“প্রিয় বন্ধু,
যদিও আপনার সাথে আমার সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি, তাও আমি আপনাকে বন্ধু বলেই সম্বোধন করলাম। আমি জানি, ব্রিটিশ সরকারের কাছে আমি সবচেয়ে বড় শত্রু বলে পরিচিত, কিন্তু যেহেতু আমি নিজেকে মানুষের বন্ধু এবং সেবক বলে মনে করি, তাই আমি আপনাকে ব্রিটিশ ভারতের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি হিসেবে ‘বন্ধু’ বলেই সম্বোধন করছি।”
১৯৪৪ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ব্রিটিশ ভারতের ভাইসরয়কে এমন ভাষাতেই চিঠি লেখেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী।
১৯৪০ সালের ২৪শে ডিসেম্বর, অ্যাডল্ফ হিটলার কেও প্রায় একই ভাষায় লেখেন,
“প্রিয় বন্ধু,
আপনাকে বন্ধু হিসেবে ডাকা কোনো formality নয়। আমি কাউকে নিজের শত্রু মনে করি না। আমি সবসময় জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করতে চেয়েছি।
.. আপনার নিজের পিতৃভূমির প্রতি ভালোবাসা নিয়ে আমাদের কোনো সন্দেহ নেই, আমরা এটাও বিশ্বাস করি না যে আপনি ভেতরে ভেতরে একজন Monster। কিন্তু আপনার নিজের কিছু লেখা আর বক্তৃতায়, আপনি বিশ্বের কাছে নিজের এক পৈশাচিক ও অমানবিক ভাবমূর্তি প্রকট করেছেন, যা বিশ্বসৌহার্দ্য এর এক পরাকাষ্ঠক হিসেবে আমার কাছে অত্যন্ত বেদনাদায়ক..”
১৯৩৪ সালে রবীন্দ্রনাথকে লেখেন –
“প্রিয় গুরুদেব,
.. আমি বুঝতে পারছি, বিহার ভূমিকম্পের বিষয়ে আমার বক্তব্যের জন্য আমায় নিন্দার সন্মুখীন হতে হয়েছে। আমি আপনার বক্তব্য পড়ে বুঝলাম, আমাদের ধারণা গুলির পার্থক্যের কারণ হয়তো আমাদের বিশ্বাসের মধ্যে একটা Fundamental Difference আছে। কিন্তু আমি নিরুপায়, আমি মনে করি মানবজীবনে দৈব-ভূমিকার স্থান রয়েছে। কিন্তু তা কীভাবে, তা আমার জানা নেই।
[ “A divine chastisement for the great sin we have committed against those whom we describe as Harijans” – Gandhi . ]
১৯৪৪ সালে মহম্মদ আলি জিন্না কে লেখা এক চিঠিতে তিনি বলেন –
“Dear Qaid-E-Azam,
“.. এই দ্বিজাতি-তত্ত্ব নিয়ে আমি যত ভাবছি ততই দেখছি যে এটা কতটা সাংঘাতিক হতে পারে।.. আমি কখনোই একথা মানব না যে ভারতের অন্যান্য অধিবাসীদের থেকে ভারতীয় মুসলমানরা একটি আলাদা জাতি। যদি এই দাবি মেনে নিতে হয়, তাহলে দেশ কে টুকরো টুকরো করে ফেলতে হবে, যা ভারতের ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠবে। …”
এই চিঠি গুলোর প্রত্যেকটিতে উঠে আসছে একটা গভীর দর্শন, শান্তির পথ ও সাম্যবাদের স্বপ্ন। বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলার বা কাজ করার একটা দৃঢ় অঙ্গীকার আমরা সব ক্ষেত্রে দেখেছি এই মানুষটার মধ্যে। আজকে যা পরিস্থিতি, Racism যেই পৃথিবীতে একটা মহামারীর মতোই ভয়াবহ ভাবে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে চলেছে, সেই পৃথিবীতেই এমন একজন মানুষ ছিলেন যিনি সারা জীবন বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, কাজ করেছেন। ‘Untouchability’ কে এক ক্ষমাহীন অন্যায় বলে মানতেন এবং সেইভাবে মানুষের সামনে তুলে ধরেছিলেন এবং সেটার ‘eradication’ এর জন্য কাজ করেছিলেন। তবে উল্টো দিকে এটাও ঠিক যে গান্ধীজি’র ‘Caste System’ নিয়ে বক্তব্য ১৯২০’র দশকে অনেক ক্ষেত্রে সমালোচিত হয়েছিল এবং সেই ধাক্কার ফল স্বরূপ পরবর্তী সময়ে ‘Caste’ নিয়ে তাঁর বক্তব্য বদলে যেতে থাকে। দুটো সময়ের বক্তব্যের মধ্যে অনেক অমিল পাওয়া যায়। হিন্দু ধর্মের ‘Varna System’ কে উনি প্রথম দিকে support করেছিলেন, তারপর একজন যুগপুরুষের সংস্পর্শে এসে ওনার মধ্যে ‘ideological changes’ আসতে শুরু করে। এই যুগপুরুষের নাম বি.আর.আম্বেদকর। তাই গান্ধীজি কে নিয়ে আলোচনা করতে গেলে আম্বেদকর এর নাম এবং কাজ চলেই আসবে।
সারা পৃথিবী জুড়ে রাজনৈতিক conflict যখন তুঙ্গে তখন একজন শক্তিশালী রাজনৈতিক মানুষ হয়ে অন্য দেশের একজন শক্তিশালী রাজনৈতিক মানুষ কে বন্ধু বলার ক্ষমতা খুব বেশি মানুষের থাকেনা। গান্ধীজির সেটা ছিল। এই শান্তির আহ্বান একটা মানুষ কে শুধু রাজনৈতিক পরিচিতি থেকে উন্নত করে একটা মানবিক পরিচিতি দেয়। মানচিত্রের দেশ কে ছাড়িয়ে মনুষ্যত্বের দেশের কথা ভেবে গোটা পৃথিবী কেই বন্ধু করতে চেয়েছিলেন তিনি, স্বাধীনতা সংগ্রামের শীর্ষে থেকেও এমন ভাবনা বিরল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথে তাঁর চিঠি বিনিময় থেকে বোঝা যায় তাঁদের কিছু বিষয়ে মতের অমিল ছিল, কিন্তু তাদের তর্ক কে আধুনিক ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ তর্ক বলে গণ্য করা হয়। স্বরাজ, জাতীয়তাবাদ, অসহযোগ আন্দোলন এবং আরো নানা বিষয়ে এই দুই মানুষের তর্ক পাওয়া যায়। মতের অমিল দেখতে পাওয়া যায়। গান্ধীজি রবীন্দ্রনাথের সমালোচনার উত্তরে একটি পত্রিকায় লিখেছিলেন যে ব্রিটিশ দের রুখে দিতে হলে অসহযোগ আর তীব্র জাতীয়তাবাদ ছাড়া উপায় নেই। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সমালোচনায় বলেছিলেন ভারতবর্ষ লক্ষ লক্ষ সংস্কৃতি দিয়ে তৈরি তাই ওইভাবে ‘nationalism’ (We have no word for Nation in our language. When we borrow this word from other people, it never fits us) চাপিয়ে দেওয়া টা ঠিক নয়, রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
‘Our fight is a spiritual fight, it is for Man. We are to emancipate Man from the meshes that he himself has woven round him — these organisations of National Egoism’, এর উত্তরে গান্ধীজি লিখেছিলেন, ‘The nation’s Non-cooperation is an invitation to the Government to cooperate with it on its own terms as is every nation’s right and every good government’s duty. Non-cooperation is the nation’s notice that it is no longer satisfied to be in tutelage.’ তিনি আরো লিখেছিলেন, ‘Non-cooperation is intended to give the very meaning to patriotism that the Poet is yearning after’, এই ভাবে তর্ক চলতে থাকলেও কখনো এই দুজন মহীরুহ দার্শনিক একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধা হারাননি। অগাধ শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম কাজ করতো দুজনের মধ্যেই। তাই পরবর্তী সময়ে যখন সরাসরি কথা হয় তখন অনেক মজার কথাও উঠে আসে, জন্মদিনে শুভেচ্ছা থেকে শুরু করে ভালো সময়ে খারাপ সময়ে বার্তালাপ হয়েছে দুজনের মধ্যে। অনেক পন্ডিত মানুষ এই দুজন কে ‘two giant original thinkers of modern India’ বলে থাকেন।
রবীন্দ্রনাথ নাম দিয়েছিলেন ‘মহাত্মা’, সেই ‘মহাত্মা গান্ধীর’ জন্মদিন আসছে, কথাবৃক্ষ’র তরফ থেকে ছোট করে নিজেদের মতো করেই স্মরণ করা। এমন একজন মানুষের দর্শন বা মানবতা বা রাজনীতি কে ‘one dimensionally’ বোঝা বা বিশ্লেষণ করা অসম্ভব। ওনার দর্শন, কাজ, লড়াই, সংগ্রাম সব কিছু নিয়েই গবেষণা করা হয়, করা হচ্ছে, তবে একটা কথা মানতেই হবে, রাজনীতির বাইরে গিয়ে, মানবতার হাত ধরে, শান্তির পথে এই মানুষটি বিশ্ব দরবারে ভারতের সংগ্রাম কে পরিচিতি দিয়েছেন, তাই আজও বার্লিন এ চেক পয়েন্ট চার্লির বিশ্ব বিখ্যাত জাদুঘরে (অবশ্যই সারা পৃথিবীর বাকি অনেক দেশেই) ভারতের ইতিহাসে গান্ধীজির ওপর একটা আলাদা নির্দিষ্ট বিভাগ রয়েছে। জন্মদিনের শ্রদ্ধা’র সাথে সাথে এটাও প্রার্থনা যে আধুনিক ভারতের এই অরিজিনাল থিংকার জায়ান্ট এর দর্শন নিয়ে যেন আমরা একটু গভীরে ভাবতে পারি, আলোচনা ও দৈনন্দিন জীবনের আঙ্গিকে আনতে পারি।
References: My Letters – M.K.Gandhi,
News18 :https://www.news18.com/news/india greatest-indian-debate-mahatma-gandhi-and-rabindranath-tagore-on-nationalism-1533331.html
The Print https://theprint.in/opinion/this-leader-forced-mahatma-gandhi-to-change-his-views-on-caste/128108/
All rights reserved © Kothabriksha 2020