ভারতবর্ষের বিখ্যাত মেলাগুলোর মধ্যে শোনপুরের মেলা অন্যতম। গুরু বা কার্তিক পূর্ণিমার পুণ্যলগ্নে এই মেলা আরম্ভ হয়। প্রচলিত আছে যে গঙ্গা-গণ্ডকের সঙ্গম স্নানেই ঘটে পাপমুক্তি। ভারতবর্ষ তো বটেই, বিদেশ থেকেও আসেন অগণিত মানুষ। কাতারে কাতারে মানুষ, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোথায় চলেছেন? কিসের টানে? কাঁধে বা মাথায় একটা করে থলে, পরনে আধময়লা ধুতি, শাড়ি। কোনোকিছুর ভ্রুক্ষেপ না করেই সকলে নিশির ডাকে তন্দ্রাচ্ছন্নের মত এগিয়ে চলেছে অজানা ময়নাদ্বীপে। ভাবটা এমন, যেন সেখানেই সর্ব-সুখ! কোন কোলাহল নেই, নেই খিটিমিটি, নেই পা মাড়িয়ে ধাক্কা দিয়ে আগে চলার উদগ্র বাসনা, নেই অহেতুক দেখনদারি, নেই মুঠোফোনের মুহুর্মুহু প্রলাপ বা সেলফির ঘনঘটা। সমুখে শুধুই ‘শান্তি পারাবার’। সুশৃঙ্খল দেহাতী জনতার মহা-মিছিল। তাদের চোখেমুখে নেই গগনচুম্বী চাহিদার অনিমেষ প্রতিফলন। অল্পেই সন্তুষ্ট তারা। এই ভারতের মহামানবের সাগরতীরের প্রতিভূ তারাই।
কোথাও কোনো ট্রেনের টিকিট না পেয়ে অবশেষে কাটলাম পাটনা দুরন্ত-র টিকিট। শালিমার থেকে শুক্রবার রাতে ট্রেন ছাড়লো, পরদিন ভোরবেলায় পাটনা জংশন। স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে গরম চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিতে দিতে এক নজরে তাকিয়ে দেখলাম শহরটাকে। তারপর সামান্য প্রাতরাশ সেরে, একটা অটো ধরে চললাম গন্তব্যের দিকে। পাটনার বিখ্যাত এবং ভারতের দ্বিতীয় দীর্ঘতম নদী সেতু—মহাত্মা গান্ধী সেতু, পেরিয়ে চললাম শোনপুরের দিকে। অটো চলবে হাজিপুর পর্যন্তই, তারপর হন্টন। খানিকদূর এগোতেই দেখি সামনে বিপুল জনসমুদ্র, ঠিক যেন অষ্টমীর রাত আটটার মহম্মদ আলি পার্ক। অটো-চালকের কথায় বুঝলাম যে ওই রাস্তার সোজা গেলেই ঘাট। আর ঘাট পেরলেই মোক্ষ। ‘পণ্যভূমে পুণ্যস্নান’ – পড়েছিলাম অনেক আগেই।

যাই হোক, অটো থেকে নেমে খানিকদূর হেঁটে ডানদিকে যেতেই এসে পড়ল গণ্ডক ব্রিজ। সেই ব্রিজ অতিক্রমণেই বহু প্রতীক্ষিত শোনপুর। গণ্ডক ব্রিজের সামনে পৌঁছাতেই বেশ সময় লাগল।অবিরাম মানুষের মিছিল। প্রত্যেকের কাঁধে বা ঘাড়ে বিশাল বোঝা। পথের ধারে দীপ্ত জিলিপি-কচুরির দোকান। কালকূটকে পথে এইসব দোকান থেকে জিলিপি খেতে মানা করা হয়েছিল, কারণ তা সবই নাকি বাসি। তবে আমি সন্দিগ্ধ চিত্তে গোগ্রাসে জিলিপি খেলাম। বেশ লাল করে ভাজা মুচমুচে জিলিপির কদরই আলাদা। বেলা বাড়ছে, খিদেও পেয়েছে। অনন্যোপায়।

অবশেষে ব্রিজের রাস্তা পেরিয়ে, একটি হোটেলে ব্যাগপত্র রেখে বেরিয়ে পরলাম মেলার উদ্দেশ্যে। মূল মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করবার পর, দেখতে পেলাম অদূরেই গঙ্গা-গণ্ডকের সংযোগস্থল বা সঙ্গমে স্নানরত লাখ লাখ মানুষ। মেলার মূল প্রবেশ পথে ধরে এগোতে এগোতে চোখে পড়লো উঁচু তোরণ। সেই তোরণ সকলকে স্বাগত জানায় শোনপুরের মেলায়।
অতুলনীয়, ব্যতিক্রমী শোনপুরের মেলার আছে কেবলই দারিদ্রের ঐশ্বর্য। এই মেলায় তাই সকলেই নিজেকে রাজা মনে করেন। এগোতে এগোতেই সামনে চোখে পড়লো বিশাল মণ্ডপ। মালুম হল ওগুলিই থিয়েটার, রাত বাড়লেই সেখানে জমবে মেহেফিল। থিয়েটারকে পিছনে ফেলে সামনে এগিয়ে চলতেই, পাশে তালপাতার ঘূর্ণি বিক্রি করছে কৃষ্ণনগরের বছর বাইশের পাপাই। স্বপ্ন, ভালোবাসা, বকুনি ও চোখের জল — সবটাই যেন ঘূর্ণির সাতরঙে মিশে একাকার হয়ে যায়।
হাতি-বাজার, ষাঁড় ও চিড়িয়াবাজার। নধরকান্তি গরু-মোষ জাবর কাটছে তাঁবুর ভিতরে-বাইরে। মালিক তখন দিবানিদ্রায় মগ্ন। এগিয়ে চলতে চলতে চোখে পড়লো একটা বড় মাঠ, অগণিত ঘোড়া। আফগান, পেশোয়ার বা পাকিস্তান থেকেও নাকি চোরাপথে সেই ঘোড়া আসে। ঘোড়ারগুলোর উচ্চতা আনুমানিক সাত ফুট তো বটেই। তাদের হ্রেষাধ্বনিতে শঙ্কা জাগে। মালিক তার দেহ মর্দনে ব্যস্ত, সেও প্রায় নিদ্রায়িত, আরামে বিলাসে। তার কাছেও তো স্পষ্ট নয় নিয়তির অমোঘ বিধিলিপি! সরকারি দপ্তর, রেসের মাঠ বা কারও ব্যক্তিগত মালিকানায় হয়তো তার স্থান হবে! এত আদর আপ্যায়ন তার কপালে তখনও সেখানে জুটবে তো? খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারলাম ঘোড়ার দাম চল্লিশ হাজার থেকে দুলাখ টাকা পর্যন্ত ওঠে।
খ্রিস্টপূর্ব ৩৪০ থেকে ২৯৭-র মধ্যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এসেছিলেন শোনপুরের মেলায়, সেনাবাহিনীর জন্য হাতি কিনবেন মনে করে। শোনা যায়, পদব্রজে নাকি এসেছেন ফা-হিয়েন ও হিউয়েন সাং’ও। এসেছেন গন্ধর্ব প্রধান হুহু ও পাণ্ডস্যের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। হাতিবাজারে সাকুল্যে একটিই হাতি দেখতে পেলাম। ১৯৬৮-তে কালকূট সাড়ে তিনশোর কাছাকাছি হাতির দেখা পেয়েছিলেন। সিংবাহাদুরজি তাঁর অত্যন্ত প্রিয় হাতি সূরযকেও শোনপুর মেলায় বিক্রি করে দিয়েছিলেন। ২০০১ সালেও মেলা আলো করে ছিল ৯২টি হাতি আর সেখানে আজকে তা কমে হয়েছে ১টি। হঠাৎ করে হাতির সংখ্যা কমে যাওয়ার কারণটি কি? উত্তরপ্রদেশের দেওরিয়া থেকে আসা এক জমিদার তথা হাতি বিক্রেতা সঞ্জীব কুমার গত বছর জানিয়েছিলেন, হাতির সংখ্যা নিঃসন্দেহে বাড়তো যদি সরকার হাতি মালিকদের প্রতি সহৃদয় হতেন। হাতি বাজারে বিরাট ভাড়া গুনতে হয়, হাতির প্রাত্যহিক খোরাকির খরচও আকাশছোঁয়া। এত খরচের পরও হাতিবাজারে নেই ন্যূনতম পরিকাঠামোগত সুবিধা, এমনকি সামান্য আলোর বন্দোবস্তটুকুও হাতিবাজারে নেই। ১৯৭২-র বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনে ২০০৪ সাল থেকে শোনপুর মেলায় হাতি কেনাবেচা নিষিদ্ধ। এমনকী হাতির মালিকানা বদলে দানপত্রও পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ২০১৫ সাল থেকে মেলায় হাতি বিক্রি করতে গেলেও বন দপ্তরের ছাড়পত্র আবশ্যিক করা হয়েছে।

পুলিশের নাকের ডগায় প্রকাশ্যেই চলছে রমরমিয়ে পাখি কেনাবেচা। ষণ্ডবাজারে রয়েছে বিশালকায় সব ষাঁড়, বহুদিন তারা নিশ্চই মাতৃদুগ্ধ বঞ্চিত কারণ তা না হলে এত ফোঁসফোঁস তর্জন গর্জনে হা-হুতাশ ব্যক্ত করত না। এক একটি ষণ্ড আয়তনে প্রায় হাতিকে ছুঁইছুঁই। ভীতি-জাগানো নিকষ কালো ষণ্ডামার্কা শরীর তাদের।
অতঃপর মীনাবাজার। কালকূটের বর্ণনায় নানা বয়সের মেয়েরা মাথা নিচু করে বসে আছে। কারও মাথায় ঘোমটা, কারও নেই। আট-দশ বছরের বালিকা থেকে পঞ্চাশ বছরের স্ত্রীলোকও আছে। বিক্রেতারা সবাই বাবা-ভাই-স্বামী। বাইরের লোক কেউ না। আমাদের পাশেই হিন্দি ভাষায় শুনতে পাচ্ছি, ‘এ রউয়া দশ বছরের মেয়েটাকেই নিন, দাম একটু বেশি পড়বে। তবে চাঁদ যদি কিনতেই হয় প্রথমার চাঁদ কেনাই ভালো।’ সংবিধানে নারীর আত্মরক্ষার অধিকারকে কী দারুণ নিশ্ছিদ্র মৃত্যুঞ্জয়ী কবচ দিয়ে বাধানো হচ্ছে। ১৯৬৮-তে কালকূট দেখেছিলেন আর লিখেছিলেন ১৯৮৬-তে। ৮৫-তেও মেয়ে বিক্রি হয়েছে অবাধেই।
আমরা মীনাবাজারে দেখলাম কলকাতা থেকে আগত পনেরো টাকায় হরেকমালের সওদা। রাত ঘনালে এখানেই কি জমবে নারীদেহের বেসাতি? তরোয়াল বিক্রেতার খাপ থেকে বেরোবে হরেক কিসিমের নারী। মরজিমাফিক অর্ডার করলেই মিলবে তন্বী-ক্ষীনাঙ্গী-শ্যামাঙ্গী।
মীনাবাজার ঘুরে দেখবার পর আমাদের সর্বশেষ গন্তব্য বা দ্রষ্টব্য হরিহরনাথ মন্দির। হরিহরক্ষেত্র পুরাণে ‘হরিক্ষেত্র’ বা ‘দদরিক্ষেত্র’ নামেও পরিচিত। শ্রী হরি বা কৃষ্ণের গোপালকে নাকি রক্ষা করতেন হর। সুতরাং মানুষের বিশ্বাস দেবতাদের সাক্ষাৎ বিচরণক্ষেত্র এই হরিহরক্ষেত্র। প্রথমে এই মেলার স্থান ছিল হাজিপুর, ঔরঙ্গজেবের আমলে মেলা স্থানান্তরিত হয়ে হাজিপুরের রামচুরা অঞ্চল থেকে শোনপুরে আসে। গণ্ডক নদীর নাম তখন ছিল সদানীরা। মুঘল আমলে, সুবেদার রাজা মানসিং এই হরিহরনাথ মন্দির নির্মাণ করেছিলেন। প্রকৃতির রোষানলে কালক্রমে ওই মন্দির হয়ে পড়ে ভগ্নপ্রায়। বর্তমানের যে হরিহরের মন্দির আমরা দেখতে পাই, তা বিহারের এক ধনী জমিদার রাজা রাম নারায়ণের তৈরি। মন্দির তারপর কলেবরে আরও বেড়েছে এক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর অর্থানুকূল্যে। আদিতে ইতিহাস বলে শোনপুর-হাজিপুর ছিল বৃজি প্রজাতন্ত্রের অংশ। পরবর্তীকালে এই অঞ্চল ধনী দুধ ব্যবসায়ী ব্রাত্য বা কিকাতদের দখলে আসে। অজাতশত্রুর সঙ্গে লিচ্ছবিদের ঝগড়া বিবাদ ইতিহাসে সুবিধিত। মাহি ও সাগরনদী ছিল গণ্ডকের শাখানদী। বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে মাহি ও সাগরনদীর ধারে এক সংঘারামের কথা জানা যায়। তাহলে এবার প্রশ্ন হলো যে শোনপুর কি একদা ছিল মগধের সন্নিকটে?

পুরাণ বলে একদা শোনপুরে নাকি ছিল বিরাট এক ঝিল। ঝিলে বাস করত অতিকায় এক কুমীর বা গ্রহ। আসলে সে কুমীর ছিল অভিশপ্ত গন্ধর্ব প্রধান হুহু। একবার দেবলা ঋষি ঝিলের জলে স্নান করতে এসেছিলেন, জলকেলির সময় হঠাৎই হুহু-র পা লেগে যায় দেবলা ঋষির গায়ে। ক্রোধান্বিত ঋষি অভিশাপ দেন যে হুহু-কে কুমীরের রূপ পরিগ্রহণ করে ঝিলের জলে দিনাতিপাত করতে হবে। এরপর পাণ্ডস্যের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন একদিন গভীর ধ্যানে রত হয়েছেন। তিনি খেয়াল করেননি, যে তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন মুনি অগস্ত্য। মুনিবর ভাবলেন রাজা তাঁকে অবজ্ঞা করছেন। রুষ্ট হয়ে রাজাকে তিনি অভিশাপ দিলেন, যতদিন না অলৌকিক কিছু ঘটছে ততদিন গজ রূপ পরিগ্রহ করে থাকবেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন। অতঃপর রাজা গজ রূপে একদিন স্নান করতে ঝিলের জলে নামলেন এবং কুমীর রূপী হুহু তার পা কামড়ে ধরল, শুরু হল মরণপণ লড়াই। গজ পর্যুদস্ত হতে হতে ঝিমিয়ে পড়ল। সে ঝিল থেকে একটি পদ্ম তুলে শ্রীহরির শরণাগত হল। ভক্তের দুর্দশায় শ্রীহরি চক্রের সাহায্যে কুমীরের গলা ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ও গন্ধর্ব প্রধান হুহু-দু’জনকেই পাপমুক্ত করলেন। গজ-গ্রহের যুদ্ধ সমাপনে হরি আর হর একত্রে পূজিত হন এই শোনপুরের হরিহরক্ষেত্রে।

এরপর এলো ঘরে ফেরার পালা। এক জীবন্ত ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে নিজেকে ধন্য মনে হয়েছিল। ফা-হিয়েন থেকে হিউয়েন সাং, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য থেকে ঔরঙ্গজেব, রাজা রাম নারায়ণ – দর্পিত রাজরাজড়ার পথ দিয়ে বয়ে গেছে অনেক কাল, ভেসে গেছে সাম্রাজ্যের বেড়াজাল, যা রয়ে গেছে তা হলো ইতিহাস ও পৌরাণিক গল্পেরা। সেই ইতিহাসকে সাক্ষী করার জন্যই রয়ে গেছি আমরা। হয়তো আবারও কোনো এক সুযোগে বেরিয়ে পড়বো এমনি এক ইতিহাসের খোঁজে।

স্থিরচিত্র: শুভ্রদীপ
Copyright © Kithabriksha 2020, All Rights Reserved
One Comment Add yours