(অ)সামাজিক দূরত্ব – অর্ক সান্যাল

আমি ধন্যবাদ জানাবো না। ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, সৈনিক, কাউকে ধন্যবাদ জানাবো না।

কি বলছেন? আমি কোন রং? কোন পার্টি? কোন জাত?

আমি বেকার, কিন্তু নির্বিকার নই।

আমি সেই লোক, যার জীবিকা ছিল এক সময়। যে ট্রেনে, বাসে যাতায়াত করতো রোজ গন্তব্যে। রাজনৈতিক আলোচনার ঝড় তুলতো চায়ের দোকানে।

পকেটমার পেটানোর ভীড়ে মিশে গিয়ে, নৈরাশ্যের মৈথুন করত লাথি মেরে।

আমি সেই মুখ, যার মুখোশ খবরের কাগজ। কোন কাগজ? থাক সে কথা।

এখন সেই মুখ আর কাগজের মাঝে জায়গা নিয়েছে মাস্ক, আর পকেটমার ও ভিড়ের মাঝে Social Distancing.

বড় ভয়ংকর শব্দ এই “সামাজিক দূরত্ব”। ইংরেজী তর্জমায় “শারীরিক দূরত্ব” প্রতিষ্ঠা করাই শ্রেয় ছিল বোধ হয়। আর সমাজ তো আমাদের পকেটে থাকে – সেল ফোনে, সামাজিক মাধ্যমে।

যখন এই লেখা লিখেছিলাম, অর্থাৎ করোনা পরিস্থিতি, লকডাউন চলছে,কোনো এক সংবাদ মাধ্যমে দেখানো হল, “করোনায় মৃতদের জন্য গণ কবর খোঁড়া হচ্ছে”, আর তার পরেই বিজ্ঞাপনী বিরতি, কোনো এক বেসরকারি কলেজের অ্যাডমিশন বিজ্ঞাপন, ট্যাগ লাইন – “সামাজিক দূরত্ব মেনে ক্লাস নেওয়া হয়”।

করোনার ভ্যাকসিন না এলেও, করোনার বাজার এসে গেছে প্রস্তুত হয়ে। সেই বাজারে সামনে নতজানু আমি, মাস্ক পরে প্রাণপনে হাতে স্যানিটাইজার ঘষে যাচ্ছি, আর গাল পারছি সবাইকে। আমার বাজার আমায় তাই শেখায়।

যেভাবে বাইক চালালে সিগন্যাল দেখলে হেলমেট পড়তে হয়, সেভাবে মাস্কটাও পরি আজকাল, পুলিশ দেখলে।

আমার তিনটে বাড়ি পার করে একটি মেয়ে থাকে, পেশায় এক চোখের হাসপাতালের  নার্স।

সেদিন পাড়ার কুকুরগুলোকে খেতে দিচ্ছিলাম। অসহায় জীব, বেচারারা খেতে পায় না।

হঠাৎ দেখলাম মেয়েটি আসছে। আমি খাবার অর্ধেক দিয়েই ঘরে ঢুকে এলাম। কে বলতে পারে কোন জার্ম নিয়ে আসছে? আমি নিজেকে নিয়ে ভাবি না কিন্তু,বাড়িতে বুড়ো বাবা মা আছে কিনা। ইমিউনিটি বলেও তো একটা বিষয় আছে।

কাজ কারবার বন্ধ। এখন সারাদিন শুধু খবর শুনি, রান্না-বান্না করি, ঘর পরিষ্কার করি। আর রাগ ধরলেই প্রশাসনের উত্তম মধ্যম করি, মনে মনে। মুশকিল হচ্ছে, এখন করোনার ভয়ে পকেটমাররাও আর বেরোয় না, তাই ধরাও পড়ে না। তাহলে ? এদিকে হাতের অস্বস্তি তো বাড়ছে ভিতরে ভিতরে।

তক্কে তক্কে ছিলাম। সেদিন পাশের পাড়ায় কিছু একটা গোলমাল হল। গোলমালটা ঠিক কি হয়েছিল আমি জানি না। তবে মুখে রুমাল বেঁধে আমিও ভিড়ে মিশে গিয়ে কিছু পুলিশকে পিটিয়েছিলাম। তারপর সেই ভিড় গেল হাসপাতাল ভাঙতে। আমি আর অতটা পথ হাঁটলাম না। বাড়ি চলে এলাম। কুড়ি সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে হবে তো।


আমি শান্তি প্রিয় মানুষ। যুদ্ধে বিশ্বাসী নই। শুনছি নাকি আমাদের দেশের সীমান্তে কি সব গোলমাল হচ্ছে।সৈন্যরা খুব লড়ছে। বেশ একটা রোমাঞ্চ হয় যুদ্ধের সিনেমা দেখলে।

আমি আর্মিতে যাবো ভেবেছিলাম, জানেন? কিন্তু ঐ, হাইট টা।

না! আমার কোনো নিকট আত্মীয়কে এই পরিস্থিতিতে বাইরে কাজে বেরোতে হচ্ছে না। বেশিরভাগই তো Work from home.

পুলিশের হয় না, না? work from home?

ডাক্তারদের? আমার প্রতিবেশী মেয়েটার? নার্সদের?যারা সাফাই কর্মী, তাদের? 

ইমারজেন্সি সার্ভিস তো।

কিন্তু আমারও তো একটা ইমারজেন্সি আছে। আমার জল চাই, কারেন্ট চাই, রেশন চাই, ইন্টারনেট চাই, Covid টেস্ট চাই ;

নইলে?

নইলে ভোট দেবো না কিন্তু।

আমার এক বন্ধু Micro Biology নিয়ে কি সব রিসার্চ-টিসার্চ করে, বলছে নাকি এই করোনা পরিস্থিতি কোনোদিন ই স্বাভাবিক হবে না।

মানে হবে; কিন্তু একটা অন্য রকম স্বাভাবিক, যা আমরা আগে দেখিনি। কিন্তু নিজের সমস্যা হলে এই সমস্ত জরুরী পরিষবা কর্মীদের গায়ে হাত তোলার স্বাভাবিক ঘটনার কোনো পরিবর্তন হবে না আশা করি।


একবার, একটা ধরা-পড়া-পকেটমার আধমরা অবস্থায় দেখে জিজ্ঞেস করেছিলাম “হ্যাঁ রে, তোদের লজ্জাও হয় না, এরপরও চুরি করিস?”

আজকাল আমার সবাইকে ডেকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে,”লজ্জা হয় না?”

যে পুলিশটার সেদিন মদের দোকানের সামনে ভিড় নিয়ন্ত্রন করার অপরাধে মাথা ফাটল, তাকে বলছি, “লজ্জা হয় না?”

বাড়িতে পরিজনকে রেখে যে ডাক্তার গত পনেরো দিন ধরে হাসপাতালের এই বেড থেকে ওই বেড দৌড়াচ্ছেন, তাকেও বলছি, “লজ্জা হয় না?”

যিনি সারাদিন জীবাণুমুক্ত করছেন চারপাশ, যিনি ল্যাবরেটরিতে বসে আছেন টেস্ট কিট হতে, যিনি সরকারে আছেন, যিনি বিরোধী দল, যিনি শিক্ষক, যিনি কেরানী, আমার পাশের বাড়ির নার্স মেয়েটি, আপনাদের সবাইকে বলছি, “লজ্জা হয় না?”

এত মার খেয়ে, অপমান সহ্য করে, পরিবারকে বাজি রেখেও আপনারা আমায় বাঁচতে আসছেন?

আমি কিন্তু এত সহজে গলছি না। ভুল আমি ধরেই যাবো।

যাকগে, গা টা কেমন গরম গরম লাগছে, একবার ডাক্তারকে ফোন করতে হবে, কি আছে কপালে কে জানে?

আমার তো নিজেকে নিয়ে চিন্তা নেই, চিন্তা বাকিদের নিয়েই।

ও হ্যাঁ, শুরুতে বলেছিলাম মনে আছে? এই জরুরী পরিষেবা যারা দেন, তাদের ধন্যবাদ আমি জানাবো না।

আচ্ছা, আপনি কখনো আপনার মা কে ধন্যবাদ জানিয়েছেন?কটু কথা তো অনেকবার বলেছেন, না? অনেক সময় অনেক খারাপ কিছু ভেবেছেন। আপনার ভূমিষ্ঠ হবার সময়ের লেবার পেনের সহানুভূতি জানিয়েছেন মা কে? তারপরেও তো মায়ের “লজ্জা করেনি” আবার আপনার ভালো চাইতে।

তাই বলছিলাম, আমি ধন্যবাদ জানাবো না।            

                                                               

লেখক পরিচিতি: অর্ক সান্যাল, একজন অর্থনীতির ছাত্র ও প্রভু জগদবন্ধু কলেজে অতিথি অধ্যাপক। পড়াশুনার পাশাপাশি নাট্যশিল্পে তাঁর যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি। তিনি একজন অভিনেতা, নাট্যরচয়িতা এবং পরিচালক।

Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.

Pictures: The Indian Express, Zee News, The Times of India

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.