‘ঘুম আমার ভালো হয়েছে’- ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে যদি কেউ বলে তাহলে কি অবাক হবো? না কোন এক স্বাভাবিক নিয়মে বাক্যটিকে প্রত্যাখ্যান করবো চেনা বাক্য বলে অথবা কেউ যদি বলে গতকাল রাত্রে ঘুমের মধ্যে ‘আমি জাপান দেশে ভ্রমণ করছিলাম’ অথচ জাগ্রতাবস্থায় ঐ একই ব্যক্তি কলকাতাতে অবস্থিত। আপাতদৃষ্টিতে প্রত্যাখ্যানের নিরিখে সর্বাধিক অগ্রগন্য ‘জাপানে ভ্রমণ অবস্থা’ বাক্যটি। এখন প্রশ্ন, এই ভাবে কি কোনো অবস্থাকে খুব সহজে প্রত্যাখান করা সমীচিন? বা, বাক্যের অন্তরালে সুপ্তাকারে কোনো অর্থ লুকিয়ে আছে যা তাত্ক্ষনিক ভাবে কোনো শক্যার্থকে নির্দেশ না করে লক্ষনার্থক কোন বিষয়কে নির্দেশ করছে। বস্তুত, কোন ব্যক্তির কলকাতাতে থেকেও স্বপ্নে জাপানে ভ্রমণ প্রত্যক্ষভাবে জাপানে ভ্রমণ না বোঝালেও পরোক্ষভাবে হয়তো অন্য কোন সূত্রের জন্ম দিচ্ছে যেমন ভাবে অন্নপূর্ণা তাঁর স্বামীর পরিচয় দিয়ে বলেছিল ‘ কোনো গুণ নেই তাঁর কপালে আগুন ‘ অর্থাৎ শিব (মঙ্গল)। সুতরাং, সর্বদা শব্দের একরকম অর্থই পদবাচ্য হবে তা নয় বরং পরিস্থিতি ভেদে তার প্রকাশ ভিন্ন ভিন্ন হয়। এই প্রবন্ধে মূলত স্বপ্নের এইদিকটির উপর আলোকপাত করা হবে।

এখন দেখা যাক স্বপ্ন কি? এককথায় কমবেশি করে এই জগতের প্রত্যেকেই এই শব্দটির সাথে কোনো না কোনোভাবে পরিচিত। এখন প্রশ্ন হল ঠিক কি রকম ভাবে পরিচিত? স্বপ্ন কি কেবল একটি মিথ্যা অথবা ভ্রান্তাবস্থা না কি জাগ্রতের সাথে সমতুল্য কোন এক অবস্থা? এইরূপ নানাপ্রশ্ন ‘স্বপ্ন’ শব্দটা উচ্চারণের সাথে সাথে আমাদের মাথায় আসে।
স্বপ্নকে যদি কেবল মিথ্যাবস্থা বা ভ্রান্তাবস্থা বলি তাহলে খুব সহজেই জাগ্রতাবস্থা প্রাধান্য পায় সত্যতা প্রমাণের বিচারে। কিন্তু সত্যিই কি স্বপ্ন মানেই নিছক মিথ্যাবস্থা বা ভ্রান্তাবাস্থা? কিন্তু খুব সহজে মিথ্যাবস্থা বা ভ্রান্তাবস্থা বলা যায় না কারণ নিছক মিথ্যাবস্থা হলে সর্বদাই তা মিথ্যারূপে প্রতিপন্ন হবে, কিন্তু তা কি হয়?
জীবনের চলার পথে অনেক সময় নাম না জানা পথকে খুঁজে পাওয়া যায় কোন এক স্বপ্নের হাতছানিতে। অনেক সময় জাগ্রতাবস্থার সমস্যার সমাধান হয়ে যায় স্বপ্নে আগত ঘটনার নিরিখে। যদি স্বপ্ন একটি মিথ্যাবস্থা হয় তাহলে এই সমাধানকে আমরা গ্রহন করি কেন? কেন আমরা মিথ্যা বলে প্রত্যাখ্যান করি না?
এইরূপে অনেক অপ্রত্যাখ্যানই ইতিহাসে সত্যরূপে প্রতিপন্ন হয়েছে। যেমন – জার্মান প্রখ্যাত রসায়নবিদ ফ্রেডরিক অগাস্ট কেকুলে ১৮৬৫ সালে স্বপ্নে সর্বপ্রথম ‘বেনজেন্ মলিকিউল’ –র গঠন দেখতে পায় যা আজ সমগ্র বিশ্বে সমাদৃত। এইরূপে নিত্যনৈমিত্তক নানা ঘটনার সমাধান খুঁজে পাই স্বপ্নতে।
আবার, স্বপ্নকে নিছক ভ্রমও বলা যায় না কারণ. ভ্রম হতে গেলে অন্তত দুটি বস্তুর উপস্থিতি প্রয়োজন তা উভয় আন্তঃ, উভয় বহিঃ অথবা একটা আন্তঃ একটি বহিঃ। ভ্রমের ক্ষেত্রে একটি বস্তু সত অর্থাৎ সত্য আর আরোপিত বস্তুটি মিথ্যা। অদ্বৈত বেদান্ত মতে আধার সর্বদা সত্য, আরোপিত বস্তু হল মিথ্যা কারণ তা পরিবর্তনশীল। যেমন ভাবে রজ্জু-সর্প ভ্রমে রজ্জু সর্বদা সত্য কিন্তু আরোপিত সর্প মিথ্যা।
স্বপ্নে দৃশ্যত সমস্ত ঘটনা ভ্রমের মত নয় কারণ যা স্বপ্নে দেখতে পাওয়া যায় তা ঠিক একটির উপর আর একটি আরোপিত নয়। এখন যদি স্বপ্নকে ভ্রম বলতে হয় তাহলে জাগ্রতাবস্থাকেও বলতে হবে ভ্রম কারণ অদ্বৈত সম্মত একমাত্র সত্য হল ব্রহ্ম। ব্রহ্ম ছাড়া সকল কিছুই মিথ্যা। তবে এইরূপ উপলব্ধি অতিন্দ্রিয় (Transcendental reality) জগতে হয়ে থাকে। ব্যবহারিক জগতে (Phenomenal reality) জাগতিক বস্তু সত অর্থাৎ স্বপ্নের বস্তুগুলিও সত। মাত্রাগত দিক থেকে জাগ্রত ও স্বপ্ন উভয় অবস্থাই সমান কারণ মান্ডুক্য উপনিষদে উল্লেখিত হয়েছে স্বপ্ন ও জাগ্রতে আমাদের শরীরে সপ্তাঙ্গ ও উনিশটি উপকরণ সমানভাবে ক্রিয়াশীল।
সুতরাং, স্বপ্ন হল একটি অবস্থা যা জাগ্রতাবাস্থার মত প্রকট না হলেও অপ্রকটরূপে সত্য আর অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এটি নিছক একটি মিথ্যা অবস্থা হলে অধিবিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্বে এতটা অপরিহার্য অবস্থারূপে বিবেচ্য হত না।

এখন অনুসন্ধান করা যাক স্বপ্ন আসার কারণ ঠিক কি কি হতে পারে। এটি কি একটি আগন্তুক অবস্থা না কি কোন এক বহমান ধারা যা নির্দিষ্ট সময় প্রকট হয় কোন ইচ্ছাপূরণের আশায়। ইচ্ছাপূরণ বলতে কি বোঝায়? সহজ করে বললে অবদমিত চাওয়া পাওয়ার ভেলায় ভেসে আসা ঘটনাকেই পূর্ণতা দেয় স্বপ্নাবস্থা। স্বপ্ন এমন একটি অবস্থা যেখানে চেনা বিষয়কে যেমন নতুন করে চেনা যায় তেমনি অনেক অচেনাও পরিচিতি পায় ঘটনার অনুসঙ্গবদ্ধতার নিরিখে অর্থাৎ ঘটনাটি ঠিক কি ভাবে উপস্থাপন হচ্ছে তার উপর দাঁড়িয়ে আছে অনুভূতিগুলি। অনুভূতিগুলির মধ্যে মাত্রাগত ভাবে কোন পার্থক্য নেই জাগ্রতাবস্থার সাথে। পার্থক্য কেবল ব্যবহারের নিরিখে অর্থাৎ জলের পাত্রটার স্থানান্তরণ সম্ভব জাগ্রতাবস্থায় এবং তাঁর দ্রষ্টা সম্মুখে উপস্থিত অনেকে হতে পারে কিন্তু স্বপ্নে দ্রষ্টা শুধু যে স্বপ্ন দেখছে সে একা।
ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায় বিভিন্নভাবে স্বপ্নের কারণের ব্যাখ্যা দিলেও মূলত তিনটি কারণের অবতারনা করা হয়েছে। যেমন – (১) সংস্কারবশত , (২) শারীরিক অসুবিধে জনিত (বায়ু, পিত্ত ও কফ) এবং (৩) অদৃষ্ট।
জাগ্রতাবস্থায় অদেখা কোন বিষয় যদি স্বপ্নাবস্থাতে প্রথম আসে তাহলে অদৃষ্ট জন্য বলে মনে করা হয়ে থাকে, তবে এটি সর্বসম্মত কোন মত নয়।
এতদতিরিক্ত প্রাচীন মিশরীয় সাহিত্যে মনে করা হয় শুভ স্বপ্ন আসে ঈশ্বরের আশির্বাদ রূপে এবং অশুভ স্বপ্ন আসে ঈশ্বরের অভিশাপ রূপে।
জাগ্রতাবস্থার কারণ অনুসন্ধানে আমরা তত্পর হলেও অধিক আগ্রহী স্বপ্নাবস্থার কারণ অনুসন্ধানে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনেক সময় স্বপ্নে আগত উপকরণগুলি সুস্থতার কারণরূপে বিবেচিত হয়েছে যেমনভাবে ফ্রয়েডের চিকিৎসা পদ্ধতিতে আমরা বিভিন্ন উপায়ের পরিচয় পাই।

পরিশেষে বলা যেতে পারে, আমাদের অস্তিত্বের ধারণাকে বিশ্লেষণ করতে গেলে জাগ্রতাবস্থা ও স্বপ্নাবস্থা উভয়ই সমানভাবে গুরুত্ত্বপূর্ণ। তাই কখনই একবাক্যে বলা যায় না স্বপ্ন নিছক ভ্রম।
লেখক পরিচিতি :- নীলাদ্রি দাস
জে আর এফ, ভারতীয় দার্শনিক অনুসন্ধান পরিষদ, নিউ দিল্লী এবং গবেষক, দর্শন বিভাগ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা।
All rights reserved © Kothabriksha 2020