(১)
সুমিত টের পায় গন্ধে স্পর্শে। অঙ্গের মিশে যাওয়া মুলতুবি রেখে জিজ্ঞেস করে,
– কতদিন স্নান করিসনি রে?
– জলকে আজকাল আমার খুব ভয় হয় রে। গায়ে জল লাগলেই মনে হয় ডুবে যাব।
ওর দিনের পর দিন স্নান না করা শরীরের এখানে ওখানে ময়লা জমেছে। চুলে আঠা। হাত ডোবালে আটকে যায়। জটের পরব আসছে। চাঁদ গঙ্গা আটকে যাবে। কল থেকে জল পড়ে বালতি ভেসে যায়। মগ দোলে হাওয়ায়। স্নান হয়না।
– জলে ভয়? সেকি এ আবার কি?
– হ্যাঁ আমার ‘মেঘলা অসুখ’ করেছে।
সেদিন সুমিতকে ও একটা জাহাজের স্বপ্নের কথা বলে। বলে, ‘আজকাল খুব ভয় পাই রে। রাতে ঘুমোলেই জল দেখি। দেখি আমি ডুবে যাচ্ছি। জল বাড়ছে, চারপাশের সব কিছু ডুবিয়ে দিচ্ছে। এই বাড়ি, ঘর, টেবিল, এই বিছানা, চাদর সব। সব মানুষেরাও ডুবে যাচ্ছে কিন্তু সবাই বেঁচে আছে। কেমন যেন সবাই জলে থেকে সাদা হয়ে আছে। চারপাশে মাছেরা ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে। কেউ কেউ গা-হাত-পা ঠোকড়াচ্ছে, মাংস খুবলে নিচ্ছে। আমার চোখ দুটো গর্ত হয়ে গেছে মাছের কামড়ে। তারপর একটা নোঙর নেমে এলো। আমার পিঠে বিঁধিয়ে তুলে ফেলল। আমি একটা জাহাজের খোলের মধ্যে পড়ে আছি। কাঠের মেঝে। জাহাজটা দুলছে। আকাশে মেঘ করেছে। আমার অসুখের মতন।’
– কিছু খেয়েছিস?
– তুই ঝলমলিয়ে একটু সন্ধ্যা ঢাল দেখি। এক চুমুক চাখি।
– ধুর! তোর সাথে কথা বলা… শালা বোকামি, সময় নষ্ট।
– এই শপিং মলের শহরে এখনো কিছু বোকা আছে জানিস।
– ধুর! আমি চললাম।
– যা। কিন্তু মেঘের অসুখ যেন আমায় ছেড়ে না যায় কখনো। দেখিস একটু।
– দরজাটা ধা-প করে টেনে সুমিত বেরিয়ে যায়। কর্কশ চোখে।
(২)
‘এ ক’দিন খুব নিরিবিলি পেয়েছিস না রে?’ পায়ে হাত বোলাতে বোলাতে সুমিত বলে।
বালি উড়ে গেলো হাওয়ায়, মাঝে মাঝে জলীয় ঠাণ্ডা। সমুদ্রের ধারে একটা উলটানো নৌকার ওপর বসে। বিয়ার বোতল চলছে ফিরছে। সুমিতের কোলে পা রেখে ও আধশোয়া। সুমিত ওর কোলে পা তুলে। আকাশ আবার মেঘলা। চিল উড়ছে। ‘কুক্কুরুক্কু পালোমা’ চলছে ফোনে। ও তখনই দেখে কাজুবাদাম গাছটা। সুমিত বলে 69 গাছ। কাজুবাদাম দুটো এপাশ ওপাশ রাখলে যেমন…অনেকটা যেন ‘য়িন-য়াং’ সিম্বলের মতো বা দুরদর্শন। দুটো ইনভার্টেড কমার কোন কথা নেই।
– কি রে, ঐ গাছটা কখন আনলি ?
– বেহাগের সময়। তুই তখন জ্যোৎস্না মাখছিলি।
– ওহ।
একটা কাজু মুখে পুরে চিবোয় ও। সুমিত দূরে চেয়ে থাকে সমুদ্রের দিকে, সিসিলি দ্বীপ দেখা যাচ্ছে।
– চল… যাবি?
– কিন্তু আমার তো জল ভয় লাগে।
– ধুর পাগল, জাহাজ নিয়ে যাবো তো। গাছটা ঐ জন্যেই তো এনেছি সঙ্গে করে।
– কাজুবাদাম গাছের কাঠ দিয়ে জাহাজ হবে?
– কেন হবেনা ? দেখিসনি থার্মোকল দিয়ে কত দুর্গাঠাকুর বানায় ?
– ও, হ্যাঁ তাইতো।
– হ্যাঁ রে জাহাজে পতাকা থাকবে?
– হ্যাঁ, গোলাপি আর নীলে। ঠিক তুই যেমন চেয়েছিলি।
– ডেকটা একটু চওড়া বানাস। পা দুলিয়ে বসে বিয়ার খাব।
– কি নাম দিই বলতো?
(৩)
সেদিন হঠাৎ করে বৃষ্টি নেমে যায়। ওরা কাজুবাদামের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল একটা নামের খোঁজে। হঠাৎ বৃষ্টি নেমে যাওয়াতে দাঁড়ানোর আর যায়গা পেল না। দুজনেই পুরোপুরি ভিজে গেলো। ওর খেয়াল ছিল না।
সুমিত বলল – কিরে ভয় করছে না তোর?
– শুধু শুধু ভয় কেন করবে?
সুমিত আর কথা তুলল না জলের। ওর খেয়ালই নেই যে ও ভিজছে। ওর বরঞ্চ ভাল্লাগছিল। চারপাশে গাছের পাতা। পাতা বেয়ে জল পড়ে যাচ্ছিল। সেই জল দুহাতে অঞ্জলি করে তুলে তুলে ওর সারা শরীর ভিজিয়ে দিচ্ছিল সুমিত। ‘নে নে তাড়াতাড়ি মেখে নে দেরী করলে শুকিয়ে যাবি।’ ওরা ঘন হতে গিয়ে নাড়া পড়ল। তখনি একটা জাহাজের ভো শুনে ও চমকে উঠল।
– কি রে, কিসের শব্দ হল? আমাদের জাহাজটা কেউ নিয়ে যাচ্ছে না তো?
– দাঁড়া তো দেখে আসি।
সুমিত দেখতে গেলো। ও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজছে। আর সুমিতের ওয়েট করছে। কিন্তু সুমিত ফিরছেনা। ও ডাকল কয়েকবার। এগিয়ে দেখতে গেলো। কিন্তু কোথায় সুমিত ? সামনে একটা বাথটাব আর একটা খালি জাহাজের খোল দোল খাচ্ছে জলের ধারে। ও ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো বাথটাবটার দিকে। দূরে কোথাও দুরদর্শনের সিগনেচার টিউনটা বাজছে।
সুমিতকে তারপর থেকে আর পাওয়া গেলো না।
(৪)
একদিন ও হঠাৎ স্নান করছে বাথটবে বসে, খোলা দরজা দিয়ে সুমিত ঢুকে পড়ে। একদম চেনাই যাচ্ছেনা, অন্যরকম শার্ট কালো চশমা গলায় চেন।
– ও বলে, কি রে ভালো আছিস?
– হ্যাঁ ভালো।
– কি করছিস? এখন আর আসিস না কেন রে?
– ব্যস্ত রে। ব্যবসা করছি।
– কিসের ব্যবসা।
– জাহাজের। তুই কি করছিস আজকাল?
– আমি স্নান করছি। কাজু বাদাম খাবি? …এই নে।

Cover art: Shuvradip
All rights reserved, Copyright © Kothabriksha 2020