দেবী থেকে মানবী – নীলিমেশ রায় | শারদীয়া সংখ্যা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন যে, শাক্ত পদাবলীর কবিরা সুদূর হিমালয় আর কৈলাশ কে তাঁদের শাক্ত গানের মধ্যে তুলে ধরেছিলেন এই বাংলার আম-কাঁঠালে ঘেরা পানা পুকুরের ঘাটের পটভূমিতে। তাই সেখানে শিব পার্বতীর দাম্পত্য জীবনে এসেছে বাঙালি গার্হস্থ্য জীবনের প্রভাব।

বাংলার পটে দুর্গা


মধ্যযুগের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর ‘চন্ডীমঙ্গলে’র দেবখন্ডে দেখা গেছে গৌরীর সাথে শিবের কলহ দৃশ্য। যেখানে গৌরী আফসোস করেছে তপস্যা করে শিবের মতো ভিক্ষুককে স্বামী হিসাবে পাওয়ার জন্য। সেই কারণেই তাঁর দুর্দশার অন্ত নেই, এমন অভিযোগও জানিয়েছে সে। বৃদ্ধ শিবের জন্য নানা বিচিত্র পদ রান্না করতে করতেও গৌরী ক্লান্ত। শিবের ভিক্ষায় সংসার চলে, কিন্তু নেশার পেছনেই তার অধিকাংশ ব্যয় হয়ে যায়। তাই গৌরী শিবের দীর্ঘ ফরমাশ শুনে ভীষণ রেগে গেছেন এবং বলেছেন,
“আজিকার মত যদি বান্ধা দেহ শূল।
তবে সে আনিতে পারি প্রভু হে তন্ডুল।।”
(মুকুন্দরাম চক্রবর্তী)
এই দৃশ্য দেখে ভাবতেও অবাক লাগে যে, মধ্যযুগে কিভাবে স্বর্গের দেবতারা হয়ে উঠেছিলেন আমার-আপনার মতই আম-বাঙালি। কারণ আমরা ব্যক্তিগত জীবনেও এমন ঝগড়ার সাক্ষী তো হয়েই থাকি।

শুধুমাত্র ‘চন্ডীমঙ্গলে’ই নয়, অন্যান্য মঙ্গলকাব্যের দেবখন্ডেও এমনই শিব পার্বতীর ঝগড়ার দৃশ্য দেখতে পাওয়া গেছে।

কালীঘাটের পটচিত্রের শিব

‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে কবি ভারতচন্দ্র রায় আবার দেখিয়েছেন এইরকমই ঝগড়ার সময় শিবজায়া শিবকে দশমহাবিদ্যার রূপ দর্শন করিয়ে নিজের মহিমার প্রমাণও দিয়েছেন। আসলে মধ্যযুগের কবিরা ধীরে ধীরে মানুষের ধর্মীয় চেতনা কে বাস্তববোধের আধারে আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন। যেখানে শিব এক বৃদ্ধ নেশাতুর মদ্যপ ব্যক্তি। যাঁর একটি বৃদ্ধ ষাঁড় আছে। তাঁরই পিঠে চড়ে তিনি ভিক্ষা করে বেড়ান। পথে ছেলের দল তাঁর গায়ে ধুলো দেয়। তাদেরকে খুশি করার জন্য শিবকে সাপের খেলা দেখাতে হয় বা জটা থেকে জল বার করেও দেখাতে হয়। এমন দৃশ্য ‘শিবায়ন’ কাব্যে খুবই সহজলভ্য। আবার এর বহু আগে ‘কুমারসম্ভবম্’ কাব্যে মহাকবি কালিদাস শিব-পার্বতীর মধ্যেকার আদিরসাত্মক দৃশ্যও নির্মাণ করেছিলেন। যা ভারতীয় সাহিত্যের এক দুর্লভ সম্পদ।

এরপর মধ্যযুগের শেষের দিকে এসেছেন শাক্ত কবিরা। তাঁরা আবার দেবীকে করে তুলেছেন মেয়ে আর শিব হলেন ঘরের জামাই। যেখানে উমা হয়ে উঠেছেন সম্পূর্ণ মানবী। অলৌকিকতা সেখানে বর্জিত হয়ে চরিত্রটিকে করে তুলেছে বস্তুমুখী। এই উমা ‘চপলা, চঞ্চলা, অভিমানিনী পল্লীবালা ও কর্তব্যপরায়ণা, সোহাগিনী পল্লীবধূ।’ তবে কেবল চঞ্চলতাই নয়, শাক্ত পদাবলী তে বোঝা গেছে যে উমা একজন বুদ্ধিমতী নারীও বটে। মা মেনকা যাতে কষ্ট না পান, তাই স্বামীর মাথায় সতীন গঙ্গার অবস্থান নিয়ে যখন মেনকা অভিযোগ করেছেন, তখন উমাকে বলতে শোনা গেছে,
“শুনেছ সতীনের ভয়, সেসকল কিছু নয় মা!
তোমার অধিক ভালোবাসে সুরধুনী।
মোরে শিব হৃদে রাখে, জোটাতে লুকায় দেখে,
কা’র কে এমন আছে সুখের সতিনী।।”
‌ (কমলাকান্ত ভট্টাচার্য)
শুধু তাই নয় উমা সেখানে আর পাঁচজন বাঙালি মেয়ের মতোই নিজের মায়ের কাছে স্বামীর প্রশংসাও করেছে – যাতে মেনকা মনে শান্তি পান।
আবার উমার চাতুরীও কম নয়। শিবের কথা উঠলেই তাঁর মনে জমা অভিমান চোখের জল হয়ে প্রকাশ পেলে,’আমার চোখে কি হলো’ বলে উমা চোখের আঁচল দিয়েছে।
এই ভাবেই শাক্ত কবিরা আমাদের দেবীকে মানুষ করে তুলেছিলেন।
শাক্তপদে শিব চরিত্র বিশেষ বিকাশ লাভ না করলেও, যখন উমা শিবের কাছে বাপের বাড়ি যাওয়ার জন্য অনুমতি চেয়েছেন তখন সেখানে রসিক,পরিহাস-প্রিয় শিবের পরিচয় পাওয়া গেছে –
“জনক ভবনে যাবে, ভাবনা কি তার,
আমি তব সঙ্গে যাবো; কেন ভাবো আর।
আহা, আহা, মরি মরি, বদন বিরস করি,
প্রাণাধিকে প্রাণেশ্বরী, কেঁদো নাকো আর।
(ঈশ্বর গুপ্ত)
শাক্ত পদাবলীর অপর কবি রামপ্রসাদ সেনের রচনায় মা ও মেয়ের মিলন দৃশ্যের আগমনী গানে ভক্ত ও ভগবান মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছেন। এরমধ্যে অসাধারনত্ব কিছু নেই। রয়েছে গরিব ভিখারি বরের সংসারে মেয়ের দুর্দশা নিয়ে মায়ের গভীর চিন্তা আর মনোকষ্টের প্রকাশ। এরপর যখন এসেছে নবমীর রাত, মেনকা কাতর কন্ঠে প্রার্থনা করেছেন,
“রজনী জননী, তুমি পোহায়ো না ধরি পায়ে,
তুমি না সদয় হ’লে উমা মোরে ছেড়ে যায়।”
(কবির নাম অজানা)
বিজয়ার করুণ দৃশ্যে মেনকার কান্না যেন কোনো পল্লীবাংলার মায়ের হৃদয়ের অনুভূতিকেই প্রতিধ্বনিত করে।
তারপর আসে দশমীর সকাল, শিব আসেন স্ত্রী পুত্রদেরকে নিয়ে যেতে –
“বিছায়ে বাঘের ছাল দাঁড়ে বসে মহাকাল,
বেরোও গণেশ মাতা, ডাকে বারে বার।”
(রামপ্রসাদ সেন)
শিবের ডাকে সাড়া দেন উমা। তাঁকে চলে যেতে হয়। মেনকার কান্না তখন আর্তচিৎকারে ভেঙে পড়ে।

যামিনী রায়

আগমনী থেকে বিজয় – শাক্ত পদাবলীর এই পদ গুলির মধ্যে বাঙালির পারিবারিক জীবনের ছায়াছবি লক্ষ্য করা গেছে বারবার। ঘরের মেয়েকে নিয়ে তার বিয়ের জন্য দুশ্চিন্তা, আবার বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে মেয়ে কেমন আছে সেই নিয়ে ভাবনা – এতো বাঙালির প্রতি ঘরের দৃশ্য। সেই দৃশ্যই যেন আঁকা হয়েছে শাক্ত পদাবলীর গান গুলিতে। এখানে চরিত্রগুলি দেবতা হলেও তাঁরা হয়ে উঠেছেন রক্তমাংসের মানুষ। তাঁদের আবেগ অনুভূতি সবদিক থেকেই তাঁরা হয়ে উঠেছেন আমার-আপনার আপনজন।

এর পাশাপাশি একটা বিতর্কের অবকাশ থেকেই যায় যে, এই যে শক্তিবাদ একি তবে বৈদিক নয়? অনেকের মতে অনার্য সম্প্রদায়ের যে সকল মানুষ বন্য পার্বত্য প্রদেশ থাকতেন, তাদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা থেকেই শক্তিবাদের সূচনা হয়েছিল। কারণ, বেদে স্ত্রী-দেবতা প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের ১২৫ সূক্তটিতে যে দেবী বন্দনা আছে তার থেকেও শক্তিবাদের উৎপত্তি হয়েছে বলে মনে করা যেতে পারে। কিন্তু বেদ স্ত্রী-দেবতাদের বিশেষ গুরুত্ব দেয়নি। তাই এই নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।

শক্তিবাদের মূলে যে ‘শক্তি’ আছে, এই শক্তি হল সর্বশক্তিমান পরমব্রহ্মের সব কর্মকাণ্ডের মধ্যে সুপ্ত এক সর্বব্যাপী শক্তি।এর সাথেই আবার জড়িয়ে আছে দশমহাবিদ্যার ধারণাটিও – যেটি হল আদ্যাশক্তি’র ধারণার সমান্তরাল।দেবী দুর্গা হলেন সেই আদ্যাশক্তিরই একপ্রকাশ। পুরাণে যাকে সিংহবাহিনী মহিষাসুরমর্দিনী রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। মহিষাসুরের হাত থেকে যিনি দেবতাদের রক্ষা করেছিলেন। সকল দেবতাদের সম্মিলিত শক্তি থেকেই যাঁর উৎপত্তি।

বাংলার পট

কেউ কেউ আবার মনে করেন, দেবী দুর্গা হলেন শস্য সম্পদের দেবী।’মার্কেণ্ডেয় পুরাণে’ দেবী দুর্গাকে শাকম্ভরী বলা হয়েছে। আসলে দুর্গাপুজোর সময় মূল প্রতিমার পাশে যে কলাবৌ কি আমরা দেখতে পাই, যাঁকে গণেশের বউ হিসেবে বলা হয়ে থাকে। তা আসলে নবপত্রিকা – অর্থাৎ ন’প্রকার শস্য গাছের পাতার সমাহার। সেই নটি পাতা হল – কলা, কচু, হলুদ, যব, ডালিম, অশোক, মানকচু ও ধান। কাজেই এর থেকে বলা যায় যে, দেবী শাকসবজি দিয়ে নিজেকে পরিপূর্ণ করে রাখেন। আর অনাবৃষ্টিই হচ্ছে শস্য ফলনের প্রধান বাধা। তাই এই অনাবৃষ্টি সমান সমান মহিষাসুর ধরলে।এ কথা বলা যায় যে, দেবী মহিষাসুরকে বধ করার মাধ্যমে আসলে পৃথিবিকে অনাবৃষ্টির হাত থেকে রক্ষা করেছেন। এছাড়া আবার অনেকে মনে করেন, প্রাচীনকালে বর্ষাকাল শেষ হয়ে যাবার পর রাজারা দেবীর পুজো করে বিশ্বজয়ে বেরোতেন। সেই থেকেই শারদীয় উৎসবের প্রচলন হয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণ অনুসারে সেই কারণেই শারদীয়া দুর্গোৎসব হলো ‘অকালবোধন’ – কারণ রাম নাকি শরৎকালেই দেবীর আরাধনা করে রাবণ বধের জন্য বড় লাভ করেছিলেন।

এই দেবী দুর্গাই যে শিবের স্ত্রী উমা একথা নিশ্চিত ভাবে বলা না গেলেও, লৌকিক ও পৌরাণিক আখ্যান মিশে গিয়ে সত্যি সত্যি দুর্গা বা শিব-পার্বতী, এঁরা সকলেই প্রতিবছর শরতের শিউলি তলায় – আম-কাঁঠালের ঘেরা পানা পুকুরের ঘাটে নেমে আসেন আর অখিল বিমানে ধ্বনিত হয় মর্তের আনন্দ বাণী। যেখানে ভক্তির সাথে মিশে যায় লৌকিক আবেগ আর বাৎসল্য-প্রতিবাৎসল্যের অনুভূতিতে দেবী হয়ে ওঠেন ঘরের মেয়ে।

শোভাবাজার রাজবাড়ি (ছোটতরফ)

গ্রন্থঋণ : ১. শ্রী শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রী বিশ্বপতি চৌধুরী সম্পাদিত ‘কবিকঙ্কণ-চন্ডী’।
২. শাক্ত পদাবলী (সাধন তত্ত্ব ও কাব্য বিশ্লেষণ) – শ্রী ব্রজেন্দ্র চন্দ্র ভট্টাচার্য।
৩. শাক্ত পদাবলী (চয়ন) – শ্রী অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত।
৪. ভারতচন্দ্র গ্রন্থাবলী – শ্রী বজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ও সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত।
৫. বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত – শ্রী অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

প্রচ্ছদ : শুভ্রদীপ ব্রহ্ম
অলংকরণ : ইন্টারনেট(কালীঘাট পটচিত্র, যামিনী রায় অঙ্কিত চিত্র,বাংলার পটচিত্র) ও নীলিমেশ রায়(স্থিরচিত্র)।

Copyright © Kothabriksha 2020, All Rights Reserved.

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.