস্ত দেবতাদের শক্তি মিলিত হয়ে অর্থাৎ শিবের শক্তিও দুর্গার মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে। যদিও তাহলে একটা প্রশ্ন থেকেই যায় যে শিব দুর্গার স্বামী হল কোন যুক্তিতে? এক্ষেত্রে বলতে হয় যে শিব হচ্ছে এই মহাসৃষ্টির প্রথম পুরুষ আর দুর্গা অর্থাৎ মহামায়া হচ্ছে প্রথম নারী যাকে আমরা প্রকৃতি বলে থাকি। এর থেকেই বলা যায় যে নারী শক্তির অনন্ত প্রকাশ যদি দুর্গা হয় তাহলে পুরুষ শক্তির অনন্ত প্রকাশ হলেন শিব এবং সেই যুক্তিতেই এরা হলেন স্বামী- স্ত্রী। কিন্তু মজার বিষয় হচ্ছে, অদ্ভুতভাবে এই দুর্গাপুজোর সাথে অনেকগুলি পৌরাণিক কাহিনী এবং পাশাপাশি বাঙালির লোকসংস্কৃতির ভাবধারাও মিশে গেছে। অনেক জায়গাতেই উঠে এসেছে উমা প্রসঙ্গ। এবার বক্তব্য হলো, কে এই উমা? উমা হলেন হিমালয় ও মেনকার কন্যা যার আরো দুটি জনপ্রিয় ও প্রচলিত নাম আছে, গৌরী ও পার্বতী আর ইনিই হলেন শিবের দ্বিতীয়া স্ত্রী যার সাথে শিবের বিয়ে হয়েছিল দেবলোক রক্ষার্থে, কারণ যখন তারকাসুর স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করে তখন দেবতাদের প্রয়োজন পড়েছিল এক দেবসেনাপতির এবং শিবের ঔরসজাত পুত্র সন্তানই একমাত্র দেবসেনাপতি হতে পারত। তাই শিবের প্রথমা স্ত্রী দক্ষকন্যা সতীর মৃত্যু হলে শোকসন্তপ্ত শিব যখন ধ্যানমগ্ন, তখন সেই ধ্যান ভঙ্গ করে নানা প্রকারে উমার সঙ্গে শিবের বিবাহের সম্ভাবনা গড়ে তোলার চেষ্টা হতে থাকে। যদিও পরে গৌরী তপস্যা ও সাধনার নানা স্তর অতিক্রম করে শিবকে তৃপ্ত করেন এবং তার সাথে শিবের বিয়ে হয়। এই উমার এবং শিবের দুজন সন্তান – একজন কার্তিক আরেকজন গণেশ। অর্থাৎ লক্ষ্মী ও সরস্বতী – র সাথে শিবের কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। তাহলে দাঁড়াচ্ছে উমা হল কার্তিক ও গণেশের মা। তাহলে উমার সমান সমান দুর্গা, কিন্তু দুর্গার আবার দুজন মেয়ে আছে – লক্ষ্মী ও সরস্বতী। তাদের সাথে উমার কোন রক্তের সম্পর্ক নেই। আসল ব্যাপারটা হলো এইরকম, যে অকালবোধন যেটাকে আমরা দুর্গাপুজো বলি বা শারদ উৎসব বলে থাকি সেটা হল আদ্যাশক্তি মহামায়ারই পুজো, কিন্তু বাঙালি সেই পুজোটার সাথে নিজের একটা ইমোশনকে জড়িয়ে দিয়েছে যেখানে দুর্গা হয়ে উঠেছে উমা অর্থাৎ আমাদের ঘরের মেয়ে এবং শিব হচ্ছে একেবারে অনুপযুক্ত জামাই। মেনকার তাই প্রচন্ড দুশ্চিন্তা এবং সেইজন্য তিনি হিমালয়কে পাঠিয়েছেন শিবের কাছে চার দিনের জন্য মেয়েকে ঘরে আনবেন বলে। অর্থাৎ ষষ্ঠী তে যে পুজোটিকে অধিবাস বলা হয়, যেখানে আমরা সকলেই দেখতে পাই একটি বেল গাছের ডালকে শিবরূপে পুজো করে পুজোর অনুমতি নেওয়া হচ্ছে সেটি কিন্তু দুর্গার অসুর বধের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়। দুর্গা অসুর কে বধ করেছিলেন নবকল্পে অর্থাৎ ষষ্ঠীর ৫ দিন আগে বা প্রতিপদ থেকেই দুর্গাপুজো আক্ষরিক অর্থে শুরু হয়ে যায়। অবাঙালীদের মধ্যে সেই প্রচলনও আমরা দেখতে পাই, যেটাকে আমরা নবরাত্রি বলি। কিন্তু চারদিন ধরে বাঙালিদের মধ্যে যে পুজো হয় সেটা দুর্গার অসুর বধ বৃত্তান্ত বর্ণিত চন্ডী অনুসারেই হয়।

আমাদের কলকাতায় জাঁকজমক করে দুর্গাপূজার সূচনা শোভাবাজার রাজবাড়ির রাজা নবকৃষ্ণ দেবের হাত ধরে। নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মুনশি ছিলেন নবকৃষ্ণ। ১৭৫৭ সালে, পলাশীর যুদ্ধের বিজয়োৎসব ও ইংরেজ তোষণের উদ্দেশ্যেই ছিল এই আয়োজন। তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেনাপতি ও বড়লাট রবার্ট ক্লাইভ হাতির পিঠে চেপে, দলবল নিয়ে এই পূজায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু যতই তোষামোদের অভিপ্রায় থাকুক, বাড়ির মেয়েকে কি বিদেশীর সাক্ষাতে আনা যায়? তাই তো দেবী প্রতিমার মুখের সামনে পড়ল হাল্কা চিকের আবরণ।

এরপর থেকে ধীরে ধীরে বিভিন্ন জমিদার পরিবারগুলি বা তথাকথিত কলকাতার বাবুদের মধ্যে শুরু হয় এক অলিখিত প্রতিযোগিতা – বৈভব ও প্রাচুর্য প্রদর্শনে একে অপরকে টেক্কা দেওয়ার খেয়াল। জার্মানি ও প্যারিস থেকে ডাকযোগে আসতে আরম্ভ করল প্রতিমার সাজ, যা ডাকের সাজ নামে প্রচলিত হল। ছাতুবাবু, লাটুবাবুর বাড়িতে বসত বহুল খরচের বুলবুলির লড়াই। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির পুজোয় দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমলে অনুষ্ঠিত হত সঙ ও যাত্রাপালা। দুর্গা প্রতিমা সজ্জিত হত স্বর্ণালঙ্কারে আর সেই গয়না সমেত প্রতিমা নিরঞ্জন হত বিজয়া দশমীতে। শিবকৃষ্ণ দাঁ মহাশয় বিশেষ ব্যবস্থায় সুদূর ইওরোপ থেকে নিয়ে আসতেন হিরে-চুনির গয়না। তৎকালীন বঙ্গসমাজে কথিত ছিল যে মা দুর্গা এসে গয়না পড়েন শিবকৃষ্ণ দাঁর বাড়িতে, ভোজন করেন অভয়চরণ মিত্রের বাড়িতে আর রাতে নাচগান দেখেন শোভাবাজার রাজবাড়িতে।

এখনকার পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেলে যে সার্বজনীন বা বারোয়ারি দুর্গা পূজা হয়, বাংলায় তার শুরু ১৭৯০ সালে। হুগলীর গুপ্তিপাড়ায় ১২জন ব্রাহ্মণ বন্ধু বা ‘ইয়ার’ মিলে টাকা পয়সা জড়ো করে শুরু করেন এই দুর্গা পূজার চল। ১২ ইয়ার মিলে পুজো বলে নাম প্রচলন হয় বারোয়ারি পুজো। কলকাতায় অনেক পরে ১৯০৯ সালে আয়োজিত হয় বারোয়ারি দুর্গোৎসব, ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার উদ্যোগে।

এই বাংলারই কিছু প্রত্যন্ত কোণে কিন্তু এইসময় পালিত হয় অসুর বন্দনা। কোনও আদিবাসী গোষ্ঠীর বিশ্বাস এই মহিষাসুর ছিলেন আদিবাসীদের এক অসমসাহসী, যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী দলনেতা যিনি একার বিক্রমে পরাস্ত করেছিলেন আর্‍্য্ অনুপ্রবেশকারীদের যারা পরে তাদের মহিলা সেনানীকে পাঠিয়ে পরাস্ত ও হত্যা করে এই বীরের। তাই এইসময় এরা তাদের বীর সেনাপতি অসুরের আরাধনায় রত হয়।
এভাবেই, পুরাণের সাথে মিলে গেছে, গল্পগাথা, সমাজ চালচিত্র, রীতি, বিশ্বাস, লোকাচার আর অবশ্যই সংস্কৃতি। কত পালাগান, নাটক, আগমনী, লোকসঙ্গীতের রচনা হয়েছে এই উৎসব ঘিরে, লেখা হয়েছে কত শত চরিত, সুখদুঃখ, জীবনবোধ, ভালবাসার উপাখ্যান। দুর্গা পুজাও বদল করেছে তার চরিত্র- ধীরে, ধীরে সময়, কালের বিবর্তনের নিয়মে যা আজকের ‘ম্যাগ্নাম ওপাস্’এ রূপান্তরিত। বদল ঘটেনি বোধহয় শুধু একে ঘিরে বিশ্বজোড়া বাঙালির আবেগের, বছরভর প্রতীক্ষার।

চিত্রশিল্পী :- শুভ্রদীপ আকাশ (অঙ্কন)।
চিত্রঋণ :- যামিনী রায় ও ঠনঠনিয়া দত্ত বাড়ি।

Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.